• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯
অধিকারবঞ্চিত পথশিশু

পথশিশু

মতামত

অধিকারবঞ্চিত পথশিশু

  • অধ্যাপক ডা. এসএমএ এরফান
  • প্রকাশিত ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

মানবশিশু জন্মলগ্ন থেকেই সৌন্দর্যপিপাসু। অজস্র মৌলিক জ্ঞানগুণের এক বিশাল সুবিন্যাস মানবশিশুর মাঝে। আর এই সুবিন্যাসের মাঝেই গোছানো আছে পৃথিবীর সব সৌন্দর্য, ভবিষ্যৎ। তবে বহুকাল থেকে তৃণমূল যেন এখনো পরাধীন, এখনো কাঁদছে ক্ষুধার্ত, বস্ত্রহীন, বসতহীন, শিক্ষাহীন, চিকিৎসাহীন ও পিতা-মাতাহীন পৃথিবীর সৌন্দর্য মানব পথশিশুরা। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই তারা অবহেলা, অনাদর, বঞ্চনা, লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছে। বাবার কোলে অপার স্নেহ, মায়ের শাড়ির আঁচলে মুখ লুকানো স্বর্গীয় সুখ তাদের কপালে জোটেনি। দারিদ্র্যের সর্বনিম্নে এদের বসবাস। প্রকৃতি এক নির্দয় খেলা খেলছে এদের সঙ্গে। অথচ আমরাই বলে থাকি আজকের শিশুরা আগামীদিনের কর্ণধার, দেশ ও জাতির সোনালি ভবিষ্যৎ। একদিন এরাই এই দেশটাকে পরিচালনা করবে। তাই তাদের বেড়ে ওঠার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল রাষ্ট্রের উন্নয়ন, সমাজ ও পরিবারের সুখ, শান্তি, রাজনৈতিক পরিবর্তনের ধারা। তাহলে কেন বই-খাতা গুটিয়ে শৈশবেই এই অধিকারবঞ্চিত শিশুগুলো করে চলেছে জীবন বাঁচানোর যুদ্ধ? বিশেষ করে ব্যস্ত শহরে প্রভাত হলেই ময়লাযুক্ত ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ছুটছে বাস টার্মিনাল থেকে রেলস্টেশনসহ সব জায়গায়। কাগজ কুড়ানো কিংবা ভিক্ষা করে চলে তাদের জীবন।

রাষ্ট্র ও সমাজের অবহেলা, মানুষের ধিক্কার, চড়-থাপ্পড়সহ গালিগালাজ, এমনকি শারীরিক নির্যাতন সহ্য করতে হয় প্রতিনিয়তই। এক জরিপে দেখা যায়, ৫১ ভাগ শিশু অন্যের গালিগালাজ শোনে এবং ২০ শতাংশ শিশু শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে বড় হয়। যৌন নির্যাতনের শিকার ৪৬ শতাংশ নারী শিশু, সার্বিকভাবে ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ শিশু নানাভাবে নির্যাতনের শিকার। এই শিশুগুলো অনেক সময় ক্ষুধার জ্বালায় বিভিন্ন হোটেলের বাসি-পচা খাবার, এমনকি ডাস্টবিনে ফেলা ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত খাবারও খেয়ে থাকে। নোংরা স্থানে চলাফেরা ও ঘুমানোর কারণে এই অধিকারবঞ্চিত প্রায় ১০ লাখ পথশিশু মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। আরেক জরিপে দেখা যায়, প্রায় ৪০ ভাগ পথশিশু প্রতিদিন গোসল করতে পারে না, আর ৩৫ ভাগ শিশু খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে। রাতে ঘুমানোর জন্য ৪১ ভাগ শিশুর কোনো বিছানা নেই। আমাদের সমাজে ওদের তেমনভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। তবে এসব পথশিশুর ক্ষুধার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কিছু অপরাধী চক্র প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে এদের দ্বারা মাদক বহনসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। একসময় এরা মাদক বহন বা একাধিক কারণে নিজেরাই মাদকাসক্ত হয়। একটি জরিপের তথ্যমতে, প্রায় ৮৫ ভাগ পথশিশু কোনো না কোনো মাদকে আসক্ত। ঢাকা বিভাগের মাদকাসক্ত শিশুর প্রায় ৩০ শতাংশ ছেলে আর ১৭ শতাংশ মেয়ে। তাদের বয়স ১০ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে।

বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্বে একটি উন্নয়নশীল ও সমৃদ্ধিশালী দেশ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। এদেশের শিক্ষা, কৃষি, তৈরি পোশাক শিল্প, বাণিজ্য, মাথাপিছু আয়, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নাগরিক সুবিধা অন্যান্য দেশের তুলনায় এগিয়ে থাকলেও আমরা পথশিশুদের বেলায় তেমন এগুতে পারিনি। এটা সত্য যে, দেশের সরকার পথশিশুর শিশুশ্রম রোধে কাজ করে যাচ্ছে বা বিভিন্নভাবে শিশুদের রক্ষার জন্য অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকে। কষ্টদায়ক যে, তা পথশিশুদের হাত পর্যন্ত পৌঁছায় না। একটি জরিপে দেখা যায়, শতকরা ৮৫ ভাগ শিশু সরকারি বা বেসরকারি সাহায্য-সহযোগিতা পায় না। এই জরিপের সঙ্গে আমি একমত। কেননা আমিও যে শিশুশ্রমের শিকার। আমি মনে করি, শিশুদের জন্য সরকার যে অর্থ প্রতি বছর বাজেট করে, তা যদি আমরা শিশুশ্রমিক বা পথশিশুরা পেতাম, তাহলে এই দেশে একটিও পথশিশু থাকত না। সম্প্রতি যৌন নির্যাতনবিরোধী নীতিমালা বেশ আলোচিত হলেও পথশিশু কিশোরীদের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবছে না। পথে-ঘাটে রাতযাপনের ফলে তারা নানাভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। অথচ সংশ্লিষ্টদের কোনো ভাবনা নেই। পথশিশু বলে আমাদের সমাজ তাদের তেমন মূল্যায়নও করে না। আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক, আমরা চাই নাগরিকত্ব। চাই মৌলিক অধিকার। শিক্ষা চাই, ভিক্ষা নয়।

 

লেখক : শিক্ষার্থী

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads