• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯
সুন্দরবন ও সেন্ট মার্টিনের আয়তন হ্রাস পাচ্ছে

সুন্দরবন ও সেন্ট মার্টিনের আয়তন হ্রাস পাচ্ছে

সংগৃহীত ছবি

মতামত

সুন্দরবন ও সেন্ট মার্টিনের আয়তন হ্রাস পাচ্ছে

  • আলম শাইন
  • প্রকাশিত ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

সুন্দরবন জাতীয় বনভূমির মর্যাদা পেয়েছে বহু বছর আগেই। আর সেখানেই বাস করে আমাদের জাতীয় পশু রয়েল বেঙ্গল টাইগার। বিষয়টা ভাবতে বেশ লাগে। আমাদের অহঙ্কার এ বনভূমি। এর অবস্থান দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্রমুখী সীমানার নিকটবর্তী গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদের মোহনায়। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ‘ম্যানগ্রোভ’ অরণ্য সুন্দরবন; দ্বিমত নেই এতে কারো। আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি, এ বন প্রকৃতির অপূর্ব সৃষ্টি এবং আমাদের জন্য বিশেষ দান। দুই বাংলাব্যাপী এ বনের বিস্তৃতি হলেও বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬,০১৭ বর্গকিলোমিটার। অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গ অংশের আয়তন ৩,৯৮৩ বর্গকিলোমিটার। এই শ্বাপদশঙ্কুল অরণ্যটি যুগ যুগ ধরে মানুষের কাছে এক রোমাঞ্চকর জঙ্গল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আর রোমাঞ্চকর বলেই হয়তো এ জঙ্গলের গুরুত্ব অপরিসীম পর্যটকদের কাছে। প্রকৃতির এ লীলাভূমি দর্শনের উদ্দেশ্যে প্রতি বছর হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটক ছুটে আসেন সুন্দরবন এলাকায়। ফলে পর্যটন খাতে আমরা প্রচুর বৈদিশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ পেয়ে থাকি। শুধু পর্যটন খাতেই নয় মৎস্য, মধু ও জ্বালানি কাঠ থেকে শুরু করে দৈনন্দিন ব্যবহূত বহুবিধ জিনিসের মাধ্যমে সরকার প্রচুর রাজস্ব অর্জন করে সুন্দরবন থেকে। অথচ আমাদের সেই গর্বের প্রতীক সুন্দরবন ক্রমান্বয়ে সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। বিভিন্নভাবেই সঙ্কুচিত হচ্ছে। বিশেষ করে বনের সীমারেখা কমে আসার প্রধান কয়েকটি কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নদী ভাঙন এবং স্থানীয় প্রভাবশালী কর্তৃক সুন্দরবন এলাকায় জেগে ওঠা চর দখল করে নেওয়া। দখল অংশের গাছগাছালি নিধনের মাধ্যমে বন সঙ্কুচিত হলেও ভূমিটুকু তবু থেকে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে বলা যায়, বনের পরিধি কমছে। এক্ষেত্রে নদী ভাঙন অন্যতম হিসেবে ধরা যেতে পারে। খবরের কাগজ মারফত জানা যায়, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে পণ্যবাহী নৌযান চলাচলের কারণে বিভিন্ন এলাকায় নদী ভেঙে যাচ্ছে, যা ভরা বর্ষায় প্রকট আকার ধারণ করে। এ ছাড়া প্রায়ই ঝুপঝাপ করে নদীর পাড় ভেঙে মাটি নদীর তলদেশে পৌঁছে যাচ্ছে। ফলে নদীও ভরাট হয়ে যাচ্ছে অনায়াসেই। যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে, পশুর ও ভোলা নদী। এক সময়ের উত্তাল পশুর ও ভোলা নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে স্থানীয় প্রভাবশালীরা ডিসিআরের নামে চর দখল করে নিয়েছিল বছর তিনেক আগে। অবশ্য প্রশাসন উদ্ধার করতে যথেষ্ট ভূমিকাও রেখেছিল। সেই সুবাদে ভূমিহীনরা গড়ে তুলছিল জনবসতি। যাতে করে আয়তনে ছোট হয়ে এসেছে আমাদের প্রিয় জাতীয় বনটির।

অপরদিকে দেশের সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত একমাত্র প্রবাল রাজ্য সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। দ্বীপটির অবস্থান বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্ব দিকে। আয়তন খুব বেশি নয়, মাত্র সাড়ে ৮ বর্গকিলোমিটার। জোয়ারের সময় আয়তন খানিকটা হ্রাস পেয়ে ৫ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়ায়। দ্বীপটির নামকরণ হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে। জনৈক ইংরেজ মি. মার্টিনের নামানুসারে দ্বীপের নামকরণ হয় ‘সেন্ট মার্টিন দ্বীপ’। এটি টেকনাফ উপজেলাধীন ইউনিয়ন। টেকনাফ থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার। দ্বীপের অধিবাসীর সংখ্যাও খুব বেশি নয়, পূর্বের শুমারি মোতাবেক ৫৫০০ জন। শিক্ষিতের হার শূন্যের কোটায়। এখানকার অধিকাংশ অধিবাসীই মৎস্যজীবী। এরা নিরীহ, দরিদ্র এবং শান্তিপ্রিয় মানুষ। কোনো ধরনের রাহাজানি কিংবা হানাহানির সঙ্গে জড়িত নয়। ফলে অদ্যাবধি এখানে খুন-খারাবির মতো বড় ধরনের কোনো অপরাধ সংগঠিত হয়নি। দ্বীপবাসীরা রক্ষণশীল হওয়াতে বাইরের মানুষ এসে এখানে বেলাল্লাপনা কাজকারবার করারও সুযোগ পায় না। ফলে সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে বলা যায় চির শান্তির দেশ। এ ছাড়া এখানে রয়েছে প্রকৃতির অজস্র সম্পদ। যার সঠিক ব্যবহার হলে জাতীয় জীবনে আমরা বিশেষভাবে উপকৃত হতাম।

আমাদের অনেকেরই জানা নেই, বিশ্বের দুর্লভতম প্রবাল রাজ্যের একটি হচ্ছে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। এখানে রয়েছে ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ২০০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৫ প্রজাতির দুর্লভ কাছিম, ১৫ প্রজাতির সাপ, ১৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ১২০ প্রজাতির পাখি (দেশি ও পরিযায়ী মিলিয়ে), ৫ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৫ প্রজাতির টিকটিকি-গিরগিটি, ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ১৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল। রয়েছে পাথুরে শিলা ও হরেকরকম শৈবালের রাজ্য। এ ছাড়া অসংখ্য নারিকেল গাছ এবং কেয়াবনসহ নানান ধরনের উদ্ভিদ রয়েছে। যার কারণেই সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে বলা হয়েছে বিশ্বের দুর্লভতম স্থানের একটি। বিশেষ করে এত স্বল্প আয়তনের আর কোনো স্থানে এমন নৈসর্গিক দৃশ্য ও বহুল প্রজাতির উদ্ভিদ বা জীব প্রজাতির সন্ধান পাওয়া যায় না। এতসব লোভনীয় কারণে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ইদানীং দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে বেশ আর্কষণীয় হয়ে উঠছে। জানা যায়, প্রতি বছর নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত এখানে প্রায় দেড় লাখ পর্যটকের আগমন ঘটে। নিঃসন্দেহে এটি আমাদের পর্যটন খাতের জন্য বিশেষ ইতিবাচক দিক। এতে আমাদের কারো দ্বিমত নেই বোধ করি। দ্বিমতটা হচ্ছে, পর্যটকদেরকে স্বাগত জানাতে গিয়ে নানান ধরনের কর্মকাণ্ডের ফলে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ পরিবেশগত সঙ্কটে পড়ছে। দ্বীপ ভ্রমণে গেলে যে জিনিসটি সর্বাগ্রে নজর কাড়ে তা হচ্ছে, বিলাসবহুল হোটেল-মোটেলসহ বেশকিছু পাকা-সেমিপাকা দরদালান। যা ছিল না বিগত এক যুগ আগেও। এসব গড়তে গিয়েই সেন্ট মার্টিনের মাটি খোঁড়াখুঁড়ি করতে হয়। ফলে ভরা বর্ষায় দ্বীপ ভাঙনের কবলে পড়ে। এতে করে সঙ্কুচিত হচ্ছে দ্বীপ। খুব ধীরলয়ে ঘটছে এটি।

এ ছাড়া পর্যটকদের সুবিধার্থে রাতের আঁধারকে দূর করতে জেনারেটর ব্যবস্থার দ্বারস্থ হতে হচ্ছে হোটেল ব্যবসায়ীদেরকে। যার ফলে রাতে দ্বীপে আশ্রয় নেওয়া অনেক প্রজাতির প্রাণী বা মাছ ভয়ে সটকে পড়ছে। বিশেষ করে বিশ্বের দুর্লভ প্রজাতির ‘অলিভ রিডলে টার্টল’ (জলপাইরঙা কাছিম) ভয়ে ডিম পাড়া থেকে বিরত থাকছে এবং অন্যত্র চলেও যাচ্ছে। বহুতল ভবন গড়ার হিড়িক অবলোকন করে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এসব ভবনের ওজন বহন করার সামর্থ্য ছোট্ট এ দ্বীপটির নেই। যার ফলে এটি যেকোনো সময়ে সমুদ্রে নিমজ্জিত হতে পারে। জানা গেছে, এটি একটি ভাসমান দ্বীপ। সুদূর মালয়েশিয়ার একটি দ্বীপের সঙ্গে এর সংযোগ রয়েছে। যতদূর জানা যায়, চামচাকৃতির একটি প্রবাল প্রাচীরের সঙ্গে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সংযোগ। সমুদ্রের গভীর তলদেশ দিয়ে প্রকৃতিগতভাবে এ সংযোগ স্থাপন হয়েছে। উল্লেখ্য, এ সংযোগ বাঁটটি প্রবালের জীবাশ্ম দিয়েই তৈরি। কাজেই অধিক ওজন বহনের ক্ষমতা নেই এটির। অধিক ভার বহনের কারণে যেকোনো সময় ভেঙে যেতে পারে বাঁটটি। আর সে ধরনের কিছু ঘটে গেলে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের অস্তিত্ব রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। কাজেই বিষয়টি মাথায় এনে এখানে বহুতল ভবন তৈরির বিপক্ষে অবস্থান নিতে হবে কর্তৃপক্ষকে। বিপক্ষে অবস্থান নিতে হবে অবৈধ পাথর উত্তোলনেরও। দেখা গেছে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়ীরা সুযোগ পেলেই মাটি খুঁড়ে বড় বড় পাথর উত্তোলন করে বহুতল ভবনের কারুকার্যে ব্যবহার করছে। যার ফলে দ্বীপটি তার পরিবেশগত ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে দ্রুততর। শুধু ব্যবসায়ীরাই নয়, পর্যটকরাও ছোট ছোট নুড়ি, শিলাপাথর, প্রবাল, শামুক-ঝিনুক কুড়িয়ে লুকিয়ে-চুকিয়ে নিয়ে আসছে আইনশৃঙ্খলা বহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে। যার তদারকি আরো জোরদার করা প্রয়োজন। এ ছাড়া পর্যটকদের মাধ্যমে পরিবেশের বহুবিধ ক্ষতি সাধন হচ্ছে। যেমন- পলিথিন, বিয়ারের কৌটা, কোমলপানীয় ও প্লাস্টিকের পানির বোতলসহ নানা ধরনের জিনিস ফেলে আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত করছে। অবস্থান নেওয়া পর্যটকরা রাতে বারবিকিউ’র আয়োজন করে উচ্চস্বরে গান বাজিয়ে দ্বীপে আশ্রয় নেওয়া প্রাণিকুলকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। এতে করে দ্বীপ প্রাণীশূন্য হয়ে যাচ্ছে।

তাই আমরা আশা করব কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে সোচ্চার ভূমিকা রাখবে। পর্যটকদের আগমনকে নিরুৎসাহিত না করে বরং সুন্দর সহনীয় নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে সুন্দরবন, সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে। আমাদের এ সামান্য প্রত্যাশা পূরণ হলে সুন্দরবন এবং সেন্ট মার্টিন দ্বীপ টিকে থাকবে আরো হাজার বছর।

 

লেখক : কথাসাহিত্যিক, বন্যপ্রাণীবিশারদ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads