• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
কালজয়ী সুরস্রষ্টা বুলবুলের চলে যাওয়া

কালজয়ী সুরস্রষ্টা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল

সংরক্ষিত ছবি

মতামত

কালজয়ী সুরস্রষ্টা বুলবুলের চলে যাওয়া

  • বিশ্বজিত রায়
  • প্রকাশিত ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

গত মাসেই চলে গেলেন সঙ্গীত ভুবনের কালজয়ী সুরস্রষ্টা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক, গীতিকার, সুরকার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ২২ জানুয়ারি মঙ্গলবার ভোরে রাজধানীর বাড্ডায় নিজ বাসায় মৃত্যুবরণ করেন। জীবনকর্মের ইতি ঘটিয়ে তিনি পাড়ি জমালেন পরলোকের শাশ্বত ঘরে। আর ফিরবেন না কোটি ভক্তশ্রোতার আনন্দ উদ্বেলিত ময়দানে। সেতারে তুলবেন না মুগ্ধতার সুর, বাঁধবেন না মন মাতানো গান, শোনাবেন না বিচারক আসনের হিয়া উৎফুল্ল কথা, খুলবেন না সম্ভাব্য সঙ্গীতের নব বাতায়ন। শ্রোতাপ্রিয় অজস্র গানের নন্দিত জনক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। সঙ্গীত সাত্ত্বিক এই পুরুষ মানুষকে শুনিয়েছেন প্রেম-ভালোবাসা ও মানবতা মহত্ত্বের হূদয় উতালা গান। দিয়েছেন শুদ্ধ ও সবিস্ময় সঙ্গীতের দীক্ষা। আজ সেই ইহলৌকিক গানের গুণান্বিত গৃহ ছেড়ে তিনি চলে গেলেন চিরবিদায়ী পরলোকে। তার এই প্রস্থান পুরো সঙ্গীতাঙ্গনকে শূন্যতায় ভাসিয়েছে। দিয়ে গেছে বিষাদ বেদনা। গীতিগুণী বুলবুলকে হারিয়ে কাঁদছে সঙ্গীতপ্রিয় সবাই।

জীবনের বিপরীত প্রান্তে চলে যাওয়ার আগে সম্প্রতি নিজের ছবি দিয়ে ফেসবুক ওয়ালে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমাকে যেন ভুলে না যাও... তাই একটা ছবি পোস্ট করে মুখটা মনে করিয়ে দিলাম।’ সঙ্গীতের সুনিপুণ কারিগর আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল হয়তো আঁচ করতে পেরেছিলেন সঙ্গীত সমাপ্তি জীবন শেষের কথাটা। যে ভাবনায় বিখ্যাত সব গানের জন্ম দিয়েছেন তিনি, সেই ভাবনাটা যদি জীবন শেষের গল্পটা রচনা করতে সময় খুঁজে না পায়, তাই অল্প কথায় নিজেকে মনে রাখার সর্বশেষ উক্তি ফেসবুকে তুলে রেখেছিলেন ক্ষণজন্মা এই সঙ্গীতজ্ঞ। যে অবয়ব অজস্র গানের জন্ম দিয়ে প্রেমপিয়াসী উন্মাদ প্রাণে ছড়িয়েছেন সুরের মূর্ছনা, সঙ্গীত-অপ্রিয় মানুষের মনে গেঁথেছেন প্রিয় হয়ে ওঠার তৃপ্তিমাল্য, মানুষকে সঙ্গীতে মেতে ওঠার মোহনীয় মুগ্ধতা বিলিয়ে দেওয়ার উজ্জীবিত রসদ জোগানো শক্তিমান মানুষটিকে কখনো ভোলা যাবে না। তিনি বেঁচে থাকবেন গান, সুর, সঙ্গীতে।

শ্রোতাপ্রিয় বহু গানের রচয়িতা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল গানে গানে বলতে চেয়েছেন জীবনের চরম বাস্তবতার কথা। জীবন-সংক্রান্ত ব্যাকুল ভাবনায় একদিন তিনি লিখেছিলেন, ‘চতুর্দোলায় ঘুমিয়ে আমি ঘুমন্ত এক শিশু।’ যার বাস্তব রীতি অনুসরণ করে আজ সেই পথের যাত্রী তিনি। চারজনের স্কন্ধে চড়া খাটুলিতে সত্যিই তিনি ঘুমন্ত শিশু। সুর-সঙ্গীতে স্তুতিধন্য মানুষটি জীবদ্দশায় কারো সহায়তা কিংবা দয়ায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত না করলেও আজ অন্যের কাঁধে চড়ে পরজন সহায়তায় ঘুমন্ত শিশুর মতোই শায়িত হলেন শেষ শয্যায়। এটাই যেন বলতে চেয়েছিলেন গীতিকবি বুলবুল। মৃত্যু-পরবর্তী আনুষ্ঠানিকতার কথা মাথায় রেখেই চয়ন করেছিলেন অর্থবহ এ গান। অন্য আরেকটি গানে তিনি বলেছেন, ‘শেষ ঠিকানায় পৌঁছে দিয়ে আবার কেন পিছু ডাকো।’ চরম ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হতে পারে তার এ গানটি। প্রিয়জনকে উদ্দেশ করে লেখা গানে যে প্রতিক্রিয়া ফুটে উঠেছে তা বুলবুলশূন্য বর্তমান প্রেক্ষাপটে এসে কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। মৃত্যু নামক জীবনাবসানের অপ্রিয় অঙ্গনে দাঁড়িয়েও তিনি যেন নিঃশব্দে বলতে চাইছেন আর ডেকো না, ফিরব না আমি। হে প্রিয় সঙ্গীতস্রষ্টা, তোমার সৃষ্টি তোমাকে পিছু ডাকবে। তুমি বাংলা সঙ্গীতকে সমৃদ্ধ করেছ, যা কখনো ভোলা যাবে না। সুরের ভুবনে সর্বদা ডুবে থাকা গানপাগল মানুষটি সুর ও সঙ্গীত সৃষ্টির প্রবল আত্মবিশ্বাস থেকে ফের লিখেছেন, ‘একতারা লাগে না আমার দোতারাও লাগে না।’ সত্যিই তিনি এত্তসব জনপ্রিয় কালজয়ী গান সৃষ্টি করেছেন, যেগুলো একতারা-দোতারাবিহীন অনর্গল বেজে ওঠে শ্রোতা-হূদয়ে, যা বাজবে অনন্তকাল। সুর ও সঙ্গীতের জাদুকর আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল বেঁচে থাকবেন তার সৃষ্টির পরতে পরতে।

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল বাংলা গানের ভুবনে সর্বাধিক জনপ্রিয় নাম। সঙ্গীত অঙ্গনের জনপ্রিয়তায় আধিপত্য বিস্তারকারী এই সুরেলা মানুষটি ১৯৫৭ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে বুলবুল কাঁধে রাইফেল তুলে নেমে পড়েন যুদ্ধ ময়দানে। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ স্মৃতি-বিস্মৃতি নিয়ে বহু জনপ্রিয় গান লিখেছেন এবং সুর করেছেন। ১৯৭০ দশকের শেষ লগ্ন থেকে আমৃত্যু বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পসহ সঙ্গীতশিল্পে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৭৮ সালে ‘মেঘ বিজলী বাদল’ ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। গানের অ্যালবাম তৈরি থেকে শুরু করে অসংখ্য চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন তিনি। উপহার দিয়েছেন বাংলা চলচ্চিত্রের অসংখ্য মানসম্মত গান, যা আজো শ্রোতামহলে বেশ জনপ্রিয়। সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, সৈয়দ আবদুল হাদি, এন্ড্রু কিশোর, সামিনা চৌধুরী, খালিদ হাসান মিলু, আগুন, কনকচাঁপাসহ বাংলাদেশি প্রায় সব জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পীকে নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল নিয়মিত গান করেন ১৯৭৬ সাল থেকে। তিনি রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও রাষ্ট্রপতির পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হন।

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল দেশের একজন জনপ্রিয় সঙ্গীতব্যক্তিত্ব। তার লেখা ও সুর করা প্রায় সব গানই জনপ্রিয়। যেগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যিখানে’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন’, ‘আমি তোমারি প্রেমও ভিখারি’, ‘আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে’, ‘তোমায় দেখলে মনে হয়, হাজার বছর আগেও বুঝি ছিল পরিচয়’, ‘বাজারে যাচাই করে দেখিনি তো দাম’, ‘আম্মাজান আম্মাজান’, ‘যে প্রেম স্বর্গ থেকে এসে’, ‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে’, ‘তুমি আমার জীবন, আমি তোমার জীবন’, ‘ঘুমিয়ে থাকো গো সজনী ফুলের বিছানায়’, ‘আমার হূদয় একটা আয়না’, ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা, হূদয়ে সুখের দোলা’, ‘একাত্তরের মা জননী কোথায় তোমার মুক্তিসেনার দল’, ‘বিদ্যালয় মোদের বিদ্যালয় এখানে সভ্যতারই ফুল ফোটানো হয়’, ‘ওগো সাথী আমার তুমি কেন চলে যাও’, ‘নদী চায় চলতে, তারা চায় জ্বলতে’, ‘চিঠি লিখেছে বউ আমার’। এছাড়া আরো অসংখ্য জনপ্রিয় গান আছে যেগুলো আজো গুনগুনিয়ে গেয়ে যায় মানুষ।

অবশেষে প্রয়াত বুলবুলের লেখা গানেই শেষ করব এই সুরস্রষ্টার চিরবিদায়ী কথা। তার নিজ হস্তে লেখা ‘পৃথিবী তো দুদিনেরই বাসা, দুদিনেই ভাঙে খেলাঘর’ গানটির সময় স্বল্প জীবন বাস্তবতার ইঙ্গিত দেওয়া পথেই হাঁটলেন সঙ্গীতগুরু আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। বহুমাত্রিক গুণের অধিকারী বুলবুল গানের ভুবনে যেমন ছিলেন উজ্জ্বল তারকা, তেমনি দেশপ্রেমে জাগ্রত মানুষটি দেশকে নিয়েই ভেবেছেন সর্বদা। মাত্র পনেরো বছর বয়সে স্বাধীনতা যুদ্ধ ও মুক্তির মিশনে যুক্ত হন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’র মতো কালজয়ী অনেক দেশভাবুক গান, যা বরেণ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে তাকে। তাই মৃত্যুর পরও কাঁদছে মানুষ। সবাই বলছে পরপারে ভালো থেকো প্রিয় বুলবুল।

 

লেখক : সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads