• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

বৃদ্ধাশ্রম : চার দেয়ালে বন্দি বাবা-মায়ের শেষ ক্ষণটুকু

  • নাজমুল হোসেন
  • প্রকাশিত ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

পৃথিবীতে মা-বাবা এমন এক আশ্রয়, যার তুলনা পৃথিবীর কোনো বাটখারায় পরিমাপ করা যায় না। যায় না সেই পরম স্নেহের ওজন দেওয়া কোনো ওয়েট মেশিনে। সুতরাং এই মা এবং বাবারা তাদের শেষ বয়সে কেন বৃদ্ধাশ্রমে থাকবেন- প্রশ্নটি অচেতন প্রতিটি সন্তানের বিবেকের কাছে। এই মা-বাবা না থাকলে আমরা পৃথিবীর আলোই দেখতে পেতাম না। যে মা পরম স্নেহে শত অবর্ণনীয় কষ্ট, আঘাত, যন্ত্রণা সহ্য করে দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করলেন, আবার জন্মের পর থেকে লালন-পালন করা, পড়ালেখা শেখানো, সন্তানদের হাসিখুশি রাখতে কত ত্যাগ স্বীকার করলেন— সেই বাবা-মায়েদেরই বৃদ্ধ বয়সে থাকতে হবে বৃদ্ধাশ্রমে! মানবতার প্রতি এ এক চরম উপহাস। দু’দশক আগেও আমাদের দেশে বৃদ্ধাশ্রম তেমন একটা ছিল না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এর সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু কেন এই বৃদ্ধাশ্রম?

এই প্রশ্নের উত্তর বড়ই করুণ। ছোটবেলায় যে বাবা-মা ছিলেন সবসময় নিরাপদ আশ্রয়স্থল, যাদের ছাড়া এক মুহূর্ত থাকার কল্পনাই করা যেত না, আজ সেই বাবা-মাকেই ঝামেলা মনে হচ্ছে, নিজের কাছে রাখার প্রয়োজন বোধ করছি না। অথবা অবহেলা ও দুর্ব্যবহার করে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করা হচ্ছে যেন তারা নিজেরাই ভিন্ন কোনো ঠাঁই খুঁজে নেন। মনে রাখতে হবে আমরা একসময় শিশু ছিলাম। আর বৃদ্ধ বয়সে বা-মায়েরাও শিশু হয়ে যান। তারা আমাদের ছোটবেলায় আমাদের দাবি, আবদার, জ্বালা-যন্ত্রণা মানতে পারলেও আমরা মানতে পারছি না। বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলার, তাদের সঙ্গে সময় কাটানোর বা দেখভাল করার এতটুকু সময় আজ আমাদের নেই। বর্তমানে অনেক পরিবারের বউ হয়তো শ্বশুর-শাশুড়িকে নিজের বাবা-মায়ের মতো করে মন থেকে মেনে নিতে পারে না। একইভাবে অনেকেই স্ত্রীর বাবা-মায়ের ওপর আনীত বিভিন্ন অভিযোগে তাদের বিরোধী হয়ে যায়। ফলে এদের স্থান হয় বৃদ্ধাশ্রমে। তবে এটা কোনো সমাধান নয়। এক্ষেত্রে প্রকৃত সমস্যা বা ভুল বোঝাবুঝির সমাধান গুরুত্ব সহকারে নিজেদেরই করে নিতে হবে।

বর্তমান সমাজব্যবস্থায় এ ধরনের নানা অজুহাতে অনেকেই তাদের পরিবার থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন। একসময় যারা নামিদামি বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, চাকরিজীবী ছিলেন তাদের অনেকেই আজ নিজ সন্তানদের অবহেলা, অযত্ন ও বঞ্চনার শিকার হয়ে বৃদ্ধাশ্রমের স্থায়ী বাসিন্দা হতে বাধ্য হচ্ছেন। সবকিছু থাকতেও সন্তানহারা এতিম হয়ে জীবনযাপন করছেন। এমন দুঃখী বাবা-মাদের বুকভরা কষ্ট থেকে সন্তানকে লেখা চিঠি প্রায়ই পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয় যা অত্যন্ত হূদয়বিদারক। আমরা যারা তাদের অবহেলা ও বোঝা মনে করে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসছি, তারা কি একবার ভেবেছি আমাদেরকেও একদিন বৃদ্ধ হতে হবে! খুব বেশি দূরে নয় সেই সময়, যখন আমাদেরকেও নিজ সন্তানের অনুরূপ আচরণের শিকার হয়ে শেষ বয়সে সৃষ্টিকর্তার অমোঘ নিয়মে এই বৃদ্ধাশ্রমেই বাকি জীবন কাটানোর প্রস্তুতি নিতে হবে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব মহানবী (সা.) স্পষ্টই উল্লেখ করেছেন— বাবা-মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। সত্যিই বিবেকের কাছে আজ আমরা পরাজিত, আমরা বড়ই অকৃতজ্ঞ।

সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসার একটি গল্প বলা আবশ্যক মনে করছি— কোনো এক অসহায় মা তার সন্তানকে নিয়ে শহরে থাকতেন। ছেলের বুঝজ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখে আসছে একটা চোখ না থাকায় মাকে কুৎসিত দেখায়। মা একদিন স্কুলের পাশ দিয়ে কোথাও যাওয়ার সময় ছেলেকে দেখতে গেলেন। কিন্তু মাকে কুৎসিত দেখানোর কারণে সহপাঠীরা হাসাহাসি করবে এই লজ্জার ভয়ে ছেলে সেদিন দেখা করেনি। মা কিছু না বলে ফিরে এলেন। ছেলে একসময় বড় হয়ে চাকরি পেল। বিয়ে করে মায়ের আর কোনো খোঁজখবর না রেখে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিল। কয়েক বছর পর ছেলে তার স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রদের পুনর্মিলনী দাওয়াত পেয়ে সেই শহরে এলো। এই ফাঁকে মাকে দেখতে গেলে জানতে পারে, যে ভাড়া বাসায় মা থাকতেন সেখানে এখন অন্য কেউ থাকে। পাশের বাড়ির মায়ের বয়সী এক মহিলা তাকে একটা চিঠি দিয়ে বললেন, তোমার মা মারা যাওয়ার আগে তোমাকে এটা দিতে বলে গেছেন। চিঠিতে লেখা ছিল— ‘বাবা! আমি জানি আমার একটা চোখ না থাকাতে কুৎসিত দেখানোর কারণে অন্যদের মতো তুমিও আমাকে পছন্দ করতে না। আমার চোখ না থাকার কারণটা জানতে পারলে তুমি নিশ্চয়ই আমাকে আর ঘৃণা করতে না। তুমি ছোট থাকা অবস্থায় তোমার আব্বু, আমি আর তুমি এক গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হই। সেদিন তোমার আব্বু মারা যান, আমি গুরুতর আহত হই আর তোমার একটি চোখ চিরতরে নষ্ট হয়ে যায়। অপারেশন করে আমি আমার একটি চোখ তোমাকে দিয়ে দিই। এই ঘটনা আর কেউ জানে না এবং আমি কাউকে বলিনি।’ মায়েদের এই অফুরন্ত ভালোবাসার কাছে পৃথিবীর

সন্তানরা বাধা।

বৃদ্ধাশ্রমের ধারণাটা ক্রমেই আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করছে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, পশ্চিমা বিশ্বের সামাজিক আর সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় ওল্ড হোমগুলো অপরিহার্য হলেও আমাদের মাটির আঙিনায় তা শুধু বেমানানই নয়, এর নৈতিকতার দিকটিও বিবেচ্য বিষয়। একসময় সবকিছু বিসর্জন দিয়ে যে পিতা-মাতা সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়েছিলেন, আজ তাদের অনেকেই বড় একা ও অপােক্তয়। পুঁজিবাদী ধনী দেশগুলোয় ব্যক্তিস্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য হলো মূল চালিকাশক্তি। তাই ১৮ বছর পার হলেই নিজের পড়াশোনার খরচ নিজেই চালানো বা ভবিষ্যৎ গড়ার যেমন তাড়া থাকে, তেমনি অর্থ উপার্জনের পর পরিবারকে পাঠানোর প্রয়োজন নেই আর পরিবারের কেউ তা আশাও করবে না। অন্যের গলগ্রহ না হয়ে ওল্ড হোমের আশ্রয়ই তাই সেখানে জীবনের স্বীকৃত সমাধান।

কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক গতিশীল জীবনচর্চার অনুশীলন শুরু হয়ে গেলেও পারিবারিক নির্ভরশীলতা মোটেও কমে যায়নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বৃদ্ধাশ্রমের যে একেবারেই প্রয়োজন নেই, তা বলছি না। বাবা-মায়ের আর্থিক খরচ চালানোর সামর্থ্য যদি একেবারেই না থাকে, তখন হয়তো এটি বিকল্প ব্যবস্থা হতে পারে। নিঃসন্তান দম্পতির জন্যও এ ব্যবস্থা প্রয়োজন। তবে বৃদ্ধাশ্রম যেন কখনোই না হয় দায়িত্ব এড়ানোর হাতিয়ার। আমাদের দেশে এ পদ্ধতিটি স্বীকৃত কোন পদ্ধতি বা স্বাভাবিক কোন বিষয় হয়ে উঠার আগেই এ নিয়ে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, সামাজিক অনুশাসন, ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রসার, নৈতিক মূল্যবোধ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব।

 

লেখক : প্রকৌশলী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads