• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪২৯
বীরাঙ্গনাদের দুঃখগাথা

বীরাঙ্গনা শুভারানী

ছবি : সংগৃহীত

মতামত

বীরাঙ্গনাদের দুঃখগাথা

  • আজহারুল আজাদ জুয়েল
  • প্রকাশিত ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

নাম শুভারানী রায়। কিন্তু জীবনের পরতে পরতে দুঃখ, বেদনা, বঞ্চনার কাহিনি। নামের মধ্যে শুভা থাকলেও জীবনের কোথাও কোনো দিন শুভ কিছু দেখতে পাননি। নামের মধ্যে রানী থাকলেও বাস্তবে সারা জীবন পরের অনুগ্রহে জীবন কেটেছে। কেন বাবা-মা নাম শুভারানী রেখেছিলেন আজো বুঝে উঠতে পারেননি শুভারানী। তিনি বলেন, হয়তো রানীর মতো দেখতে হইছিলাম, হয়তো বাবা-মায় আমার মধ্যে শুভ কিছু পাইতে চাইছিল, কিন্তু তারাও কিছু পায় নাই, আমিও না।

শুভারানী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালের একজন বীরাঙ্গনা। থাকেন দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার পাল্টাপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘরে। সরকারি উদ্যোগে ছিন্নমূল মানুষের জন্য এই আশ্রয়ণ প্রকল্প গড়ে উঠেছে ঢেপা নদীর উত্তর তীরে। এখানে তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন ভূমিহীন মানুষ হিসেবে। কিন্তু মহান মুক্তিযুদ্ধে যা হারিয়েছেন তার প্রেক্ষিতে সরকারি-বেসরকারি কোনো কিছু জীবনের কোনো সময়ই পাননি।

শুভা জানান— তখন তিনি কিশোরী, বয়স ১৫, অবিবাহিত। অক্টোবরের যুদ্ধের শেষের দিকে এক মধ্যরাতে হঠাৎ করে বাড়িতে এসে হাজির হয় পাকিস্তানি নরখাদক খান সেনারা। তারা তাকে জোর করে ধরে নিয়ে যেতে চাইলে বাবা বাধা দেয়। তখন খানসেনারা রাইফেলের মাথায় থাকা ধারালো চাকু (বেয়নেট) দ্বারা বাবাকে হুল মারে। হুলের আঘাতে ধারালো চাকু হাতের একদিক দিয়ে ঢুকে গিয়ে আরেক দিক দিয়ে বের হয়ে যায়। এ সময় মা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে তার মাথায়ও রাইফেল দিয়ে আঘাত করে। মায়ের মাথা ফেটে যায়। এরপর মা-বাবাকে হাটখোলায় ধরে নিয়ে যায় এবং শুভারানীকে ভাতগাঁ ব্রিজের নিচে একটি খোলা জায়গায় ধরে নিয়ে আসে। সেখানে আরো একজন মহিলাকে আগেই ধরে নিয়ে আসা হয়েছিল এবং কয়েকজন তার সাথে খারাপ ব্যবহার করছিল। খান সেনারা শুভারানীর সাথেও রাতভর খারাপ ব্যবহার করলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ভোরবেলা খান সেনাদের একজন মেজর সেখানে এসে তাকে দেখতে পায় এবং নির্যাতক খান সেনাদের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। এরপর এলাকার বিশু ডাক্তার তার নিজ বাড়িতে তাকে ও তার বাবা-মাকে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করেন। সেখানে দেড়-দুই সপ্তাহ থাকার পর রঘুনাথপুরে পালিয়ে যান। রঘুনাথপুরে মাসখানেক থাকার পর দেশ স্বাধীন হয়।

শুভারানীর মতো মুক্তিযুদ্ধে আরেক নির্যাতিত নারীর নাম তারাবালা রায়। দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার চণ্ডিপুর ইউনিয়নের খিয়ারপাড়ার বাসিন্দা। আজ তিনিও নিদারুণ অর্থকষ্টে জর্জরিত হয়ে দিনাতিপাত করছেন। খিয়ারপাড়ার শরৎচন্দ্র রায় ও হরেশ্বর চন্দ্র রায় ছিলেন শ্বশুর ও জামাই। মে মাসের দিকে এক দিন পাকিস্তানি সেনা ও বিহারিরা অকস্মাৎ ওই পাড়ায় হামলা চালায়। তারা ওই পাড়ার বহু বাড়িঘর থেকে গরু, ছাগলসহ মূল্যবান মালামাল লুট করে। ওই পাড়ার শরৎচন্দ্র রায় তার স্ত্রী ফুলমণি রায়, তার জামাই হরেশ্বর চন্দ্র রায় ও মেয়ে তারাবালা রায়কে একসাথে ধরে নিয়ে যায়। এ ছাড়া সমো নামের আরেকজন কিশোরী মেয়েকেও ধরে নিয়ে যায় বিহারিরা। তারাবালা ছিলেন নববিবাহিতা। সমো অবিবাহিতা। তাদেরকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর খবর পাওয়া যায়নি তিন দিনেও। তিন দিন পর ফুলমণি, তারাবালা ও সমোকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। তারা বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। ওই তিন দিনে যা হওয়ার তাই হয়েছিল। মা-মেয়ের সর্বস্ব লুট করে নিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার ও বিহারিরা। অপরদিকে তারাবালার শ্বশুর শরৎ ও জামাই হরেশ্বরকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তাদের আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। আজ পর্যন্ত তারা ফিরেও আসেনি। তাদেরকে কোথায় হত্যা করা হয়েছে তা কেউ জানে না।

নির্যাতিতা ফুলমণি মারা গেছেন। তার মেয়ে তারাবালা বীরাঙ্গনা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছেন। তবে এর কোনো ফল এখনো পাননি একাত্তরের এই নির্যাতিতা। সমো এখনো অর্থনৈতিক কষ্টে জর্জরিত। কিন্তু এদের খবর কেউ রাখে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের বীরাঙ্গনা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এই স্বীকৃতির বিপরীতে তাদের দুঃখ, কষ্ট, বেদনা ও দুর্দশা মোচনের উদ্যোগ চোখে পড়ার মতো নয়। এর ফলে ফ্যাকাসে হয়ে পড়ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ। মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি বর্তমান সরকার বীরাঙ্গনাদেরও মূল্যায়ন করবে, এটাই জাতির প্রত্যাশা।

 

লেখক : নিবন্ধকার

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads