• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

দুর্নীতির চাকা থেমে যাক এবার

  • মো. মাঈন উদ্দিন
  • প্রকাশিত ২২ জানুয়ারি ২০১৯

‘চ্যাম্পিয়ন’ কথাটি শুনলে সবার মন চঞ্চল হয়ে ওঠে আনন্দচিত্তে। চোখগুলো টলমল করে ওঠে খুশিতে। শিরদাঁড়া বেয়ে উঠে আসে আনন্দধারা। কিন্তু সব চ্যাম্পিয়নই কিন্তু সবসময় আনন্দের ধারক ও বাহক নয়। সব চ্যাম্পিয়নের মধ্যে গৌরব মিশে থাকে না; থাকে না অহমিকাও। কিছু কিছু চ্যাম্পিয়নের সঙ্গে গৌরব নয়, মিশে থাকে একরাশ গ্লানি, হতাশা, অধঃপতন, অবনমন। এরকম একটি চ্যাম্পিয়নের নাম দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন। কথাটি ভালো শোনা যাক আর না যাক, আমরা কিন্তু দুর্নীতিতে কয়েকবার চ্যাম্পিয়ন। অর্থাৎ অপ্রিয় হলেও সত্য যে, আমরা দুর্নীতির মতো ঘৃণ্য শব্দটিতে সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। যা একটি জাতি, একটি দেশের জন্য হতাশা ও নিরানন্দের বিষয় নিঃসন্দেহে। আমরা উন্নয়নের পথে তিন পা এগুলে এই সর্বনাশা ও আত্মঘাতী দুর্নীতি আমাদের দুই পা পেছনে টানে। আমরা ইতোমধ্যে উন্নয়নশীল দেশের সীমারেখা স্পর্শ করতে শুরু করেছি কিন্তু দুর্নীতির করাল গ্রাস থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে এই উন্নয়নশীল দেশের সীমারেখা স্পর্শ করা যাবে কিনা কিংবা উন্নয়নশীল তকমা কতটা ধরে রাখা যাবে সময়ই তা বলে দেবে। বাকি আমি যে বিষয়টি বলতে চাচ্ছি, তাহলো যে করেই হোক, দুর্নীতির ভয়াল থাবা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতেই হবে। দুমড়ে-মুচড়ে দিতে হবে দুর্নীতির আখড়া। বিষদাঁত উপড়ে ফেলতে হবে দুর্নীতিবাজদের। তাহলেই উন্নয়নশীল দেশের স্বাদ, গন্ধ, রূপ, রস ভোগের অধিকারী হতে পারব আমরা। কারণ জানেন তো, মুকুট অর্জনের চেয়ে মুকুট রক্ষা করা কঠিন।

এখন কোটি টাকার প্রশ্ন হলো, দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে দুর্নীতির তরল প্রবাহ প্রবাহিত হচ্ছে, এটা কী করে দূর করা সম্ভব! দুর্নীতিবাজদের রক্ত কীভাবে শোধন করা যাবে। আমরা একটি প্রবাদ জানি তা হলো, ‘হয়্যার দেয়ার ইজ উইল, দেয়ার ইজ এ ওয়ে’, যার বাংলা অর্থ হচ্ছে ‘ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়’। আর এই ইচ্ছাটা হতে হবে একশ ভাগ সৎ। এই ইচ্ছাটা থাকতে হবে সরকারের নীতিনির্ধারকদের। তাহলে দুর্নীতি মূলোৎপাটন হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। হ্যাঁ দুর্নীতি দূর করার জন্য বহু পন্থা গ্রহণ করা যায়। আমি এখানে দুটি দিকের কথা উল্লেখ করতে চাই। একটি হলো দুর্নীতিগ্রস্ত রক্ত পরিশোধনে ওষুধ প্রয়োগ করা। অর্থাৎ দুর্নীতিবাজদের শনাক্ত করে তাদের মন-মননের পরিশোধন করা। তাদের কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে বোঝানো যে দুর্নীতি কতটা ভয়াবহ। আমরা সাধারণত সরকারি অফিস-আদালতে ব্যাপক দুর্নীতির কথা ওপেন সিক্রেটের মতোই জানি। এসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান মোটামুটি চিহ্নিত। যদি আমরা এই কিছু ব্যক্তির মন-মানসিকতার পরিবর্তনে সক্ষম হই, তাহলেই দুর্নীতি ক্রমান্বয়ে কমে যাবে। যদি এই থেরাপি কাজ না করে, তাহলে ওই দুর্নীতিগ্রস্তদের আইনের আওতায় আনতে হবে। ধরে নিতে হবে তাদের রক্ত কলুষিত হয়ে গেছে। এই কলুষিত রক্ত যার শরীরেই যাবে, তাকেই দুর্নীতির নেশা মোহগ্রস্ত করে ফেলবে। সুতরাং এই কলুষিত রক্ত চুষে নিতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগই এখানে কার্যকর।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে— আমরা দেখছি সারা দেশে বর্তমানে মাদকবিরোধী অভিযান চলছে। আমরা আশা করছি, এই অভিযানে মাদকের ব্যবহার শেষ হয়ে যাবে যদি প্রশাসন এই অভিযান দীর্ঘমেয়াদি করতে পারে বা অভিযানে ক্লান্তি না আসে। তেমনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে এমন একটি অভিযান পরিচালনা করা সময়ের দাবি। কারণ দুর্নীতি একদিকে যেমন আমাদের উন্নয়নশীলতাকে ব্যাহত করছে, তেমনি এই দুর্নীতির করাল গ্রাসে মধ্যবিত্ত এমনকি মধ্যবিত্ত থেকে তৃণমূল পর্যায়ের সহজ-সরল মানুষগুলোর আজ দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। তবে একটি কথা দিবালোকের মতো সত্যি, তাহলো মাদকের সঙ্গে জড়িত চুনোপুটির সাথে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ানো যে পরিমাণ রাঘববোয়াল রয়েছে; তেমনি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত চুনোপুটির সাথে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ানো রাঘববোয়ালের সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি। সুতরাং কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে যে পরিমাণ বিষধর সাপ বেরিয়ে আসবে, এদের বিষদাঁত ভেঙে দিতে হবে। কিন্তু এ কাজটি মোটেই সহজ নয়। তবে আশার কথা, কিছুদিন আগে ভূমিমন্ত্রী ভূমি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব চেয়ে তিনি এই ইঙ্গিতই দিচ্ছেন যে, তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে মরণপ্রাণ-যুুদ্ধে নামতে প্রস্তুত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আজকাল যে কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠান দুর্নীতির শীর্ষে, তার মধ্যে অন্যতম এই ভূমি মন্ত্রণালয় বা দেশের বিভিন্ন ভূমি অফিস। সবচেয়ে বড় কথা, বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা দিয়েছেন। এখন দেখার বিষয় কথার সঙ্গে কাজ কতদূর এগোয়।

যে কোনো ধরনের দুর্নীতি বাহ্যিকভাবে ব্যক্তির উন্নয়ন ঘটাতে পারলেও, সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নের অগ্রগতিকে বিঘ্নিত করে। তা ছাড়া এর মাধ্যমে অর্জিত ব্যক্তির উন্নয়নও আপেক্ষিক। কেননা দুর্নীতিগ্রস্ত একটি দেশ যখন সামগ্রিক উন্নয়ন থেকে পিছিয়ে পড়ে, তখন ব্যক্তি-উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হয়। কিছুদিন আগে এমন মতই প্রকাশ করেছেন দুদক চেয়ারম্যান। তিনি বলেছেন, ‘দুর্নীতিই মানুষের মুক্তির প্রধান অন্তরায়।’ তিনি আরো বলেন, সবার আইন মেনে চলা উচিত। কেউ আমাদের আইন মানাবে, সেজন্য অপেক্ষায় থাকা সমীচীন নয়। কারণ আইন না মানাই দুর্নীতি। বার্লিনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)-এর প্রকাশিত বিশ্বজুড়ে দুর্নীতির ধারণাসূচক (সিপিআই)-এর ভিত্তিতে বিগত কয়েক বছর ধরেই দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম উঠে এসেছে। প্রথমত সরকারি কাজে আর্থিক দুর্নীতি এবং দ্বিতীয়ত ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে দুর্নীতি আমাদের এখানে প্রকট আকার ধারণ করেছে। গত বছর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে তেমনটাই দেখা গেছে।

বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় অপরাধ প্রবণতার অন্যতম একটি চিত্র হলো ‘ঘুষ’ বা ‘উৎকোচ’। এটি এখন মারাত্মক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। এ কথা আজ ওপেন সিক্রেট— অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ যে কোনো নাগরিক সেবা পেতে হলে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঘুষ বা উৎকোচ দিতে হয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) জরিপে দেখা গেছে, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন ধরনের সনদ, সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচির বিভিন্ন সেবা, বিচার ও সালিশ, কর সংগ্রহ, বিভিন্ন ধরনের লাইসেন্স গ্রহণ— এ ধরনের নানাবিধ সেবা পাওয়ার জন্যে নাগরিকদের বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়মের শিকার হতে হয়।

দুর্নীতি নামক সংস্কৃতি দ্বারা মারাত্মক আকারে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ ও সমাজ। এ অবস্থায় সরকার, সকল সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সুশীল সমাজ, সমাজবিজ্ঞানী, সচেতন মানুষ— সবাইকে এর নির্মূলে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, মানুষের মুক্তির বড় অন্তরায় হচ্ছে দুর্নীতি। দুর্নীতি দমন কিংবা প্রতিরোধ করা গেলেই কাঙ্ক্ষিত মুক্তি সম্ভব হবে। ২০৪১ সালে উন্নত বিশ্বে বাংলাদেশকে দেখতে হলে উল্লেখিত এসব দুর্নীতি ও অনিয়ম দূর করে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রগঠনের বিকল্প নেই। আমরা আশা করি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাঁড়াশি ও বহুমুখী অভিযান চলবে এবং এ দেশ এগিয়ে যাবে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে। আর যদি দুর্নীতি তার ভাবগাম্ভীর্য অনুযায়ী চলতেই থাকে, তাহলে উন্নয়নশীলতার রাস্তা দেখার যে অসীম বাসনা আমাদের, তা হয়তো কালো দিগন্তে বিলীন হতে পারে, যা আমার কেউ-ই চাই না।

 

লেখক : প্রশাসনিক কর্মকর্তা

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads