• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯
জাহালমকে ঘিরে কিছু প্রশ্ন

জাহালম

ছবি : সংগৃহীত

মতামত

জাহালমকে ঘিরে কিছু প্রশ্ন

  • প্রকাশিত ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

প্রায় চল্লিশ বছর আগে একটি বাংলা সিনেমা দেখেছিলাম। ছবিটির নাম ছিল ‘কার পাপে’। ফখরুল হাসান বৈরাগী পরিচালিত ছবিটিতে অভিনয় করেছিলেন আলমগীর, সুচরিতা, হাসান ইমাম প্রমুখ অভিনয়শিল্পী। ছবিটির কাহিনি এখন আর মনে নেই। তবে একটি রহস্যময় ঘটনা ও তাতে একজন নিরীহ মানুষের শাস্তি পাওয়ার কাহিনি ছিল ওটা। ছবিটির কথা মনে পড়ল তিন বছর জেলের ঘানি টেনে মুক্ত আকাশের নিচে বেরিয়ে আসা জাহালমের খবর পড়ে। ঘটনাটি জানার পর থেকেই মনে প্রশ্নটি খোঁচা দিচ্ছে- কার ভুলে তার এ ভোগান্তি? সে হিসেবে নিবন্ধটির শিরোনাম হতে পারত ‘কার ভুলে’। কিন্তু ইচ্ছে করেই তা করিনি। কারণ জাহালমের ঘটনা জন্ম দিয়েছে অনেক প্রশ্নের; যেগুলোর উত্তর খুেঁজ বের করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ঘটনাটি এখন আর কারো অজানা নেই। মিডিয়ার কল্যাণে তা সবার গোচরে চলে গেছে ত্বরিত গতিতে। সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা আত্মসাতের  অভিযোগে আবু সালেক নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুদকের দায়ের করা ৩৩টি মামলায় ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার হয়েছিলেন নিরপরাধ জাহালম। কিন্তু রহস্যজনকভাবে সালেক রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তার বদলে ধরা হলো জাহালমকে। এ যেন ভোজবাজির খেলা! গত ২৮ জানুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকে জাহালমকে নিয়ে প্রকাশিত হয় একটি বিশেষ প্রতিবেদন। ‘স্যার, আমি জাহালম, সালেক না’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন দৃষ্টি কাড়ে সচেতন মানুষের। ওইদিনই সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অমিত দাশগুপ্ত প্রতিবেদনটি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে উপস্থাপন করেন। প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করে বেঞ্চের বিচারপতিদ্বয় স্বপ্রণোদিত হয়ে দুদক চেয়ারম্যানের প্রতিনিধিসহ চার কর্মকর্তাকে তলব করেন। নির্দেশ দেন ভুল ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার কারণ ব্যাখ্যা করতে। একই সঙ্গে কেন জাহালমের গ্রেফতার অবৈধ বলে ঘোষণা করা হবে না রুলে তাও জানতে চাওয়া হয় সংশ্লিষ্টদের কাছে। এ আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩ ফেব্রুয়ারি দুদক চেয়ারম্যানের প্রতিনিধিসহ চার কর্মকর্তা হাইকোর্টে উপস্থিত হন। শুনানিতে আদালত বলেন, ‘আমরা দুদকের কাজে হস্তক্ষেপ করতে চাই না। দুদক স্বাধীনভাবে কাজ করুক, এটা আমরাও চাই। আগেও আপনাদের (দুদক) ব্যাংকের দুর্নীতি মামলায় সাবধান করেছি। মনে রাখতে হবে এটি একটি স্বাধীন দেশ।’ হাইকোর্ট দুদককে স্বাধীন দেশের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেও এটা বোধকরি অস্বীকার করা যাবে না যে, সে স্বাধীনতা কারো কারো জন্য লাগাম ছাড়া, আবার কারো কারো জন্য একেবারেই সঙ্কুচিত। আলোচিত জাহালমের স্বাধীনতা যে এ ঘটনায় খর্ব হয়েছে তা কি অস্বীকার করা যাবে? বলা হচ্ছে, ভুল করে তাকে গ্রেফতার ও জেলে পোরা হয়েছিল। প্রশ্ন- এ কেমন ভুল? যে ভুলে একজন নিরপরাধ মানুষের জীবন থেকে তিনটি বছর ঝরে যায়! এটা কি আসলেই ভুল, নাকি কাউকে বাঁচিয়ে দেওয়ার জন্য ইচ্ছাকৃত ভুলের অভিনয়?

ঘটনার বিবরণে আমরা জেনেছি, সোনালী ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার পর প্রকৃত অপরাধী আবু সালেকের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। সে মামলার অনুসন্ধান করেন দুদক কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল জাহিদ। অভিযোগপত্রে নাম উঠে আসে জাহালমের। আর টাঙ্গাইলের স্থানীয় এক চেয়ারম্যান সালেক হিসেবে শনাক্ত করেন জাহালমকে। তারপর থেকে কারাগারেই নিবাস হয়েছিল জাহালমের। হাইকোর্টের আদেশের বলে গত ৩ ফেব্রুয়ারি সে মামলা থেকে অব্যাহতি ও মুক্তি পেয়েছে ।

বিষয়টি এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত চারটি বড় প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, পুলিশ এবং দুদক। বাংলাদেশ ব্যাংকের কথা বাদই দিলাম। কিন্তু ঋণদাতা সোনালী ব্যাংক এবং গ্রেফতারকারী পুলিশ কেন প্রকৃত অপরাধীকে শনাক্ত করতে পারেনি? সোনালী ব্যাংকের তো জানা থাকার কথা তারা কাকে ঋণ দিয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী ঋণগ্রহীতার সব তথ্য-উপাত্ত এবং ছবি ব্যাংকের কাছ জমা থাকার এবং মামলা হওয়ার পর তা পুলিশকে সরবরাহ করার কথা। তাহলে সালেকের পরিবর্তে পুলিশ যখন জাহালমকে গ্রেফতার করল, তখন ব্যাংক কেন বলল না-এই লোক আসল অপরাধী নয়? তাহলে কী আমরা ধরে নেব এর পেছনে কোনো গূঢ় রহস্য আছে?

এ প্রসঙ্গে স্বয়ং জাহালম যে কথা বলেছে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত ৪ ফেব্রুয়ারি জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর জেলগেটে সাংবাদিকদের কাছে সে তার ভোগান্তিতে পড়ার বিবরণ দিয়েছে। সে বলেছে, ‘২০০৩ সালে আমি নরসিংদীতে থাকতাম। মাঝে মাঝে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে বাড়ি আসতাম। একদিন আমাদের এলাকার চেয়ারম্যান সাব ফোন করে বলেন, ভাইগনা, এলাকায় আসো। তোমার নামে একটা মামলা হইছে। বাড়িতে আসার পর তিনি আমাকে একটা লোকের ছবি দেখিয়ে বলেন, এই ছবি কি তোমার? তখন আমি বলি- না, এইটা আমার ছবি না। তখন তিনি বলেন, কিন্তু সবাই বলে চেহারা তো একই রকম দেখা যায়।’ এরপর কয়েকদিন পরে দুদক আমার বাড়িতে চিঠি পাঠায়। পরে বড় ভাই ও আমি ঢাকার সেগুনবাগিচায় দুদক অফিসে যাই। সেখানে আমাকে একটি ছবি দেখিয়ে বলে- এই ছবিটা দেখছেন? এই ছবিটা তো আপনার। তখন আমি বলি, জি না স্যার, এই ছবি আমার না। তখন তারা একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ছবি দেখায়। উনাদের বলি- স্যার, আমি তো জীবনেও কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করি নাই। পরে তাদের আমি আইডি কার্ড দেখাই। চাকরির কাগজপত্র দেখাই। উনারা সেগুলোর ফটোকপি রাখেন। এরপরই আমার জীবনের তিনটা বছর নাই।’ জাহালমের বক্তব্যমতে, দুদকের কর্মকর্তারা যদি তার আইডি কার্ড ও চাকরির কাগজপত্রের কপি রেখে থাকেন, তাহলে সেগুলো কী কাজে লাগিয়েছেন? তারা কি অভিযুক্তকে চিহ্নিত করতে সেগুলো যাচাই-বাছাই করেছিলেন? নাকি কাউকে পরিত্রাণ দিতে সেগুলোকে গুম করে ফেলেছেন? এমনও তো হতে পারে আসল অপরাধী এই তিন বছরে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে? তাহলে এর জন্য দায়ী থাকবে কে বা কারা? দুদক চেয়ারম্যান বলেছেন, জাহালমের ঘটনায় দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তাদের যদি কোনো গাফিলতি থেকে থাকে, তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এজন্য তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। দেশবাসীও অপেক্ষায় আছে সে তদন্ত ও তার ফলাফল দেখার জন্য। 

জাহালমের ঘটনা নিয়ে গত ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে বেসরকারি টিভি চ্যানেল নিউজ টোয়েন্টি ফোর-এর টক শোতে আইনজীবী এলিনা খান বলছিলেন তার অভিজ্ঞতার কথা। জাহালমের মতো এমনই এক ভাগ্যাহত যুবক বিনা দোষে কারাগারে পচে মরছিল। তিনি উদ্যোগী হয়ে তাকে মুক্ত করে এনেছিলেন। তিনি বলছিলেন, ওই ছেলেটি যে আসল অপরাধী নয়, এটা প্রমাণ করতে তার অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। বিনা দোষে বছরের পর বছর জেল খাটার ঘটনা বিরল নয় আমাদের দেশে। কীভাবে কারো কারো কপালে সে দুর্ভোগ নেমে আসে, তার কাহিনিও আমরা জানি। তবে অনেক পরে। ভাগ্য ভালো হলে সে মুক্তি পায়। না হলে হারিয়ে ফেলে তার জীবনের অনেক মূল্যবান সময় ও সম্পদ। ওই টক শো’তে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলছিলেন জাহালমের ক্ষতিপূরণের মামলা করার কথা। হ্যাঁ, দেশের প্রচলিত আইনেই সে তার ভোগান্তি এবং সার্বিক ক্ষতির জন্য মামলা করতে পারে। হয়তো সে তা করবেও। কিন্তু কার বা কাদের বিরুদ্ধে? সোনালী ব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যাংক, পুলিশ নাকি দুদকের বিরুদ্ধে? কারণ জাহালমের দুর্ভোগের জন্য এ চার কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যে দায়ী তা তো স্পষ্ট। এ প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান ইতোপূর্বে গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘জাহালমকে সালেক হিসেবে চিহ্নিত করেছে ব্যাংক। পুলিশও আসামি হিসেবে জাহালমকে চিহ্নিত করেছে। এনআইডি কর্তৃপক্ষও একই ভুল করেছে। এটা দুঃখজনক। তাই আসল ভুল কোথায় হয়েছে সেটাই খতিয়ে দেখতে হবে।’

এদিকে মুক্তি পাওয়ার পর জাহালম গণমাধ্যমকে বলেছেন, অপরাধী না হয়েও তাকে জেল খাটানোর জন্য তিনি দুদকের বিচার চান প্রধানমন্ত্রীর কাছে। গত ৪ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলে নিজ বাড়িতে যাওয়ার আগে কাশিমপুর কারাফটকে সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, ‘কোনো অপরাধ না করা সত্ত্বেও দুদক আমাকে মিথ্যা মামলায় তিন বছর কারাগারে আটকে রেখেছে। আমি দুদকের কঠিন বিচার চাই। তাদের কারণে আমি জেলখানায় অনেক কষ্টে দিন কাটিয়েছি। আমি অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। আমি এর ক্ষতিপূরণ চাই। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের বিচার চাই’। (দেশ রূপান্তর, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯) জাহালমের এ দাবি যে অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত, তাতে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়। বরং এটি একটি মানবিক দাবিও বটে। যাদের কারণে তাকে তিনটি বছর অন্ধকার কারাপ্রকোষ্ঠে দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হয়েছে, স্ত্রী-সন্তানের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছে, তাদের বিচার তো হতেই হবে। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করে জাহালমকে দিতে হবে। সে ব্যবস্থা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রেরই।

দায়িত্বহীনতা বা ঘুষ-দুর্নীতির বিষয়ে পুলিশ সম্পর্কে বলে লাভ নেই। এ বিষয়ে দেশবাসীর যথেষ্ট তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। যে পুলিশ মৃত ব্যক্তিকে ককটেল ছুড়তে দেখে তাকে মামলার আসামি করে, বিদেশে অবস্থানকারী বা হজব্রত পালনরতকেও দেখে সংঘর্ষে লিপ্ত থাকতে, জন্মগতভাবে পঙ্গু ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে লাঠি হকিস্টিক নিয়ে হামলা-হাঙ্গামার, অন্ধ ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে বাস পোড়ানোর, সে পুলিশের সম্পর্কে যত কম বলা যায় ততই ভালো। কিন্তু দুদক? তাদের বিষয়ে তো মানুষের উঁচু ধারণা ছিল। বেশকিছু কাজের জন্য দেশবাসীর মধ্যে দুদকের একটি ভালো ইমেজ গড়ে উঠেছিল। অনেকের মনেই আশার সঞ্চার হয়েছিল যে, দুদক দেশ থেকে দুর্নীতি ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে না পারলেও কমিয়ে আনতে পারবে। কিন্তু কয়েকটি ঘটনায় সে আশার গুড়ে যেন বালি পড়েছে। জাহালমের ঘটনা তো আছেই, এর আগে মামলা থেকে রেহাই দিতে অভিযুক্তের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে দুদক কর্মকর্তার গ্রেফতারের খবর মানুষকে চমকে দিয়েছে। তাহলে কি ‘বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা’ রয়েছে? মনে রাখা দরকার, দুদকে যারা কাজ করছেন তারা আকাশ থেকে নেমে আসেননি। তারাও রক্ত-মাংসের মানুষ এবং এদেশেই জন্ম নেওয়া। সুতরাং তারা সবাই সাত ধোয়া তেঁতুল বিচি বা দুধে ধোয়া তুলসীপাতা হবেন এমনটি না ভাবাই ভালো। জাহালমের ঘটনায় দুদকের ভাবমূর্তিতে যে টান পড়েছে, এটা অস্বীকার করে লাভ নেই। তাই দুদকের উচিত হবে ব্যক্তির দিকে না তাকিয়ে প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে কঠোরতা অবলম্বন করা।

গত ৪ ফেব্রুয়ারি পুলিশ সপ্তাহ উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘দেশের নিরীহ জনগণ যেন কোনো ধরনের হয়রানি বা নির্যাতনের শিকার না হয়, এ বিষয়ে সতর্ক থাকবেন।’ প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের সারমর্ম ব্যাখ্যা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে তার এ সতর্কবার্তা কতটা কার্যকর হয়, সেটাই দেখার বিষয়।

 

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads