• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

আমরা মানবিক হব কবে

  • মামুন রশীদ
  • প্রকাশিত ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

মাহবুবকে মনে আছে? সেই যে, অনেক কাল আগে— স্বপ্নকে ধরার জন্য আকাশে উড়াল দিয়েছিল! বোয়িংয়ের চাকায় থেঁতলে যাওয়া মাহবুব! ভাগ্য ফেরাবে বলে দেশ ছেড়ে যেতে চেয়েছিল। চুপি চুপি উঠে পড়েছিল বোয়িংয়ের চাকার খোলসে। তারপর চাকার চাপ, ঊর্ধ্বাকাশে বাতাসের শূন্যতা, প্রচণ্ড ঠান্ডায় হিম হয়ে আসা নিষ্ঠুর পৃথিবী। মাহবুব, আহ্ মাহবুব! মাহবুব মানে তো একখণ্ড বাংলাদেশ। মাহবুব ঊর্ধ্বাকাশে যে স্বপ্নকে ধরতে গিয়েছিল, সেখান থেকেই হারিয়ে গেছে। কিন্তু মাহবুবরা কি হারিয়ে যায়? না যেতে পারে? মানুষেরা মরে গেলে নাকি নক্ষত্র হয়ে যায়, মাহবুব তো এক জ্বলজ্বল করে জ্বলা নক্ষত্র। মাহবুবরা হারিয়ে যায় না, ওরা রেখে যায় স্বপ্ন দেখতে চাওয়া মানুষের জন্য বিস্ময়। মাহবুবের কোনো পাসপোর্ট ছিল না। ছিল না কোনো ভিসা। তবু সে ভেবেছিল ভাগ্যকে ফেরাবে। তাই বিমানবন্দরের কড়া নিরাপত্তাকে ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়েছিল বিমানের চাকার খোলসের ভেতরে। সেখান থেকে সে আর ফিরতে পারেনি চেনা পৃথিবীতে। তার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারেনি। সংসারের চাকা ঘোরাতে পারেনি। রঙিন পৃথিবীর ঝলঝলে আলোকে নিয়ে আসতে পারেনি নিজেদের ঘরে। এরকম হাজারো মাহবুব প্রতিদিন স্বপ্ন ফেরি করতে দেশ ছাড়ে। এরকম হাজারো মাহবুবকে প্রতিদিন নানারকম লোভের ফাঁদে ফেলে হত্যা করা হয়। হাজারো মাহবুবের স্বপ্নকে গলা টিপে হত্যা করা হয়। ঠেলে দেওয়া হয় সাগরে— নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে। মাহবুব হয়তো কারো সাহায্য ছাড়াই বিমানের চাকা ধরে চলে যেতে চেয়েছিল স্বপ্নের দেশে। সেখানে শ্রমের বিনিময়ে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল সংসারে সুখ। মাহবুব পারেনি। কিন্তু মাহবুবের মতো হাজারো মাহবুব যখন পাসপোর্ট, ভিসা নিয়ে বৈধ পথেই ভাগ্যের চাকা ফেরাতে চায় শেষ সম্বলটুকুর বিনিময়ে, তাদেরও প্রতারণা আর লালসার কাছে বলি হতে হয়। সাগরে ভাসতে থাকা অসহায় মাহবুবদের কান্না আমাদের ছুঁয়ে যায় না। আর যায় না বলেই হয়তো প্রতিদিন মানব পাচারের মতো জঘন্য অপরাধ ঘটছে। পাচারকারীদের নিষ্ঠুরতার বিচার হয় না। দালালদের কেউ কেউ কখনো ধরা পড়লেও রাঘব-বোয়ালরা সবসময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে।

পরিজন ফেলে যারা নিজেদের ভাগ্য ফেরাতে ছুটে যায়, তারা শুধু নিজেদের ভাগ্যই ফেরাতে যায় না, তারা একই সঙ্গে আমাদের পুরো বাংলাদেশের ভাগ্যের চাকাই ঘোরাতে যায়। তাদের কষ্টার্জিত টাকায় বাড়ে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। আমরা ঋণ পাই, আমরা ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখি। মাহবুবরা যদি তাদের ঘামের থেকে উঠে আসা মুদ্রায় আমাদের ভান্ডার ভরিয়ে না দিত, তাহলে হয়তো একসময় আমরাও দেউলিয়া হয়ে যেতাম। আমাদের নামও হয়তো জিম্বাবুয়ে, গ্রিসের কাতারে উঠে আসত। অথচ তাদের প্রতি, আমাদের অর্থনীতিকে চাঙা রাখার এই কারিগরদের প্রতি আমাদের অবহেলা, আমাদের দায়িত্বহীনতা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। প্রবাসী শ্রমিকদের প্রতি আমাদের দায়িত্বহীনতার বড় প্রমাণ গত ছয়-সাত বছরে পৃথিবীর ৫৬টি দেশ থেকে আসা প্রায় ১৪ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশির লাশ। বৈধ ও অবৈধভাবে বিদেশ যাওয়া এসব প্রবাসীর অস্বাভাবিক মৃত্যু আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ করে। আমাদের বেদনাবিদ্ধ করে। চাকরি দেওয়ার নামে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে হত্যার অপরাধে অপরাধীরা শাস্তি পায় না। মধ্যযুগের দাস ব্যবসার আদলে মানব পাচার বন্ধ হয় না। মাহবুবদের স্বপ্ন চুরি করে, তাদের হত্যা করে অন্য পক্ষ সম্পদের পাহাড় গড়ে। আর মাহবুবদের মতো স্বপ্নবাজ তরুণদের হারিয়ে যেতে হয় বিস্মৃতির অতলে। কেন মাহবুবদের প্রতি আমাদের এত অবহেলা, এত দায়িত্বহীনতা? হাজার হাজার মাহবুব, যারা হারিয়ে যায়নি, হেরে যায়নি, যারা কোনো না কোনোভাবে দেশের সীমানা পেরিয়ে গেছে, যারা নিজেদের কষ্ট ভুলে আমাদের অর্থনীতি সচল রেখেছে, প্রবাস থেকে নিয়মিত টাকা পাঠিয়ে আমাদের অর্থনীতির গতিকে ধরে রেখেছে- তাদের প্রতি সামান্যতম কৃতজ্ঞতা বোধও কেন আমরা দেখাই না? কেন তাদের আসতে যেতে শঙ্খ বণিকের করাতের মতো কাটতে হবে? তাদের টাকায় আমরা বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দিচ্ছি, এই অপরাধ ঢাকতেই কি তাদের প্রতি পদে অবহেলা, অসম্মান? আমরা কি কখনোই মানবিক হয়ে উঠব না? নাকি মানবিক হতে আমরা জানি না! আজ মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার সময় এসেছে। সেই প্রত্যয় নিতে হবে আমাদের।

 

লেখক : সাংবাদিক ও কবি

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads