• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
আমি চাইলেই এমপি হতে পারি না

জাতীয় সংসদ

ছবি : সংরক্ষিত

মতামত

আমি চাইলেই এমপি হতে পারি না

  • রেহানা বেগম রানু
  • প্রকাশিত ২৫ জানুয়ারি ২০১৯

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শুরু হয় সংরক্ষিত আসনে এমপি মনোনয়নের তোড়জোড়, আলোচনা। চট্টগ্রামে সংরক্ষিত আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী এবং এমপি হওয়ার দৌড়ে আমার নাম এবং ছবি দিয়েই শুরু হতো সংবাদ পরিবেশন। চট্টগ্রামের মানুষেরও আগ্রহ, কৌতূহলের কমতি ছিল না। আমিই সর্বত্র আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। আলোচনা ছিল চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা মহিলা লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক চেমন আরা তৈয়বকে নিয়েও। অবশ্য তার দৌড়ঝাঁপও ছিল চোখে পড়ার মতো। চেমন আপা আমাকে প্রায়ই ফোন দিতেন। বলতেন, রানু আপনার কী খবর? আপনি তো এমপি হয়ে যাবেন। বলতাম, আমার জন্য দোয়া করবেন। আপনাকেও দোয়া করছি। 

একসময় ভাবলাম, শুধু আলোচনায় থাকলেই হবে না। সম্ভাব্য স্থানে একটু যাওয়া উচিত, বলা উচিত। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আতাউর রহমান খান কায়সার এবং তার স্ত্রী আমাকে মেয়ে ডাকতেন। এই দম্পতির সঙ্গে আমার সন্তান-অভিভাবকের সম্পর্ক। রাজনীতিতেও তারা আমার অভিভাবক, পথপ্রদর্শক। কায়সার আঙ্কেলের সঙ্গে এমপির বিষয়টা তুলতেই বললেন, তোমার বিষয়টা দেখার দায়িত্ব আমার। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো বলেই আমার কাছ থেকে একটা সিভি নিলেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছানোর জন্য। তিনি দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। নেত্রীর কাছের মানুষ। তিনি যদি চান নেত্রী ফেলতে পারবেন না। আঙ্কেল দায়িত্ব নিয়ে বলার পর আমি অনেকটা নির্ভার। ফলে আর কোনো নেতার কাছে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করলাম না। প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুভাইও আমাকে স্নেহ করেন। কিন্তু কায়সার আঙ্কেলের সঙ্গে আমার পিতা-কন্যার সম্পর্ক। আর মৃদু বৈরিতা কায়সার আঙ্কেল ও বাবুভাইয়ের মধ্যে। আমি কায়সার আঙ্কেলের প্রার্থী এটা জানার পর বাবুভাই যদি বিষয়টা ভালোভাবে না নেন! সে শঙ্কায় আমি দলের গুরুত্বপূর্ণ এই নেতার শরণাপন্ন হলাম না। তবে তৎকালীন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী ডা. আফছারুল আমীন আমাকে গাইডলাইন দিয়েছেন। দিয়েছিলেন ডিও লেটার। একবার চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে তৎকালীন পরিবেশ ও বন প্রতিমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে দেখা করি। গিয়ে দেখি তৎকালীন চট্টগ্রাম মহানগর পিপি অ্যাডভোকেট কামাল উদ্দিন, আরো কয়েকজন ল’ইয়ার, রাজনৈতিক কর্মী বসে আছেন। হাছান ভাই আমার কথা শুনলেন। তারপর বললেন, সংরক্ষিত আসনের এমপি মনোনয়নের বিষয়টি এখন অনেকটা চূড়ান্ত। এ মুহূর্তে তেমন কিছু করার সুযোগ নেই। পরবর্তী সময়ে সুযোগ হলে দেখব।’ তবু আশায় বুক বেঁধে আছি। কায়সার আঙ্কেলের সঙ্গে কথা হলে বলেন, তোমারটা আমি দেখছি, চিন্তার কিছু নেই। কারণ তুমি এটা ডিজার্ভ কর। যাহোক, নবম সংসদের সংরক্ষিত আসনের এমপি ঘোষণা হয়ে গেল। ফাইনালি আমি নাই। এমপি হয়ে গেলেন চেমন আরা তৈয়ব। ভাবছি কায়সার আঙ্কেল তাহলে কী করলেন!

সংরক্ষিত আসনের এমপি ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করা হলো নবম সংসদের মাঝপর্যায়ে। আরো ৫ জন এমপি মনোনয়ন দেওয়া হবে। নেতৃস্থানীয় সবার পরামর্শ ও সহযোগিতায় এবার অনেকটা এগিয়ে গেলাম। বিশেষ দিবসগুলোতে বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রে আমি নিয়মিত অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতাম। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসি কার্যকরের বিষয়ে টিভিতে আমার এবারকার অনুষ্ঠানের অতিথি তৎকালীন পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু এবং বেসামরিক বিমান  চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। অনুষ্ঠান শেষে দুজনকে আমার দ্বিতীয় সংস্করণের দুটি বই ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ গিফট করলাম। ফাঁকে আমার এমপির জন্য চেষ্টা করছি বলে তাদের দোয়া ও সহযোগিতা চাইলাম। বাবুভাই বললেন, অসুবিধা নেই। তুমি আমাকে একটা সিভি দিয়ে রেখো। এরপর একদিন মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক রেজাউল করিম চৌধুরী, আমার ভগ্নিপতি আওয়ামী লীগ নেতা মুক্তিযোদ্ধা আবদুল নূর দুজনই জানালেন, তারা বাবুভাইয়ের সঙ্গে আমার বিষয়ে কথা বলেছেন। বাবুভাই আমাকে বলেছেন নিয়ে যেতে। রেজাউল ভাই, আমার ভগ্নিপতিসহ বাবুভাইয়ের বাসায় গেলাম। বাবুভাই বললেন, তুমি আগে আসনি কেন। ভেবেছিলাম কায়সার আঙ্কেল আমার জন্য চেষ্টা করছেন জানলে আপনি আর আগাবেন না। এ কথার পর বাবুভাই বললেন, এটা কোনো কথা নয়। তুমি দলের অ্যাকটিভ কর্মী। তোমাকে সবার সহযোগিতা করা দরকার। সিভিটা দিয়ে চলে এলাম।

আফছার ভাই (ডা. আফছারুল আমীন) আবারো ডিও দিলেন। বললেন, তোমাকে আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে যাব। আফছার ভাইয়ের কথামতো একদিন সংসদে গেলাম। সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরীর কক্ষে নিয়ে গিয়ে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন আফছার ভাই। তাকেও একটা সিভি দিয়ে আমাকে দোয়া করতে বললাম। আফছার ভাই আমাকে খ্যাতনামা চিকিৎসক প্রাণ গোপাল দত্তের কাছেও নিয়ে গিয়েছিলেন। তাকেও সিভি দিয়ে এসেছিলাম। সিভি দিয়ে এসেছিলাম আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদকে। আমু ভাই বললেন, তুমি ডিজার্ভ করো। তিনি আশ্বস্ত করলেন। সেই সঙ্গে জানালেন, চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে দিয়ে একটা ফোন করানো যায় কিনা। বললাম, চট্টগ্রামে আমরা গ্রুপিংয়ের রাজনীতির শিকার। আফছার ভাই, নাছির ভাই (বর্তমান মেয়র), নুরুল ইসলাম বিএসসি সাহেবদের বলয়ে থাকার কারণে মহিউদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে একটু দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। অবশ্য এ দূরত্ব কমিশনার হিসেবে সিটি করপোরেশনের অধিকার আদায়ের জায়গা থেকে সৃষ্ট। সে কারণে উনি আমার জন্য হয়তো ফোন নাও করতে পারেন। বিএসসি সাহেবও আমাকে ডিও দিতে চেয়েছিলেন এমপির জন্য। কিন্তু তার কাছ থেকে পরে আর নেওয়া হয়নি। বাবুভাই যেহেতু সিরিয়াস, মনে করলাম ডিও বাড়িয়ে লাভ নেই। হলে এভাবেই হয়ে যাবে।

অবশ্য ড. হাছান মাহমুদের ধানমন্ডির সরকারি বাসভবনে দ্বিতীয়বার চেষ্টার সময়ও দেখা করতে গিয়েছিলাম। ওয়েল গ্রুপের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরু ভাইয়ের (সৈয়দ নুরুল ইসলাম) সহযোগিতায় দেখা করার পর হাছান ভাই ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পীসহ কয়েকজনের নাম সিরিয়ালে আছে জানিয়ে বললেন, এবার একটু কঠিন হবে। কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর সঙ্গেও দেখা করেছিলাম তার মন্ত্রণালয়ে। প্রয়াত বখতেয়ার আঙ্কেল (বখতেয়ার নূর সিদ্দিকী) ফোনে কথা বলে আমাকে পাঠিয়েছিলেন। তিনিও আমার একটা সিভি গ্রহণ করেন। কিন্তু সব ছাপিয়ে বাবুভাইয়ের আন্তরিকতা আমার এমপি হওয়ার সুখবর বয়ে আনে।

 

একদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ আমার মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এপিএস সাইফুজ্জামান শেখর ভাইয়ের ফোন নম্বর। নম্বরটি আমার সেটে আগে থেকেই ইনস্টল ছিল। ফোনটা ধরতেই শেখর ভাইয়ের অভিনন্দন। অভিনন্দন কেন জানতে চাইলে বললেন, আপনি এমপি হয়ে গেছেন। প্রধানমন্ত্রী ৫ জনের তালিকায় আপনাকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। বাবুভাইসহ চট্টগ্রামের নেতারা আপনার পক্ষে। কয়েকদিনের মধ্যে ঘোষণা হয়ে যাবে। এরপর বাবুভাইয়ের পিএ মুরাদের ফোন। মুরাদ শোনালেন আসল কাহিনী। সংসদ ভবন কার্যালয়ে দেখা করে বাবুভাই আমার সিভি প্রধানমন্ত্রীর হাতে পৌঁছে দিয়েছেন। চার মাস আগে টিভি কেন্দ্রে দেওয়া আমার বইটি (নারীর ক্ষমতায়ন) সযত্নে সংরক্ষণ করে বাবুভাই প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দিয়েছেন শুনে আমি বিস্মিত, অভিভূত। এত আন্তরিক, কর্মীবান্ধব বাবুভাই! প্রধানমন্ত্রী সময় নিয়ে আমার সিভি দেখেছেন এবং এমপির জন্য আমার নাম লিখে নিয়েছেন- জানালেন মুরাদ।

এবার বাবুভাইকে সরাসরি ফোন দিই। ফোন ধরে বাবুভাই উচ্ছ্বাস নিয়ে সুখবরটা জানালেন। বললেন, কয়েকদিনের মধ্যে ঘোষণাটা হয়ে যাক, এখন কাউকে বলার দরকার নেই। এবার সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষা। ঘোষণাটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। ঘোষণা হবে-ঠিক সেই মুহূর্তে ঘটে গেল মানিকগঞ্জে এক মর্মন্তুদ সড়ক দুর্ঘটনা। নিহত হলেন জাতির মেধাবী দুই সন্তান-এটিএন নিউজের সিইও মিশুক মনীর ও বিশিষ্ট চলচ্চিত্রনির্মাতা তারিক মাসুদ। পিছিয়ে গেল নতুন ৫ এমপির নাম ঘোষণা। কিছুদিন পর ফোনে কথা হচ্ছিল বাবুভাইয়ের সঙ্গে। তিনি কিছুটা শঙ্কিত। বললেন, তোমার জায়গায় হাসিনা মান্নান (ডা. এম এ মান্নানের স্ত্রী) নাম ঢোকানোর জন্য একটি গ্রুপ তৎপর হয়ে উঠেছে। তিনি আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, চিন্তা করো না। তোমার ভাগ্যে থাকলে অবশ্যই হবে। যদি না হয় তবে মনে রেখো, তোমার মতো কর্মীর মূল্যায়ন একদিন না একদিন হবে। শেষপর্যন্ত বাবুভাইয়ের শঙ্কাটা সত্য হলো। ৫ এমপির ঘোষিত তালিকায় আমি নেই। ঢুকে গেছেন হাসিনা মান্নান। আল্লাহর ইচ্ছা এবং নেত্রীর সিদ্ধান্তের ওপর কোনো কথা নেই। এমপি হতে পারিনি, তাতে দুঃখ নেই। ’৯০-এর গণআন্দোলনের মিছিল থেকে তিল তিল করে উঠে আসা আওয়ামী লীগের এক তৃণমূল কর্মী। সেই পরিচয়ে মরতে চাই। বলে রাখি, ২০১৪ সালে দশম সংসদের সংরক্ষিত আসনের জন্যও ফরম নিয়েছিলাম। কিন্তু দৌড়ঝাঁপ তেমন করিনি। এবার এমপি হলেন কায়সার আঙ্কেলের মেয়ে ওয়াশিকা আয়েশা খান এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক কমিশনার সাবিহা নাহার বেগম (সাবিহা মুসা)।

একাদশ সংসদ নির্বাচনে অবিস্মরণীয় বিজয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। মন্ত্রিসভা গঠন হলো। শুরু হলো সংরক্ষিত আসনে এমপি নির্বাচনের তোড়জোড়। সেই থেকে প্রতিদিনই দলীয় নেতাকর্মী, শুভানুধ্যায়ী, খেটে খাওয়া মানুষ এবং যারা আমাকে তিনবার সিটি করপোরেশন কাউন্সিলর বানিয়েছেন সেই মানুষগুলো প্রতিদিন টেলিফোনে, সাক্ষাতে আমার কাছে প্রত্যাশার ডালা নিয়ে হাজির হন। বলেন, আপা আপনাকে এবার সংসদে দেখতে চাই। তাদের বলি, আমি চাইলেই এমপি হতে পারি না। এটি সম্পূর্ণ নেত্রীর ইচ্ছা। শুভানুধ্যায়ীরা বলেন, প্রধানমন্ত্রী এবার তৃণমূল নেতাদের নিয়ে যেভাবে মন্ত্রিসভা গঠন করে দেশের মানুষকে চমকে দিলেন, সংরক্ষিত আসনের এমপি নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তিনি চমক দেখাবেন।

 

লেখক : নারী নেত্রী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads