• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

মতামত

নদী নিয়ে দুঃখ আছে অনেক

  • আমিনুল ইসলাম হুসাইনী
  • প্রকাশিত ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

নদী! এক রহস্যপুরীর সন্তানের নাম, যার জন্ম তুষারঢাকা পর্বতের উচ্চ চূড়ায়। যেখানে আকাশ ধূম্র মেঘাচ্ছন্ন। যেখানে নেই কোনো জনমানবের চিহ্ন। সেখানেই তুষার গলিত পানিতে পরিপুষ্ট হতে থাকে নদীর দেহবিশেষ। আকাশছোঁয়া পর্বতচূড়া থেকে তীব্রবেগে নেমে আসা জলস্রোতই স্থলভাগ অতিক্রমকালে নদীর আরেক নাম হয় তটিনী।

উপত্যকা থেকে উপত্যকা পাড়ি দিয়ে সমতলে নেমে আসা নদী পৃথিবীর সঙ্গে রচনা করে ঊর্ধ্বলোকের যোগসূত্র। এ সময় দুদিক থেকে গিরি প্রবাহিনী যোগ দেয় নদীর সঙ্গে। তখন নদীর গতি কিছুটা কমে এলেও এর আয়তন বাড়তে থাকে। নদী তখন যতটা অগ্রসর হয় নদীর আয়তনও ততটাই বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে নদীকেন্দ্রিক মানবসভ্যতা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি। নদীকে ঘিরে কালে কালে যে সভ্যতা ও মনুষ্য বসতি গড়ে উঠেছিল, সেই সভ্যতার কাছে ঋণী আজকের আধুনিক সভ্যতা। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, নদীর কাছেই চিরঋণী পৃথিবীর সব সভ্যতা। ইতিহাস বলে, নীল নদের তীরে, সিন্ধু নদের অববাহিকায়, হোয়াংহো-ইয়াংসিকিয়াং এবং ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর তীর ধরে যে সভ্যতার জন্ম হয়েছিল, তা-ই হচ্ছে আধুনিক মানবসভ্যতার সূতিকাগার। সেই সভ্যতাই সম্প্রসারিত হয়েছে বিশ্বব্যাপী।

নদীর পেটে যেন লুকিয়ে আছে মায়ার কাঠি। আচ্ছা এই যে নদী দেখলেই নামতে ইচ্ছে করে, এটাই কি নদীর সেই মায়ার কাঠি? মায়াই তবে নদীর শক্তি। এই শক্তি দিয়েই মানুষকে পবিত্র করে। তাই ধর্মীয় দিক থেকেও নদীর রয়েছে অনেক গুরুত্ব। হিন্দুদের ধর্মীয় গ্রন্থ ‘ঋেবদ’-এ সিন্ধু ও সরস্বতী নদীকে পুণ্যসলিলা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আবার গঙ্গা, যমুনা, গোদাবরী, সরস্বতী, নর্মদা, সিন্ধু, কাবেরী নদীকে ঘিরে উচ্চারণ হয়েছে অনেক মন্ত্র, গীত ও সঙ্গীত। নদী সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আসমান ও জমিনের সৃষ্টিতে রাত ও দিনের বিবর্তনে এবং নদীতে নৌকার চলাচলে মানুষের জন্য কল্যাণ রয়েছে।’ (সুরা বাকারাহ : ১৫৪) অপর এক আয়াতে বলা হয়েছে, ‘এবং তিনিই পৃথিবীর ওপর বোঝা রেখেছেন, কখনো যেন তা তোমাদের নিয়ে হেলেদুলে না পড়ে এবং নদী ও পথ তৈরি করেছেন, যাতে তোমরা পথ প্রদর্শিত হও।’ (সুরা নাহল : ১৫)

বহুদূর থেকে ছুটে আসা এই নদীকে আমাদের কাছে আসতে অনেক বাধা-বিপত্তি পাড়ি দিতে হয়েছে। কত শত পথ, প্রান্তর, বন, জনপদ পার হয়ে কত গ্রাম ও নগরের পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে মিলিত হয়েছে সমুদ্রে। সমুদ্রে মিলিত হয়েও তার পথচলা থামে না। অনন্ত সাগর, অনন্ত মেঘপ্রবাহ, পানির অনন্ত উৎস ধারার সঙ্গে নদীও ধারণ করে অনন্ত রূপ। নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। এদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত প্রধান নদীগুলোর উৎস হিমালয় পর্বত। গবেষকদের মতে, বাংলাদেশে উপ-নদী ও শাখা নদীর সংখ্যা ২২৫টি। আনুমানিক হিসাব কষে বাংলাদেশে কমপক্ষে ৭০০ নদী আছে বলে মনে করেন নদী বিশেষজ্ঞরা। তবে নদী, উপ-নদী, শাখা নদী নিয়ে যথেষ্ট মতানৈক্য রয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান নদী পাঁচটি- পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, পশুর ও কর্ণফুলী। এ ছাড়া আছে তিস্তা, গড়াই, মধুমতী, রূপসা, আড়িয়াল খাঁ, কুমার, আত্রাই, গোমতী, কীর্তনখোলা, শীতলক্ষ্যা ইত্যাদি। অপূর্ব সুন্দর এই নদীগুলো পৃথিবীর অজ্ঞাত ঝরনার মায়া ছেড়ে আমাদের তার মায়ার বাঁধনে গাঁথতে চায়।

নদীকে নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য গান, কবিতা, নাটক এবং উপন্যাস। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকেই নদী-তীরবর্তী মানুষের জীবনলিপি ও সমাজজীবনে নদীর গুরুত্ব ফুটে উঠেছে যেসব উপন্যাসে, সেগুলো হচ্ছে- নদীবক্ষে (১৯১৯)- কাজী আবদুুল ওয়াদুদ; নদী ও নারী (১৯৪৬)- হুমায়ুন কবির; ইছামতি (১৯৫০)- বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়; চরভাঙা চর (১৯৫১)- কাজী আফসার উদ্দিন আহমদ; গঙ্গা (১৯৫৭)- সমরেশ বসু; অন্তর্জালী যাত্রা (১৯৬২)- কমল কুমার মজুমদার; পদ্মা নদীর মাঝি (১৯৬৩)- মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়; কাঁদো কাঁদো (১৯৬৮)- সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ। এ ছাড়া ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেনের পোকামাকড়ের ঘরবসতি (১৯৮৬) উপন্যাসে নদী ও জীবন পরস্পরের সঙ্গে একাকার হয়ে আছে। নদীকে নিয়ে এত প্রেম আর ভালোবাসার এত যে উপাখ্যান, তার পরও নদীর আছে দুঃখ অনেক। প্রায়ই নিউজ চ্যানেলে দেখা যায় নদী ভরাটের খবর। পত্রিকায় ছাপা হয় নদীর ওপর হামলার দুঃসংবাদও। আবার কখনো কখনো ছোটখাটো নদীর মাঝখানে জাল পেতে জলস্রোত বন্ধ করে চালায় মৎস্য নিধনের উৎসব। নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রাণ যেখানে জলস্রোতে রাখা, সেখানে হামলা, অবরোধ আর জবরদখলের মতো নিন্দনীয় ঘটনা আত্মহননের মতোই নয় কি?

এদেশেরই কিছু মানুষ নদীগুলোকে মরুকরণের যে প্রক্রিয়া চালাচ্ছে তা দেখার যেন কেউ নেই। প্রতিকারের বা প্রতিরোধের জন্য নেওয়া হচ্ছে না কোনো কঠোর ব্যবস্থা। জবরদখল ছাড়াও শিল্পবর্জ্য, মানুষ ও প্রাণীর মলমূত্র নদীগুলোকে বিষাক্ত করে তুলছে অবিরাম। পানি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর আইনুন নিশাত বলেন, ‘নদীদূষণের উৎস নির্মূলে কঠোর হতে হবে।’ তার মতে, ‘১৯৪৭ সালের পর থেকে নদীগুলোর যত্নে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। ফলে একের পর এক নদী মরে যাচ্ছে।’ নদী স্রষ্টার অগণিত অনুদানের মধ্যে এক অনন্য সৃষ্টি। এই সৃষ্টি আমাদের জীবিকা নির্বাহে যেমন পাশে থাকে, তেমনি আমাদের পথচলায়ও সহায়তা করে। সর্বোপরি প্রকৃতির এক অপরূপ সৌন্দর্যের নাম হচ্ছে নদী। তাই প্রকৃতিকে বাঁচাতে হলে বাঁচাতে হবে নদীকে। নদীকে বাঁচাতে সরকারকে যেমন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, তেমনি আমাদেরও নদীপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে হবে।

 

হ লেখক : সম্পাদক, চন্দ্রবিন্দু

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads