• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

উষ্ণায়ন মোকাবেলার যুদ্ধে জয়ী হতে হবে

  • সাধন সরকার
  • প্রকাশিত ২৪ জানুয়ারি ২০১৯

জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে পুরো বিশ্ব ওয়াকিবহাল। জলবায়ুর প্রভাবে উন্নয়নশীল ও উপকূলীয় গরিব দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলেও উন্নত দেশসমূহ এখনো এ বিষয়ে একমত হয়ে যূথবদ্ধ ও টেকসই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না। পোল্যান্ডের কাতোভিচে সম্প্রতি (ডিসেম্বর মাসে) জলবায়ু সম্মেলন ‘কপ-২৪’ অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের শুরুর দিকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অস্পষ্টতা থাকলেও অবশেষে ‘প্যারিস চুক্তি’ বাস্তবায়নে প্রস্তাবিত নীতিমালার ব্যাপারে একমত হয়েছে সম্মেলনে যোগ দেওয়া দেশগুলো। গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন, নজরদারি এবং নিঃসরণের হার কমিয়ে আনতে পরিকল্পনা হালনাগাদসহ বিভিন্ন বিষয়ে একমত হওয়া এ সম্মেলনের সবচেয়ে বড় অর্জন। তবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ২০১৫ সালের ‘প্যারিস চুক্তি’ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নেতিবাচক দিক হলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্যারিস চুক্তি থেকে নিজের দেশকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘোষণা এবং জলবায়ুর ঝুঁকিতে থাকা দরিদ্র দেশগুলোকে প্রতিশ্রুত বার্ষিক ১০ হাজার কোটি ডলারের তহবিলের ব্যাপারে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা না থাকা। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘বৈশ্বিক উষ্ণায়ন মোকাবেলার যুদ্ধ এখন জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।’ ধারণা করা হচ্ছে,  বৈশ্বিক তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার লক্ষ্য থেকে বিশ্ব এখন অনেক দূরে। কার্বন নিঃসরণের বর্তমান হার অব্যাহত থাকলে চলতি শতাব্দী শেষে বিশ্বের তাপমাত্রা তিন ডিগ্রির কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে। বাস্তবিক অর্থে তাপমাত্রা বৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে সীমিত রাখতে হলে সমাজের সর্বস্তরে দ্রুত ও অভাবনীয় পরিবর্তন আনতে হবে। কিন্তু সে উদ্যোগ গ্রহণ করতে বিশ্ব সম্প্রদায় কি প্রস্তুত? সম্প্রতি ফ্রান্সে ‘ইয়েলো ভেস্ট’ নামের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। মূলত ফ্রান্স সরকার জীবাশ্ম জ্বালানি পরিহার করে জৈব জ্বালানি ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ তথা কর বাড়ানোর ফলে এই আন্দোলনের সূত্রপাত। তবে যা-ই বলা হোক না কেন, অতিমাত্রায় কার্বন নিঃসরণকারী উন্নত দেশগুলো যদি এখনই জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় ব্যবস্থা গ্রহণ না করে, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জলবায়ুর প্রভাবজনিত মারাত্মক বিপদ থেকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়বে।

মানবজাতির কল্যাণে একটি সুন্দর প্রকৃতিবান্ধব পরিবেশ অপরিহার্য। আজকের এবং আগামীকালের জন্য সেই পরিবেশ নিশ্চিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব। নিজেদের স্বার্থের জন্য আমরা যেন প্রাকৃতিক পরিবেশকে এমন জায়গায় ঠেলে না দিই, যেখান থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বিপর্যয় থেকে আর বের হয়ে আসতে পারবে না। আগের সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দ্রুতগতিতে উষ্ণ হচ্ছে সমুদ্র। ধারণা করা হচ্ছে, মনুষ্যসৃষ্ট গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গত করার মধ্য দিয়ে যতটুকু উষ্ণতা তৈরি হয়, তার ৯০ শতাংশের বেশি বিশ্বের সমুদ্রগুলো শুষে নেয়। এতে করে আরো শক্তিশালী রূপে হাজির হচ্ছে হারিকেন ও টাইফুন। উত্তর গোলার্ধের প্রায় ২৫ ভাগ এলাকা আদিকাল থেকে বরফে ঢাকা। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বাড়তে থাকলে বরফে ঢাকা অঞ্চলগুলোয় বরফ গলার হার আরো বেড়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হয়ে পড়েছে। বন্যপ্রাণীসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখির আবাসস্থল ও খাদ্যের অভাব দেখা দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের মতো গরিব দেশগুলোর অর্থনীতি ও সার্বিক জীবনযাত্রার ওপর চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। 

বিশ্ব এখন জলবায়ু পরিবর্তন পরিস্থিতির নতুন এক যুগে প্রবেশ করেছে। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) হিসাবমতে, শিল্প বিপ্লবের আগে বায়ুমণ্ডলে প্রতি ১০ লাখে ২৭৮ কণা কার্বন ডাই-অক্সাইড ছিল। কিন্তু এখন ১০ লাখে তা বেড়ে হয়েছে ৪০০ কণা। বলা হচ্ছে, মানব কর্মকাণ্ড প্রাকৃতিক ভারসাম্য বদলে দিয়েছে। প্রশ্ন হলো, শিল্পায়ন ও উন্নয়নের ফলে বিশ্বের ধনী দেশগুলো ব্যাপক হারে কার্বন নিঃসরণ করার ফলে কেন গরিব উপকূলীয় দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে? সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। দেশে দেশে মিঠাপানির সঙ্কট দেখা দেবে। খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। সামুদ্রিক প্রাণী ও সামগ্রিক জীববৈচিত্র্য বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার হুমকি সৃষ্টি হবে। ফলে পরিবেশের বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে সামগ্রিক প্রতিবেশ ব্যবস্থার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তঃসরকার সংস্থা ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল ফর ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) অন্য এক গবেষণায় বলা হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বাড়লে বাংলাদেশের প্রায় ১৭ ভাগ উপকূলীয় স্থলভূমি পানিতে তলিয়ে যাবে। ফলে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ জলবায়ু-উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। সীমিত সম্পদ ও বিপুল জনসংখ্যাবহুল বাংলাদেশে জলবায়ু-উদ্বাস্তুরা সবকিছু হারিয়ে বাড়তি সমস্যা তৈরি করবে। কাজের সন্ধানে শহরে এসে ভিড় জমাবে। তাই কার্বন নিঃসরণকারী উন্নত রাষ্ট্রগুলোকে এক কাতারে এসে দায় নিয়ে ‘প্যারিস চুক্তি’র শর্ত মেনে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণে জোর দিতে হবে। বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বকে কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে। নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে প্রতিটি দেশকে অগ্রসর হতে হবে। জাতিসংঘ প্রণীত ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ বা এসডিজির ১৩নং লক্ষ্য হলো ‘জলবায়ুবিষয়ক পদক্ষেপ’। এ লক্ষ্য অর্জনে কার্বন নিঃসরণকারী ধনী দেশগুলোর অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সমগ্র বিশ্ব আশা করে যুক্তরাষ্ট্র তার ভুল পথ বা প্রত্যাহারের ঘোষণা থেকে সরে এসে প্যারিস চুক্তি মেনে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে সবার সহযোগিতায় একটি বাসযোগ্য সবুজ পৃথিবী গড়ে তুলবে।

 

লেখক : সাবেক ছাত্র, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads