• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

মতামত

জলবায়ু ঝুঁকি ও নারীর প্রতি বৈষম্য

  • মোহাম্মদ অংকন
  • প্রকাশিত ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বর্তমানে বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সমস্যাগুলো বিশ্বব্যাপী আলোচনার মূল বিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এই আলোচনার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের অবস্থান চোখে পড়ার মতো। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলোর ওপর বেশ কয়েকটি গবেষণা বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর অন্যতম হিসেবে চিহ্নিত করেছে। প্রায় প্রতি বছর বাংলাদেশ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়। কখনো বন্যা, কখনো ঘূর্ণিঝড়, কখনো ভূমিকম্প তীব্রভাবে আঘাত হানে। কখনো চরম তাপমাত্রায় এবং খরাসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয়। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে অবকাঠামোগত ক্ষতির শিকার হতে হয়, যা জীবন ও জীবিকার ওপর প্রতিকূল প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ঘূর্ণিঝড় ও বন্যাপ্রবণ দেশ। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রতিকূল প্রতিক্রিয়াগুলোর জন্য চরম নাগরিক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। কারণ এ দেশের অধিকাংশ প্রাথমিক জীবিকার সুযোগ পরিবেশগত অবস্থা এবং প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর ওপর নির্ভরশীল।

তবে কিছু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক এবং বিদ্যমান লিঙ্গবৈষম্যের কারণে নারী-পুরুষ উভয়ই বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। তাদের দুর্বলতায় নারী-পুরুষ বৈষম্য শক্তিশালী হয় এবং দুর্যোগ মোকাবেলার ক্ষমতা হ্রাস পায়। বাংলাদেশে বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে লিঙ্গবৈষম্যের কারণে নারীরা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। দরিদ্র নারীরা যে কোনো বিপর্যয়ে মারাত্মক আঘাত পায়। বাংলাদেশে শেষ কয়েকটি বিপর্যয়ে দেখা গেছে পুরুষদের তুলনায় নারীর মৃত্যুহার প্রায় পাঁচগুণ বেশি। নারী ও মেয়েশিশুদের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার পর্যাপ্ত ধারণা নেই। তারা তথ্য সেবা থেকে প্রায় ক্ষেত্রেই বঞ্চিত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সম্পদের ক্ষেত্রে তারা চরমভাবে বৈষম্যের শিকার। এসব বৈষম্য শুধু দুর্যোগের সময় নয়, যে কোনো সময় তাদের জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করে এবং তাদের জীবন সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।

আমরা প্রায়ই দেখি, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় শুধু পুরুষদের সচেতন করা হয়। তাদের সচেতনতার বিষয়গুলো পরিবারের নারীদের বলতে বলা হয়। কিন্তু তারা খুব কমই পরিবারকে সেসব তথ্য জানায়। আমরা জানি, বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীদের বৃহৎ অংশ স্বামী বা বাবার অনুমতি ছাড়া বাড়ির বাইরে যেতে পারে না। বিষয়টি গ্রামাঞ্চলে প্রবল। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে অনেক শিশু ও মেয়ে মারা যায়। এটা স্পষ্ট যে, সামাজিক বিধিনিষেধের ফলে মহিলাদের দুর্যোগের ঘটনায় নিজেদের উদ্ধার করার জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতার কমতি রয়েছে। দেশে এখনো এমন সমাজ রয়েছে, যে সমাজ মনে করে একটি সম্প্রদায়ের নারীদের ভূমিকা বাড়িতে বসবাস করা। তাদের দায়িত্ব শুধু ঘরে। পরিবারের সদস্যদের যত্ন নেওয়া, খাদ্য তৈরি করা এবং বয়স্ক ও অন্যান্যের যত্ন নেওয়া। এসব কারণে বিপর্যয়ে সতর্কতার বিষয়ে নারীরা সবসময় পিছিয়ে।

দুর্যোগ-পরবর্তী ও দুর্যোগ-পুনরুদ্ধার পরবর্তী পর্যায়ে নারীদের আরো বেশি লিঙ্গভিত্তিক ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হয়। বাংলাদেশের শেষ কয়েকটি বিপর্যয়ে বিষয়টি তীব্রভাবে উঠে এসেছে। দেখা গেছে, বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র ঠিকই করা হয়েছে; কিন্তু এসব স্থানে নারীদের নিরাপত্তার জন্য কিছুই করা সম্ভব হয়নি। ফলে নারী ও কিশোরীরা যৌন এবং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার শিকার হয়েছে। যার মধ্যে শারীরিক ও মানসিক সহিংসতা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া দুর্যোগের প্রভাবগুলো লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা ও গার্হস্থ্য সহিংসতার ঘটনা বাড়িয়ে তোলে। ফলে তাদের জোরপূর্বক অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া হয়। তার মানে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে বাংলাদেশে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর জন্য শেষ পর্যন্ত নারীদের ওপর অতিরিক্ত ভার যুক্ত করা হয়।

জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, উন্নয়নশীল বা উন্নত দেশগুলোর মধ্যে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে নারীদের মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি থাকে। যদি তারা বেঁচে থাকে, তবে তারা পুরুষের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গত এক দশকে জলবায়ু পরিবর্তনে নারী-পুরুষকে সচেতন করা নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। এর কুপ্রভাবগুলো নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হারিয়ে গেছে। বাংলাদেশে লিঙ্গপদ্ধতি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক সেগুলোর মধ্যে একটি। সুতরাং নারীদের ওপর প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব নিয়ে বিশদ পর্যালোচনা জরুরি। এ বিষয়ে নারীর প্রতি বৈষম্য কখনোই কাম্য নয়। এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক বা বিরোধিতা অহেতুক। লিঙ্গবৈষম্য কাটিয়ে দুর্যোগ থেকে রেহাই পেতে সকল নারী, প্রতিবন্ধী নারী এবং বয়স্ক নারী- সেই সঙ্গে কিশোরী মেয়েদের আরো বেশি মনোযোগ আকর্ষণ প্রয়োজন।

বাংলাদেশ সরকার জলবায়ু উন্নয়ন এবং অভিযোজন ব্যবস্থা আরো অগ্রসর করার জন্য ২০০৯ সালে কর্মপরিকল্পনা হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল প্রণয়ন করে এবং জাতীয় অভিযোজন কর্মসূচি তৈরি করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের উদ্যোগগুলো লিঙ্গ সংবেদনশীল নয়। নারী তাদের চাহিদা এবং মতামত প্রকাশ করার সামান্য সুযোগ পায় মাত্র। জলবায়ু সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অংশগ্রহণের সংখ্যা খুবই কম। দুর্যোগ মোকাবেলা বিষয়ক টক শো, গোলটেবিল বৈঠকে নারীর অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। অতএব এটা স্পষ্ট যে, দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস বা স্থিতিস্থাপকতা বিষয়ক পরিকল্পনায় নারীদের পর্যাপ্তভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না।

আবার এটিও নির্দেশ করে যে, বিপর্যয় সংঘটিত হওয়ার সময় প্রতিক্রিয়া ও পুনর্নির্মাণের প্রচেষ্টায় নারীদের নির্দিষ্ট দুর্বলতা এবং প্রয়োজনগুলো উপেক্ষা করা হয়। অতএব নারীদের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো অনুসন্ধান করা উচিত। দুর্বলতা হ্রাসের লক্ষ্যে প্রত্যেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এটি নারীদের দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস পরিকল্পনার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ বিবেচনা করা উচিত। লিঙ্গবৈষম্য ও সামাজিক কুদৃষ্টি পরিহার করে দুর্যোগ মোকাবেলা বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিতে হবে। দুর্যোগের সময় নারী বলে পিছিয়ে থাকা যাবে না, এমন মানসিকতা তৈরি করতে হবে। নারী ও পুরুষ সম্মিলিতভাবে কাজ করলে জলবায়ু ঝুঁকি হ্রাস করা অসম্ভব কিছু নয়।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads