• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

সড়কে মৃত্যুর মিছিল

  • অনলাইন ডেস্ক
  • প্রকাশিত ২৫ জানুয়ারি ২০১৯

সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিনিয়ত মৃত্যুর বেদনাদায়ক খবর ছোটবেলার পতঙ্গনাশী অবোধ দুঃখস্মৃতিকেই মনে করিয়ে দেয়। পাপপুণ্যির হিসাব কষতে অপটু দুরন্ত দলের সদস্য হিসেবে ফড়িংয়ের পিছু ছুটতাম প্রাণহরণকারী দানবের মতো। পাখনাওয়ালা ফড়িংয়ের পেছনে ধেয়ে যেতে যেতে একপর্যায়ে লেজ চাপড়ে ধরে ফেললে শুরু হতো পতঙ্গটির দম বের করা খামখেয়ালিপনার মহরত। শেষ পর্যন্ত ফড়িংরূপী পতঙ্গের আত্মাটি যখন একেবারে ডানা মেলার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলত, তখন মুণ্ডু-লেজ-পাখা ছিঁড়ে তার জীবনের ইতি ঘটিয়ে সবাই হৈ-হুল্লোড়ে আনন্দ উদযাপন করতাম। খেলার ছলে শিশু-কিশোররা এভাবে অসংখ্য ফড়িংয়ের জীবন কবজ করলেও সবার কাছে এগুলো নিছক রঙ-তামাশা হিসেবেই বিবেচিত ছিল। সড়কে অস্বাভাবিক মৃত্যুর দুর্ঘটনার চিত্র শৈশবকালীন পতঙ্গ হত্যার রঙ-তামাশা পর্যায়ে পৌঁছেছে বলেই প্রতীয়মান হয়। একটি পতঙ্গ হত্যা করা নিঃসন্দেহে পাপ- এমন ভাবনাটি যেমন ছিল না শিশুবয়সে, তেমনি সড়কে চলাচলকারী যানের বেপরোয়া চালকশ্রেণি দুর্ঘটনার নামে মানুষ খুনের মর্মান্তিক বিষয়টি নিয়েও তেমন মাথা ঘামাচ্ছে না। সড়কে মড়ক সৃষ্টিকারী বেহিসেবি চালকের গ্রাহ্যহীন গতি বন্ধ করার মতো এ দেশে কোনো আইনি শক্তি আছে কি-না সন্দেহ রয়েছে।

সড়ক দুর্ঘটনার হূদয়স্পর্শী সংবাদ যেন সংবাদপত্রের নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অস্বাভাবিক মৃত্যুর এই অলক্ষুণে খবর দিয়েই দিন শুরু করেন সংব াদপত্রের অগণিত পাঠক। গেল কয়েকদিনের দুর্ঘটনাকবলিত মৃত্যুর ধারাবাহিকতা তেমন ইঙ্গিতই দিয়ে গেছে। গত ১৫ জানুয়ারি ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে বরযাত্রীবাহী মাইক্রোবাস গাছে ধাক্কা খেয়ে ৫ জনসহ তিন স্থানে ঝরেছে আরো ৪ প্রাণ। ১৬ জানুয়ারি চট্টগ্রামের কোতোয়ালি মোড়ে রাস্তা পারাপারের সময় কভার্ডভ্যানের চাপায় সরকারি সিটি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক বাণিজ্য বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী সোমা বড়ুয়ার মর্মান্তিক মৃত্যু কাঁদিয়েছে সবাইকে। এছাড়া ১৮ জানুয়ারির খবর অনুযায়ী সড়কে প্রাণ হারিয়েছেন ২১ জন। আগের দিনের সন্ধ্যা পর্যন্ত দেশের ১৫ স্থানে এসব দুর্ঘটনা ঘটে। আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক ব্যক্তি। ১৯ জানুয়ারির খবরে ১১ জনের প্রাণ বিসর্জিত হয়েছে বলে জানা যায়। এতে আহত হয়েছেন ১৭ জন। ২০ জানুয়ারির খবরে বলা হয়, কুমিল্লায় পৃথক ৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া দেশের ১২ জেলায় প্রাণ গেছে আরো ১৫ জনের। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত অর্ধশত। হাইওয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা বলছেন, পথচারী ও চালকদের অসতর্কতার কারণে এসব দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।

স্বজনহারা এই পরিবারগুলোই শুধু বুঝতে পারছে আপনজন হারানোর বেদনা কতটা কষ্টকর। সড়কে অস্বাভাবিক মৃত্যুর এ ভারি বেদনা আজীবন বয়ে বেড়াবে প্রতিটি পরিবার-পরিজন। কারণ মৃত্যুপথযাত্রী এদের অধিকাংশই হয়তো পরিবারের উপার্জনক্ষম একমাত্র ব্যক্তি। যাদের অভাব কখনো কোনো কিছুর বিনিময়ে পূরণ হওয়ার নয়। যাদের জন্য সড়কে আজ এমন অস্বাভাবিক মৃত্যুর মিছিল, তাদের থামানোর সাহস-শক্তি কারো আছে বলে মনে হয় না। তাই উৎকণ্ঠিত মনে প্রশ্ন জাগে, সড়কে কি এভাবে মরণদশা চলতেই থাকবে?

এই চালকশ্রেণি সড়কে দুর্ঘটনার নামে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেও প্রতিবার পার পেয়ে যাচ্ছে। মানুষ খুনের গুরুতর অপরাধ থেকে মুক্তি পাওয়া এ গোষ্ঠী সময়ে সময়ে সহিংস হয়ে উঠছে। রাষ্ট্রযন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলেছে তারা। গত বছরের ২৯ জুলাই রাজধানীর কুর্মিটোলায় দুই কলেজশিক্ষার্থী বাসচাপায় মারা যাওয়ার পর সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে দেশজুড়ে ছাত্র আন্দোলন শুরু হলে সর্বাত্মক যৌক্তিকতা আঁচ করতে পেরে সরকারও এতে সমর্থন দিয়ে তাদের দাবি মেনে নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখায়। ছাত্রছাত্রীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ৮ বছর ঝুলে থাকার পর গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর সংসদ অধিবেশনে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ পাস করে সরকার। এই আইনে বেপরোয়াভাবে বা অবহেলা করে গাড়ি চালানোয় দুর্ঘটনায় কেউ গুরুতর আহত হলে বা কারো প্রাণহানি হলে চালকের সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা অনুযায়ী চালক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটালে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এর বিরোধিতা করে গত অক্টোবরে চালকশ্রেণি ধর্মঘটের নামে দেশের সড়কগুলোতে চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির জন্ম দেয়। তখন চালক-হেল্পার পরিবহন ধর্মঘটের নামে কালিমা লেপনের যে অযাচিত মহড়া দেখিয়েছে, তাতে মনে হয় রাষ্ট্র এদের কাছে অনেকটা জিম্মি। তাদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে যেসব চালক গাড়ি চালিয়েছে কিংবা যাত্রীসাধারণ যারা সে গাড়িতে চড়েছে, তাদের মুখে পোড়া মবিল লাগিয়ে এই অপ্রতিরোধ্য শ্রেণি শুধু মন্দ নজিরই সৃষ্টি করেনি, তারা দেশব্যাপী দেখিয়েছে রাষ্ট্র কতটা অসহায় তাদের কাছে।

দুর্ঘটনার দুর্বিষহ বাস্তবতা স্বজনহারা মানুষকে ব্যাপক নাড়া দিয়ে গেলেও চালকশ্রেণি থেকে যায় নির্ভার। যেন কারো কিছু করার নেই। চালকরা কতখানি বেপরোয়া তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৫ জানুয়ারি রাজধানীর সড়কে শৃঙ্খলা আনতে গুলিস্তানে বেলুন উড়িয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ট্রাফিক পুলিশের ১৫ দিনের অভিযান উদ্বোধন করার দিনটিতেই। তখন সেখানে ও আশপাশের সড়কে সতর্ক ট্রাফিক পুলিশের সামনেও বেপরোয়া ছিল পরিবহন চালকরা। অভিযানের মধ্যে প্রথম দিনে ‘বাস স্টপেজে’ বাস থামেনি, থেমেছে আগে-পিছে। পথচারীরা ইচ্ছেমতো দৌড়ে রাস্তা পার হয়েছে। মোটরসাইকেল চালানো হয়েছে ফুটপাতের ওপর দিয়ে। খবরের কাগজে পুরো রাজধানী শহরের এমন আশঙ্কাজনক বিষয়গুলোই উঠে এসেছে। এই যখন অবস্থা, তখন যাত্রী ও চালক— সবাইকে আইন মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে। এ জন্য সরকারের কঠিন তদারকি প্রয়োজন।

গবেষণায় দেখা গেছে, ভারী লাইসেন্স নেই কিংবা থাকলেও তা নেওয়া হয়েছে সব শর্ত পূরণ না করে— এমন চালকের কারণে প্রায়ই বাস-ট্রাক দুর্ঘটনা ঘটছে। এ থেকে উত্তরণে যখন আইনকানুন আরো কঠোর করার দাবি উঠেছে, তখন উল্টো পরিবহন নেতাদের চাপের মুখে কর্তৃপক্ষ গত ২৬ ডিসেম্বর থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার প্রচলিত আইনের শর্ত শিথিল করেছে। যদি কোনো গোষ্ঠীর বৃহত্তর স্বার্থে সজ্ঞানে-সুস্থির বুদ্ধিতে সড়কে মানুষ মারার লাইসেন্স স্বাক্ষর করে চালকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়, তাহলে যা হওয়ার তা-ই হবে। এর দায়ভার নিশ্চিতভাবেই সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার ওপর গিয়ে পড়বে। সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করেই কাউকে গাড়ি চালানোর বৈধতা দেওয়া উচিত। নইলে থামানো যাবে না সড়কে অস্বাভাবিক মৃত্যুর গতি।

সড়ক দুর্ঘটনা নামক অঘটন চাকার মরণগতি রোধে প্রশিক্ষিত দক্ষ চালক, নিয়ন্ত্রিত গাড়ি চালনা, প্রশস্ত সুস্থ সড়ক ব্যবস্থাপনা, নির্ধারিত কর্মঘণ্টা নিয়ন্ত্রণ, চালকের নেশাহীন মানসিকতা নিশ্চিতকরণ, ঝুঁকিপূর্ণ সড়কে সাবধানতা অবলম্বন, অন্যকে টেক্কা দেওয়ার হীন প্রচেষ্টা থেকে নিজেকে রক্ষা করা, ফোন ব্যবহারে সতর্ক হওয়া, সবার আগে ট্রাফিক আইন মেনে চলা, অতিরিক্ত যাত্রী বহন থেকে বিরত থাকতে হবে। এছাড়া ছোট-বড় সব যানের চলাচল সক্ষমতা অর্থাৎ ফিটনেস সতর্কতাসহ সুস্থ যাত্রা নিশ্চিতে যেসব বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া জরুরি, সেগুলো ধরে রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলে হয়তো সড়ক দুর্ঘটনার মতো মরণঘাতী যন্ত্রণা অনেকাংশে কমে আসবে। পাশাপাশি পথচারী ও যাত্রীসাধারণকেও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে নিজের অবস্থান থেকে সহযোগিতা করতে হবে। তবে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সবার আগে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকেই কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। সময় যত যাবে, সঙ্কটের যন্ত্রণা তত বেগবান হবে। এ থেকে উত্তরণে এখনই কাজ শুরু করা দরকার।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক

bishwa85@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads