• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

শ্রম শোষণ বন্ধ হোক

  • মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ
  • প্রকাশিত ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

প্রতিটি ভালো নিরবচ্ছিন্ন ভালো নয়। এর সঙ্গে কিছু মন্দও থাকে। অর্থনীতির বাছ-বিচারে শ্রম বিভাগ জরুরি। মানবিকতার বিচারে তা মানুষে মানুষে বিভাজন ও শ্রেণিবৈষম্য সৃষ্টিকারী। অনুরূপভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রে মানুষের নিরাপত্তার জন্য জরুরি হলেও এই সমাজ ও রাষ্ট্র যাদের দ্বারা পরিচালিত হয় তাদের দ্বারাই মানুষ শোষিত, নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত। এসব কারণে আমরা সভ্যতা বিকাশের একপর্যায়ে এসে দেখতে পাই গরু-ছাগলের বেচাকেনার হাটের মতো আদম সন্তানের বেচাকেনার হাট বসতে। ক্রীতদাস মানব-মানবী উভয়কেই সময়ের বিচারে চব্বিশ ঘণ্টা আর জীবনের বিচারে আমৃত্যু প্রস্তুত থাকতে হতো মালিকের সেবা, মনোরঞ্জনের জন্য। খাদ্য, তা পেত এতটুকু যা না হলে বেঁচে থাকা যায় না।

কৃষিকাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের অবস্থাও ঠিক একই রূপ। কৃষিকাজ এমনিতেই শ্রমনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থা। এতে প্রচুর শ্রম বিনিয়োগ করতে হয়। খোলা আকাশের নিচে বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে কৃষি শ্রমিকদের কাজ করতে হয়। শুধু দিনেরবেলা নয়, রাতেও তাদের শ্রম ব্যয় করতে হয়। সুতরাং কৃষিকাজে নির্ধারিত কোনো সময় নেই। কাজের নির্ধারিত সময় না থাকলেও মজুরি সবসময় নির্ধারিত। তাও কোনোরকম বেঁচে থাকার মতো। প্রকৃতির দয়া-মায়ার ওপর কৃষিকর্ম নির্ভরশীল থাকায় বছরের সবসময় কৃষিকাজ চলত না। তার উপর কোনো সময় বন্যা বা খরা দেখা দিত, তখন এই অবস্থা আরো প্রকট আকার ধারণ করত। মজুরির হার আরো নিচে নেমে যেত। হাজার হাজার কৃষি শ্রমিক কাজের অভাবে, খাদ্যের অভাবে উপোস থেকে অপুষ্টিতে ভুগে মারা যেত। মহামারী দেখা দিত। কৃষিকাজ সরাসরি কৃষি শ্রমিকদের হাতে না থাকায় তারা সবসময় ভূস্বামীদের হাতে বন্দি ছিল। ছিল তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার দাস। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কৃষি শ্রমিকদের অবস্থা ক্রীতদাসের মতো ছিল।

এরপর এলো শিল্প বিকাশের যুগ। মানুষ ও পশুশক্তির বদলে যন্ত্রশক্তির ব্যবহার শিখল। উৎপাদনের প্যাটার্ন পাল্টে গেল। ভোগের সামগ্রীর বিস্তৃতি ঘটল। যন্ত্র ব্যবহার করে একসঙ্গে অনেক পণ্য উৎপাদন হতে শুরু হলো। নতুন নতুন যন্ত্র ও উৎপাদন কৌশল আবিষ্কৃত হতে থাকল। তথাকথিত এই শিল্প বিপ্লবের ফলে উৎপাদন ও ভোগের মাত্রাতিরিক্ত উন্নতি হলেও শ্রমজীবী মেশিনম্যান তথা সাধারণ শ্রমিকদের অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। কাজের সময়সীমাও অনির্ধারিত রয়ে গেল। উদয়-অস্ত মেশিন চালিয়ে কাজ করেও রেহাই পেত না তারা। এই অমানুষিক পরিশ্রমের ফলে যক্ষ্মাসহ বিভিন্ন অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হয়ে নিঃশেষ হয়ে গেলেও কাজের নিষ্কৃতি ছিল না এতটুকুও। মজুরির হারও ছিল তথৈবচ, কোনোরকম মাথা গোঁজার জন্য। এভাবে চলতে লাগল নতুন ধারায় নতুন কৌশলে শ্রম শোষণ। একসময় শ্রমিকরা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৮৮৬ সালের পহেলা মে গুলি হলো শান্তিপূর্ণ মিছিলে। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন অনেক শ্রমিক। নিহত হলেন অনেকেই। শ্রমিকদের এই মহান আত্মত্যাগের কারণে পহেলা মে-কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য পরবর্তীকালে এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গেও প্রতি বছর পালিত হচ্ছে সারা বিশ্বে।

সফল শিল্প বিপ্লবের পর সভ্যতা এখন স্যাটেলাইট ও তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এসে উপনীত হয়েছে। রিমোট কম্পিউটার দ্বারা এখন সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। বিশ্ব আজ দুভাগে বিভক্ত। যারা শিল্প বিপ্লবকে সফলভাবে কাজে লাগাতে পেরেছে, তারা উন্নত বিশ্ব হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। আর যারা তা পারেনি তারা অনুন্নত দেশ নামে অভিহিত। এতকিছুর পরও শ্রম শোষণ বন্ধ হয়নি। গরিব দেশগুলো আগের মতোই রয়েছে। তবে উন্নত দেশগুলো এখন আর আগের মতো শ্রম শোষণ করতে পারে না। তাই তারা গরিব রাষ্ট্র থেকে শ্রমিক নিয়ে নতুন করে শোষণ চালাতে থাকে। কেমন যেন দাসপ্রথার মতো শ্রমিক আমদানি রফতানি হচ্ছে। সঙ্গে চলছে অমানবিক মানসিক নির্যাতন আর অসহনীয় যন্ত্রণাদায়ক নিপীড়ন। অনেক সময় তাদের কাজের সময়ও থাকে অনির্ধারিত।

কেবল যে মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে শ্রমিকরা শোষিত হচ্ছে, তা নয়। ওভারটাইম এবং প্রতারণার মাধ্যমেও তারা শোষিত হচ্ছে। মানুষ কোনো মেশিন নয়। মেশিনও অত্যধিক ব্যবহারে গরম হয়, ক্ষয় হয়, অবশেষে অচল হয়ে পড়ে। ওভারটাইমের লোভ দেখিয়ে একজন শ্রমিককে দিয়ে নির্ধারিত সময়ের অতিরিক্ত সময় কাজ করিয়ে অল্পদিনেই তার জীবনীশক্তি নিঃশেষ করে দেওয়া হয়। আর এ কাজটি করা হয় অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে। নির্দিষ্ট সময়ের মজুরি এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়, যা দিয়ে শ্রমিক তার সংসার চালাতে পারে না। তখন সে বাধ্য হয় ওভারটাইম কাজ করতে। বিনোদন মানুষের ছয়টি মৌলিক চাহিদার একটি। খাদ্য-বস্ত্রের মতো বিনোদন ছাড়াও মানুষ বাঁচতে পারে না। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) কর্তৃকও তা স্বীকৃত। সুতরাং একজন শ্রমিকের বিশ্রাম ও বিনোদনের সময় কমানোও আরেকটি শ্রম শোষণ।

সময়মতো মজুরি না দেওয়াও একধরনের শ্রম শোষণ। দেখা যাচ্ছে, এ কাজটি অহরহ ঘটছে। অনেকটা ইচ্ছাকৃতভাবেই বিভিন্ন অজুহাতে এই কাজটি করা হয়। করা হয় এই কারণে যে, পরবর্তী সময়ে পুরো মজুরি মেরে দেওয়ার সুযোগ থাকে এবং করাও হয় তা-ই। কাজ শেষ হয়ে গেলে প্রতারণা বা শক্তির আশ্রয় নিয়ে গোটা মজুরি মেরে দেওয়া হয়। এটা শ্রম শোষণের আরেকটি কলঙ্কজনক দিক। এই কাজটি যারা করে, তারা প্রাথমিক পর্যায়ে মজুরি নির্ধারণ করে তুলনামূলক একটু বেশি। আর বেশি পাওয়ার আশায় শ্রমিকরা বাকিতেও কাজ করে যায়।

আদি থেকে আজ অবধি পৃথিবীতে যত শোষণ-নির্যাতন হয়েছে, তার সিংহভাগই শ্রম শোষণ। অথচ আল্লাহতায়ালা শ্রমিকের প্রাপ্য না দেওয়াকে পাপ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কেননা রসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা বলেন, কিয়ামত দিবসে আমি তিন লোকের বিরুদ্ধে বাদী হব- ১. যে লোক আমার নামে অঙ্গীকার করে পরে তা ভঙ্গ করেছে। ২. যে লোক স্বাধীন মানুষকে বিক্রি করে তার মূল্য খেয়েছে। ৩. যে লোক শ্রমিক নিয়োগ করে পূর্ণ কাজ আদায় করে নিয়েছে কিন্তু তার প্রাপ্য মজুরি প্রদান করেনি (বুখারি : ২২২৮)। আসলে শ্রম শোষণের মূল কারণ হচ্ছে অতিরিক্ত ভোগস্পৃহা। অপরের সেবা গ্রহণের প্রবণতা এবং স্বল্প সময়ে ধনী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থেও এই শোষণ ও নির্যাতনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

 

লেখক : শিক্ষক, রসুলপুর জামিয়া ইসলামিয়া, ঢাকা

ahmadabdullah7860@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads