• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
কুষ্ঠমুক্ত দেশ গড়া অসম্ভব নয়

কুষ্ঠ রোগ

সংরক্ষিত ছবি

মতামত

কুষ্ঠমুক্ত দেশ গড়া অসম্ভব নয়

  • মো. সাজেদুল ইসলাম
  • প্রকাশিত ২৭ জানুয়ারি ২০১৯

প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের শেষ রোববার বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এ বছর জানুয়ারি মাসের ২৭ তারিখ অর্থাৎ আজ দিবসটি উদযাপিত হবে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য স্থানে কুষ্ঠরোগের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে এই দিবস পালন করা হয়। এই দিবসের উদ্দেশ্য হলো কুষ্ঠ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা এবং এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সাহায্য করা। জনবিচ্ছিন্ন কুষ্ঠ আক্রান্ত ব্যক্তিদের সমাজে পুনঃগ্রহণ, সর্বপ্রকার কুষ্ঠজনিত কুসংস্কার দূরীকরণ, এই সকল লক্ষ্য সামনে নিয়ে জনসাধারণ এবং কুষ্ঠ আক্রান্ত ব্যক্তিদের সঠিক তথ্য ও শিক্ষা প্রদান করাই হচ্ছে এই দিবসের লক্ষ্য। এ বছর এই দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘বৈষম্য ও কুসংস্কার দূর করা’।

জেনেভাভিত্তিক কুষ্ঠবিরোধী সংগঠনগুলোর আন্তর্জাতিক ফেডারেশন ‘আইলেপ’, যা ১৩টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত, এই দিবসটি পালনে উদ্যোগ নেয়। আইলেপের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রাউল ফোলেরো বিশ্বব্যাপী কুষ্ঠরোগবিষয়ক ব্যাপক সচেতনতা বৃদ্ধিকল্পে ও কুষ্ঠরোগের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ১৯৫৩ সালে দিবসটি উদযাপনের জন্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কুষ্ঠ মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন রোগ। মানবসভ্যতার বিকাশ ও সামাজিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে উন্নত দেশগুলোতে এই রোগের প্রাদুর্ভাব একেবারেই কমে এসেছে। কিন্তু আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কুষ্ঠরোগের প্রাদুর্ভাব এখনো রয়ে গেছে। বর্তমানে বাংলাদেশসহ ব্রাজিল, ভারত, নেপাল, মোজাম্বিক, এঙ্গোলা, কঙ্গো ও তানজানিয়ায় কুষ্ঠরোগাক্রান্ত ব্যক্তিরা শনাক্ত হচ্ছে।

বাংলাদেশে কুষ্ঠরোগের চিকিৎসা বিনামূল্যে করা হলেও এবং নিয়মিত চিকিৎসায় সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য রোগ হওয়া সত্ত্বেও এখনো রোগটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। দ্য লেপ্রসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল-বাংলাদেশ (টিএলএমআই-বি) এর মতে, প্রতি বছর প্রায় ৪ হাজার নতুন কুষ্ঠরোগাক্রান্ত ব্যক্তি বাংলাদেশে শনাক্ত হচ্ছে।

কুষ্ঠ সাধারণত চিকিৎসাবিহীন সংক্রামক ধরনের রোগীর হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ায় এবং আক্রান্ত রোগীর প্রান্তিক স্নায়ুর কার্যকারিতা নষ্ট করে। ফলে আঙুল বাঁকা হওয়া, মুখের প্যারালাইসিস, বেদনাহীন ঘা ইত্যাদি বিকলাঙ্গতা দেখা দেয় এবং রোগীর শারীরিক সমস্যার চেয়েও মানসিক ও সামাজিক সমস্যা এবং বৈষম্য প্রকটরূপে দেখা দেয়। চামড়ার অবশ দাগ দিয়ে এই রোগ শুরু হয়, অনেক সময় দানাগুটিও দেখা দেয়।

চিকিৎসকদের মতে, কুষ্ঠরোগ একটি মৃদু সংক্রামক রোগ। দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতার অধিকারী মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়। দরিদ্রতা, অপুষ্টি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস, প্রচুর আলো-বাতাসের অভাব ইত্যাদি এই রোগ সংক্রমণের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়। ১৮৭৩ সালে নরওয়ের চিকিৎসাবিজ্ঞানী ডা. আরমার হ্যানসেন কুষ্ঠরোগের জীবাণু ‘মাইকোব্যাকটেরিয়াম লেপ্রি’ আবিষ্কার করেন। এই আবিষ্কারের ফলে প্রমাণিত হয় যে, কুষ্ঠ একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ, জন্মগত, বংশগত বা অভিশাপের ফল নয়। হাজার হাজার বছর ধরে কুষ্ঠরোগ ও কুষ্ঠরোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের অভিশপ্ত এবং অস্পৃশ্য বলে গণ্য করা হতো এবং অনেককেই দ্বীপান্তরিত, বনবাস, গৃহচ্যুত করা হতো। সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কগুলো শিথিল হয়ে যেত। হাজার হাজার কুষ্ঠরোগাক্রান্ত মানুষ মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হতো।

বিশ্ব কুষ্ঠ দিবসের উদ্দেশ্য হলো, এসব রোগীকে অভয় দেওয়ার মাধ্যমে চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসা। বাংলাদেশে কুষ্ঠ নির্মূলের ক্ষেত্রে বেশকিছু সমস্যা রয়েছে। সরকারিভাবে কম গুরুত্ব দেওয়ার কারণে এ খাতে বাজেট প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম, বাজেট স্বল্পতার কারণে কুষ্ঠবিরোধী কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে রোগী খুঁজে বের করার জন্য প্রশিক্ষিত লোকবলের অভাব, এই রোগকে ঘিরে কুসংস্কার দূরীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় সচেতনতামূলক কার্যক্রমের অভাব আছে। চিকিৎসকদের কুষ্ঠ বিষয়ে ধারণা কম থাকায় রোগী চিহ্নিত করা ও চিকিৎসা কাজ ব্যাহত হয়, দেশের সর্বত্র চিকিৎসা সুবিধা সমানভাবে প্রাপ্তিসাধ্য নয় এবং দেশে কুষ্ঠের কারণে বিকলাঙ্গদের পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধার অভাব। কুষ্ঠবিষয়ক প্রায় ৮০ ভাগ স্বাস্থ্যসেবা এনজিও কর্তৃক পরিচালিত হাসপাতালগুলো দিয়ে থাকে। কিন্তু আর্থিক সমস্যার কারণে তাদের এই সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে সরকার এগিয়ে না এলে সমস্যা বাড়বে। অধিকারকর্মীরা মনে করেন, কুষ্ঠের চিকিৎসা একীভূত ব্যবস্থার মাধ্যমে দিলে ভালো ফল আশা করা যেতে পারে।

কুষ্ঠ নির্মূলের জন্য কৌশলগত পরিকল্পনা ২০১৬-২০২০ পুরোপুরি বাস্তবায়িত হওয়া উচিত বলে অধিকারকর্মীরা মনে করেন। ওই পরিকল্পনায় কুষ্ঠ ও এর জটিলতা দূর করা, বৈষম্য দূর করা ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তিকে উৎসাহিত করা, সময়মতো রোগী শনাক্তকরণে গুরুত্ব দেওয়া, একীভূত চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু করা এবং পর্যাপ্ত সম্পদের নিশ্চয়তা দেওয়া প্রভৃতি বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

তাছাড়া কুষ্ঠ বিষয়ে গণমাধ্যমের ইতিবাচক বার্তা প্রচার এই রোগ নির্মূল কার্যক্রমকে গতিশীল করতে পারে। আমাদের একযোগে অসহায়, দরিদ্র, নিপীড়িত কুষ্ঠরোগাক্রান্ত মানুষগুলোর জন্য কাজ করতে হবে। কারণ এতগুলো মানুষকে বঞ্চিত রেখে সার্বিকভাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমাদের জাতীয় সংবিধান প্রতিটি নাগরিকের সমান সুবিধা নিশ্চিত করে। তাই কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়। কুষ্ঠরোগাক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো আমাদের সবার নাগরিক ও সামাজিক কর্তব্য।

কুষ্ঠ আমাদের জাতীয় দুর্ভোগের কারণ। এর কারণে বিপুলসংখ্যক মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। আসুন, আক্রান্ত ব্যক্তিদের সামাজিক অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাই একত্রে কাজ করি এবং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে একটি কুষ্ঠমুক্ত দেশ হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে প্রতিষ্ঠা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হই।

 

লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

sissabuj@yahoo.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads