• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

নিরাপদ সবজি উৎপাদন কৃষক ও ভোক্তার স্বার্থ

  • নিতাই চন্দ্র রায়
  • প্রকাশিত ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রচুর শাকসবজি উৎপাদিত হলেও দেশের সাধারণ মানুষ তার সুফল ভোগ করতে পারছে না। প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও অন্যান্য সীমাবদ্ধতার কারণে সংগ্রহ-উত্তর ও বিপণন পর্যায়ে উৎপাদিত সবজির শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ নষ্ট হয়ে যায়। শাকসবজি সংরক্ষণের একটি অন্যতম উপায় হচ্ছে প্রক্রিয়াকরণ ও প্যাকেজিং। প্রক্রিয়াকরণ ও প্যাকেজিং পণ্যের গুণগত মান ও সেলফ লাইফ বৃদ্ধি করে এবং মূল্য সংযোজন ঘটিয়ে পণ্যের চাহিদা বাড়ায়। প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে অসময়েও শাকসবজির স্বাদ ভোগ করা যায়। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও দ্রুত নগরায়নের ফলে মানুষের বহুমুখী খাদ্যাভ্যাস বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পাছে প্রক্রিয়াজাত করা শাকসবজির চাহিদা। উন্নত বিশ্বে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প হিসেবে প্রসার লাভ করেছে। আমাদের দেশেও ভবিষ্যতে প্রক্রিয়াজাত করা শাকসবজির বাজার তৈরি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে কৃষি বিপণন অধিদফতর ফ্রেশকাট শাকসবজি ও ফলমূল প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণন কার্যক্রম সম্প্রসারণ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে- এটা নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। সতেজতা, স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টিমান অক্ষুণ্ন রেখে সবজিকে খোসা বা বাকল ছাড়িয়ে ব্যবহার উপযোগী টুকরো করে কোনো প্যাকেট বা মোড়কে সুসজ্জিত অবস্থায় ভোক্তার কাছে উপস্থাপনকেই বলা হয় ফ্রেশকাট শাকসবজি। এ কর্মসূচির মাধ্যমে শাকসবজির উৎপাদন-পরবর্তী অপচয় কমিয়ে কৃষকদের আর্থিকভাবে লাভবান করা সম্ভব। অন্যদিকে কৃষিভিত্তিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতেও অবদান রাখা যায়। ফ্রেশকাট সবজির উদ্দেশ্য হলো- সময় সাশ্রয়, সহজে রান্না, সংরক্ষণ ও অপচয় হ্রাস করা।

গত ১০ বছরে সবজির উৎপাদন ১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেলেও সে হারে বাড়েনি সবজি পরিভোগ। এ সময়ে জনপ্রতি প্রতিদিন ভোগ ২৬ গ্রাম বেড়ে ১৪০ গ্রাম থেকে ১৬৬ গ্রামে দাঁড়িয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে সবজির ভোগ না বাড়ায় কৃষক সবজির ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বিশ্বে সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয় হলেও এ খাতে রয়েছে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা। সবজি বিপণনে আধুনিক বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা না থাকায় এবং বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা কার্যকর ব্যবহারের অভাবে ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না কৃষক। অন্যদিকে কৃষকের মজুত অক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীরা কম দামে কিনে নিচ্ছে কৃষিপণ্য। একজন সুস্থ-সবল মানুষের প্রতিদিন ২২০ গ্রাম করে বছরে কমপক্ষে ৮০ কেজি সবজি গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু আমরা সেখানে গ্রহণ করছি প্রতিদিন ১৬৬ গ্রাম করে বছরে ৬০ দশমিক ৫০ কেজি। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সবজি পরিভোগের পরিমাণ আমাদের দেশের চেয়ে অনেক বেশি। জাপান, জার্মানি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রতি বার্ষিক সবজি ভোগের পরিমাণ যথাক্রমে ১০০, ৯২ ও ১১৬ কেজি।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ ১ কোটি ৫৯ লাখ ৫৪ হাজার টন সবজি উৎপাদন করে বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে উন্নীত হয়েছে। এটা দেশের কৃষি ও কৃষকের জন্য যেমন এক বিরাট গৌরবের বিষয়, তেমনি বিস্মকর সাফল্যও বটে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে ১ কোটি ৬০ লাখ ৪২ হাজার ৩০০ টন সবজি উৎপাদিত হয়। মোট উৎপাদিত সবজির মধ্যে ১ কোটি ১৪ লাখ ৬৭ হাজার টন সবজি উৎপাদিত হয় শীত মৌসুমে এবং বাকি ৪৬ লাখ ৩৫ হাজার ৬০০ টন সবজি উৎপাদিত হয় গ্রীষ্মকালে। অর্থাৎ মোট সবজির শতকরা ৭১ ভাগ উৎপাদিত হয় শীতকালে আর ২৯ ভাগ উৎপাদিত হয় গ্রীষ্মকালে।

শীতের সবজিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন ও খনিজ পদার্থসহ অনেক পুষ্টি ও ভেষজ উপাদান। এসব সবজির মধ্যে ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রুকলি, শিম, মূলা, টমেটো ও গাজরের গুণাগুণের কথা বলে শেষ করা যাবে না। ফুলকপিতে ক্যালসিয়াম, আয়রন, ভিটামিন-বি, ভিটামিন-সি ও যথেষ্ট পরািমাণে ভিটামিন-কে আছে। বাঁধাকপিতে ভিটামিন-সি ও প্রচুর আঁশ আছে। সবজিটি নিয়মিত খেলে পায়ুপথ ও কোলন ক্যানসারের ঝুঁকি হ্রাস পায়। মূলা হজমে সহায়তা করে। রক্ত বিশুদ্ধকরণ ও ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। পাকা টমেটোতে ভিটামিন-সি, শর্করা, আমিষ, ক্যালসিয়াম ও আয়রন রয়েছে। টমেটো ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়তা করে। হূদরোগ প্রতিরোধ করে। বার্ধক্য রোধ করে শরীরকে সতেজ রাখে। গাজর অত্যন্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ সবজি। পুষ্টি ও ভেষজ গুণের জন্য সারা পৃথিবীতে গাজর সুপার ফুড হিসেবে বিবেচিত। এর অন্যতম উপাদান বিটা ক্যারোটিন দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে সহায়তা করে। গাজরের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্যানসার প্রতিরোধের পাশাপাশি রক্তের দূষিত পদার্থ দূর করার ক্ষেত্রেও সহায়তা করে।

পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, বগুড়ায় শীতকালীন সবজিবাজারে ধস নেমেছে। প্রতিদিনই সবজির দাম কমতে থাকায় কৃষকের উৎপাদন খরচ উঠছে না। বর্তমানে সেখানে ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ১ টাকা ২৫ পয়সা কেজিতে অর্থাৎ প্রতি মণ ৫০ টাকায়। আর বাঁধাকপি প্রতি পিস বিক্রি হচ্ছে ২ টাকা দরে। কৃষকরা ন্যায্য দাম না পেলেও কয়েকবার হাতবদলের পর সাধারণ মানুষকে কিনতে হচ্ছে সেই সবজি কয়েকগুণ বেশি দামে। ময়মনসিংহের ত্রিশালের মহাস্থান হাটের ১ টাকা ২৫ পয়সার ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকা এবং ২ টাকা দামের বাঁধাকপি বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ টাকা দামে। ঠাকুরগাঁওয়ে বর্তমানে প্রতি কেজি টমেটো বিক্রি হচ্ছে ৪ টাকা কেজি দামে, যা মৌসুমের শুরুতে বিক্রি হয়েছিল ৪০ টাকা কেজি দরে।

মহাস্থান হাটে সবজি বিক্রি করতে আসা মোকামতলা ইউনিয়নের চকপাড়া গ্রামের কৃষক জামাল হোসেন, অভিরামপুর গ্রামের শফিকুল ইসলাম ও চক রামচন্দ্রপুর গ্রামের আবদুল খালেক জানান, ফুলকপি ১ টাকা ২৫ পয়সা কেজি, বাঁধাকপি ২ টাকা পিস দরে বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের। এই দামে সবজি বিক্রি করে লাভ তো দূরের কথা, হাটে আনতে ভ্যান ভাড়াসহ জমি থেকে ফসল উঠানোর খরচই উঠছে না। মহাস্থান হাটের পাইকারি সবজি ক্রেতা মজনু মিয়া শীতকালীন সবজির দরপতনের কারণ সম্পর্কে বলেন, আমদানি বেশি এবং আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় দেশের সব এলাকায় কপির উৎপাদন ভালো হয়েছে এবং একসঙ্গে অধিক পরিমাণে সবজি বাজারে আসায় দাম পড়ে গেছে। শিবগঞ্জের অনন্তবালা গ্রামের কৃষক আমজাদ হোসেন বলেন, বাঁধাকপির দাম কম দেখে গরুকে খাওয়ানোর জন্য ২ টাকা দামে ৫০ পিস বাঁধাকপি কিনেছেন তিনি। জানা যায়, মহাস্থান হাট থেকে প্রতিদিন ৭০ থেকে ৮০ ট্রাক সবজি পাঠানো হয় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে।

বগুড়া থেকে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত মৌসুমে ১২ হাজার হেক্টর জমিতে ২ লাখ ৮০ হাজার টন সবজি উৎপাদিত হয়। এবার সাড়ে ১২ হাজার হেক্টর জমি থেকে ৩ লাখ টনের বেশি সবজি উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

উত্তম কৃষির মানদণ্ড নির্ধারণ করে গ্লোবাল গ্যাপ (গুড অ্যাগ্রিকারচারাল প্র্যাকটিসেস)। ইউএসএআইডি ও গ্লোবাল গ্যাপের সহযোগিতায় দেশের চার শতাধিক চাষিকে উত্তম কৃষিচর্চায় প্রশিক্ষণ দিয়েছে স্বপ্ন। গ্লোবাল গ্যাপের মানদণ্ড মেনে সবজি উৎপাদন করছেন এসব চাষি। তারা অন্য চাষিদের চেয়ে সবজির দাম পাচ্ছেন বেশি। কম বালাইনাশক ব্যবহারের কারণে তাদের উৎপাদন খরচও হচ্ছে তুলনামূলকভাবে কম। এ ধরনের একজন কৃষক হলেন ঝিনাইদহের সিরাজুল ইসলাম। স্বাস্থ্যসম্মত শিম ও পুঁই শাক উৎপাদনে তার জুড়ি নেই। আজ থেকে আট বছর আগে দুই বিঘা জমিতে সবজি চাষের মাধ্যমে শুরু হয় তার বাণিজ্যিকভাবে সবজি উৎপাদন। তার উৎপাদিত নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত শিম এবং পুঁইশাক এখন সরবরাহ হচ্ছে চেইন শপ স্বপ্নে। ফলন ও দাম দুই-ই পাচ্ছেন তিনি বেশি। আগে তিনি সবজি ক্ষেতে প্রায় প্রতিদিনই কীটনাশক ব্যবহার করতেন। ক্ষেতে কীটনাশক স্প্রে করার পরদিনই সবজি উত্তোলন করে বাজারে বিক্রি করতেন। কিন্তু চেইন শপ স্বপ্নের মাঠকর্মীদের পরামর্শ অনুযায়ী এখন তিনি শিম ও পুঁইশাকে পরিমিত পরিমাণে সার ও বালাইনাশক ব্যবহার করছেন। ক্ষেতে কীটনাশক ছিটানোর এক সপ্তাহ পর সবজি তুলে প্রতিষ্ঠানটিতে সরবরাহ করছেন। এ সময়ের মধ্যে কীটনাশকের বিষক্রিয়াও নষ্ট হয়ে যায়। এতে উৎপাদিত সবজি নিরাপদ থাকে। বর্তমানে চুক্তির ভিত্তিতে স্বপ্নে শিম ও পুঁইশাক সরবরাহ করছেন তিনি। সিরাজুল ইসলাম এ বছর দুই বিঘা জমিতে শিম ও এক বিঘা জমিতে পুঁইশাক আবাদ করেছেন। ইতোমধ্যে তিনি ১ লাখ টাকার শিম ও ৫০ হাজার টাকার পুঁইশাক বিক্রি করেছেন। নিরাপদ সবজি উৎপাদনকারী এই কৃষকের বিশ্বাস, স্বপ্নের মাঠকর্মীদের সহায়তায় যে পদ্ধতিতে তিনি সবজি আবাদ করেছেন, এ পদ্ধতিতে দেশের সব জেলায় সবজি উৎপাদন করা হলে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেকটা কমে যাবে। একই সঙ্গে কৃষকরাও বেশি দামে সবজি বিক্রি করে লাভবান হবেন।

থাইল্যান্ডে শতকরা ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ শাকসবজি ও ফলমূল প্রক্রিয়াজাত করা হয়। দেশে যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা হতে যাচ্ছে, সেসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প স্থাপনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং দেশের মানুষের মধ্যেও টাটকা ও প্রক্রিয়াজাত করা শাকসবজির ভোগ বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে উত্তম কৃষিচর্চা অনুসরণ করে মানসম্মত নিরাপদ সবজি উৎপাদন বৃদ্ধি ও বিদেশে সবজি রফতানির পরিমাণ বাড়ানোর ব্যাপারেও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

 

হ লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)

নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস লিমিটেড

হবঃধরৎড়ু১৮—ুধযড়ড়.পড়স

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads