• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

বাঙালির চেতনায় শহীদ আসাদ

  • মো. জোবায়ের আলী জুয়েল
  • প্রকাশিত ২২ জানুয়ারি ২০১৯

বিশ জানুয়ারি শহীদ আসাদের ৫০তম মৃত্যুদিবস পালিত হলো। ভুলে যেতে বসেছি কি আমরা আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের মহানায়কদের? বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পথ ধরে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতার এ পথ পরিক্রমায় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান একটি মাইলফলক। রাজধানী শেরে বাংলা নগর পেরিয়ে মোহাম্মদপুরের প্রবেশদ্বারে রয়েছে একটি বিশাল তোরণ, যা ‘আসাদ গেট’ নামে পরিচিত। ‘আসাদ গেট’ নামটি শোনেননি বর্তমান প্রজন্মের কাছে এমন মানুষ পাওয়া দুর্লভ। কিন্তু তাদের অনেকেই জানেন না শহীদ আসাদ কে? কেনই বা এ গেটটির নামকরণ করা হলো তার নামে। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক শহীদ আসাদের এ বছরই ৫০তম শহীদ দিবস।

আসাদের জন্ম ১৯৪২ সালের ১০ জুন নরসিংদী জেলার শিবপুর গ্রামে। আসাদের কর্মজীবনের ইতিহাস খুব দীর্ঘ নয়। আসাদুজ্জামান আসাদ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) ঢাকা হল শাখার সভাপতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান সংগঠক। ১৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার সমাবেশ থেকে এগারো দফার বাস্তবায়ন এবং ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশ ও ইপিআর বাহিনীর নির্যাতন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্রতা লঙ্ঘনের প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি এক ধর্মঘট আহ্বান করে। ২০ জানুয়ারি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই ধর্মঘট পালনের কথা জানানো হয়।

এ ধর্মঘট মোকাবেলার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। চুয়াল্লিশ ধারা জারি সত্ত্বেও বিভিন্ন কলেজের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হয় এবং বেলা ১২টার দিকে বটতলায় এক সংক্ষিপ্ত সভা শেষে প্রায় দশ হাজার ছাত্রের একটি বিশাল মিছিল ১৪৪ ধারা ভেঙে রাজপথে পা বাড়ায়। মিছিলটি চানখাঁর পুলের কাছে তখনকার পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে এর ওপর পুলিশ হামলা চালায়। প্রায় ঘণ্টাখানেক সংঘর্ষ চলার পর আসাদসহ কয়েকজন ছাত্রনেতা মিছিলটিকে ঢাকা হলের পাশ দিয়ে শহরের কেন্দ্রস্থলের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। ঠিক তখন একজন পুলিশ কর্মকর্তা খুব কাছ থেকে রিভলবারের গুলি ছুড়ে আসাদকে হত্যা করে। তার মৃত্যু ঊনসত্তরের ছাত্র গণআন্দোলনের গোটা অবয়বকেই পাল্টে দেয় এবং তা তৎকালীন আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী ও নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়।

 

আসাদের মৃত্যুতে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি গোটা পূর্ব পাকিস্তানে তিন দিনব্যাপী শোক ঘোষণা করে। এছাড়া কমিটি ঢাকা শহরে হরতাল এবং পরবর্তী চার দিন প্রতিবাদ মিছিলসহ নানা কর্মসূচি পালন করে। ২৪ তারিখে আবার হরতালে গুলি চললে ঢাকার পরিস্থিতি গভর্নর মোনেম খানের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সরকারের এই দমননীতি জনতাকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি এবং শেষাবধি ১৯৬৯-এর গণআন্দোলনেই প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের পতন ঘটে। তৎকালীন পাকিস্তানের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম, তার পথ ধরে ঘটে গণঅভ্যুত্থান।

পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি শাসকগোষ্ঠীর বঞ্চনা ও শোষণ কমিয়ে উন্নয়ন দেখানোর উদ্দেশ্যে ঢাকায় জাতীয় সংসদ ভবনকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপনে আইয়ুব অ্যাভিনিউ ও আইয়ুব গেট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শাসক লৌহমানব আইয়ুবের পতন ঘটলে ‘আইয়ুব অ্যাভিনিউ’ রূপান্তরিত হয় ‘আসাদ অ্যাভিনিউ’তে এবং ‘আইয়ুব গেট’ ‘আসাদ গেট’ হিসেবে পরিণত হয়।

সামরিক ও স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বুলেটে প্রাণ দিতে হয়েছিল আসাদুজ্জামান আসাদকে। এই মৃত্যু বাংলার জনগণের হূদয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছে গণআন্দোলনের প্রথম শহীদ হিসেবে। শীতের শেষে নতুন বছরের আমেজ লাগানো এ দেশের মাটিতে মেঘমুক্ত নীল আকাশ থেকে অকস্মাৎ বাজ পড়ার মতোই অভাবনীয় ছিল আসাদের মৃত্যু। বাংলাদেশের কবিশ্রেষ্ঠ খ্যাত শামসুর রাহমান ‘আসাদের শার্ট’ কবিতায় লিখেছেন ‘মৃত আসাদ বাঙালি জীবনে প্রেরণার উৎস’।

আসাদ কেবল একজন ছাত্র সংগঠকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন ঐকান্তিক কৃষক সংগঠকও। অত্যন্ত সংগ্রামী মানসিকতার অধিকারী আসাদ ‘জনগণতন্ত্র’কে মনে করতেন মুক্তির মন্ত্র। আদর্শের প্রতি অটল বিশ্বাস, ধৈর্য, বিপদকে সহজভাবে গ্রহণ করার সাহস ছিল তার মধ্যে। শুধু ছাত্র সংগঠন অথবা গণশিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যেই আসাদের রাজনৈতিক চিন্তা ও তৎপরতা সীমিত ছিল না। সার্বভৌম ও শ্রেণি শোষণমুক্ত একটি দেশ গড়ার স্বপ্ন ছিল তার। ২০ জানুয়ারি আসাদের জীবনদানের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল ঐতিহাসিক ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। আসাদের রক্তে ঢাকার রাজপথ ভিজেছিল। সারা দেশের জনগণ ক্ষিপ্ত হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জন করেছে স্বাধীনতা। আর সে কারণেই অজস্র, অসংখ্য শহীদের মধ্যেও আসাদ অনন্য এক শহীদের নাম। আজ প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের স্বাধীনতার মূল্যবোধে উজ্জীবিত হয়ে শপথ নেওয়ার, যেন শহীদ আসাদসহ সব শহীদের স্বপ্ন ও আদর্শ প্রতিষ্ঠায় আমরা পিছপা না হই। আসাদের স্মৃতি ধরে রাখতে আসাদ গেটের সংস্কার ও শ্রীবৃদ্ধিসহ শহীদ আসাদের প্রতিকৃতি, তার জীবন সংগ্রামের তথ্য-ইতিহাস সংরক্ষণ জরুরি। আজ আপামর জনসাধারণের এ দাবি সর্বজনীন।

মৃত্যুর মাঝে যারা জীবনের সন্ধান পায়, তারা মৃত্যুকে বরণ করেও অমর হয়ে থাকেন। তাদের বিয়োগ ব্যথার কাহিনী ভবিষ্যৎ জাতির পক্ষে দীপশিখা হয়ে সামনে চলার পথ দেখায়। এমনই এক বীর সৈনিক ছিলেন শহীদ আসাদ, ছিলেন নির্ভীক ও স্বাধীনতাপ্রিয়। নিপীড়িত, বঞ্চিত, লাঞ্ছিত বাঙালি জাতির দীপ্ত আলোর মুক্ত আজাদী সংগ্রামের এক পথপ্রদর্শক ও স্বপ্নদ্রষ্টার নাম শহীদ আসাদ।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

jewelwriter53@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads