• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

মতামত

ট্রাম্পের আংশিক পরাজয় না জনগণের বিজয়

  • অলোক আচার্য
  • প্রকাশিত ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলা টানা ৩৫ দিনের শাট ডাউনের অবসান হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ট্রাম্পের জিদের পরাজয় হয়েছে। ডেমোক্র্যাটদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে ট্রাম্প তার অনড় অবস্থান থেকে সরে আসেন। এই আংশিক অচলাবস্থার অবসান হওয়ায় দেশের ৮ লাখের বেশি সরকারি চাকরিজীবীর বেতন নিয়ে অনিশ্চয়তা কেটে গেছে। তবে আপাতত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার অবস্থান থেকে সরে এলেও দেয়াল নির্মাণের বিষয়ে তিনি সেই আগের অবস্থানেই রয়েছেন। তিনি দেয়াল নির্মাণে অর্থ ছাড় না দেওয়া হলে ফের এই ধরনের অচলাবস্থার সৃষ্টি করতেও পারেন। পৃথিবীর ক্ষমতাধর রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার মসনদে আসার পর থেকেই ট্রাম্প ছিলেন বিশ্বের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। ক্ষমতা গ্রহণের পরই অভিযোগ ওঠে মার্কিন মুলুকের নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের বিষয়ে। এ নিয়ে অবশ্য ট্রাম্প বরাবরই অস্বীকার করে গেছেন। রাশিয়ার সঙ্গে প্রথম দিককার সেই সুসম্পর্কও এখন নেই। গণমাধ্যমের সঙ্গেও সম্পর্ক সুখের নয় ডোনাল্ড ট্রাম্পের। সাংবাদিকদের সঙ্গে বার বার বিতর্কে জড়িয়েছেন। মার্কিন মুলুকের নির্বাচন নিয়ে এত সমালোচনা এর আগে সম্ভবত কোনো নির্বাচনে হয়নি। তারপর জলবায়ু ফান্ডে অর্থায়ন, অভিবাসী ইস্যু প্রভৃতি বিষয় নিয়ে একের পর এক সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন তিনি। নারী কেলেংকারি নিয়েও গত বছরের পুরোটা সময় মিডিয়ায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম খবর প্রকাশিত হয়েছে। সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া বা দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে বহুবার। বিশ্ব পরাশক্তির সঙ্গে কখনো সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে আবার পরমুহূর্তেই দেখা গেছে সমালোচনায় বিদ্ধ হচ্ছেন ট্রাম্প। গত বছরের পুরোটা সময়জুড়েই চীনের সঙ্গে বাণিজ্যর যুদ্ধ লেগে ছিল এ পরাশক্তির। শুল্ক এবং পাল্টা শুল্ক আরোপের ভেতর দিয়েই গেছে বছরের পুরোটা সময়। এতে যেকোনো পক্ষেরই মঙ্গল হয়নি তা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছেন। বরং বিশ্বের এই বড় দুই পরাশক্তির বাণিজ্যযুদ্ধ পরোক্ষভাবে বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা তৈরি করেছিল। তবে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে  সম্পর্ক উন্নয়নে ট্রাম্প ইতিবাচকভাবেই অগ্রসর হয়েছেন। প্রথম দিকে যেভাবে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়েছে তাতে বহুবার যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। শেষ পর্যন্ত দুই দেশ সাময়িক শান্ত হয়েছে। দুই দেশের জন্যই এটি বড় একটি কূটনৈতিক অগ্রগতি। মার্কিন লেখক সাংবাদিক মাইকেল উলফ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে ‘ফায়ার অ্যান্ড ফিউরিয়াস’ নামক বইটি ইতোমধ্যেই বিস্ফোরক বইয়ের খেতাব পেয়েছে। ট্রাম্প যে বেশ রাগী তা বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে জানা গেছে।

রাগী চরিত্রের এই মানুষটি যে শেষমেশ তার অবস্থান থেকে সরে এসেছেন এটা আপাত স্বস্তির বিষয়। কারণ দীর্ঘতম এই অচলাবস্থার কারণে দেশটি বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দফতর সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। এমনকি সেবাখাতগুলোও এই শাট ডাউনের কবল থেকে মুক্ত ছিল না। তিনি দেয়াল নির্মাণের অর্থ ছাড় দেওয়া না হলে বছরের পর বছর এই শাট ডাউন চালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। যদি সত্যিই এই অচলাবস্থা আরো দীর্ঘায়িত হতো তাহলে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষতিগ্রস্তই করবে। কিন্তু সমস্যা পুরোপুরি গেছে তা বলা যায় না। তবে বিশাল এক আর্থিক ক্ষতি যে এড়ানো গেছে তাতে সন্দেহ নেই। মার্কিন কংগ্রেসের বাজেট দফতরের দেওয়া তথ্যমতে দেয়াল নির্মাণের জন্য প্রেসিডেন্ট যে অর্থ চেয়েছিলেন তার চেয়ে দ্বিগুণ অর্থের ক্ষতি হয়েছে শাট ডাউনে। সুতরাং বলাই যায় যুক্তরাষ্ট্রের এই পরিস্থিতিতে এই বিপুল আর্থিক ক্ষতি হওয়া থেকে ট্রাম্প সরে এসেছেন। দেয়াল নির্মাণের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো দেশের মানুষের মতামত। ডেমোক্র্যাটরা মনে করছে দেয়াল নির্মাণের থেকে আরো অনেক জরুরি বিষয় রয়েছে। দেয়াল নির্মাণের বিষয়টি ট্রাম্পের নির্বাচনী ওয়াদা ছিল। একদিকে তার নির্বাচনী প্রতিজ্ঞা অন্যদিকে বিরোধীদের শক্ত মনোভাব শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা সময়ই বলে দেবে। তিনি তার সিদ্ধান্তে এতটাই অটল যে, তিনি জরুরি অবস্থা জারি করে মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ চালিয়ে যাওয়ারও হুমকি দিয়েছিলেন। তিনি এই দেয়াল নির্মাণের খরচ বাবদ অর্থ মেক্সিকোর কাছেও দাবি করেছিলেন। কিন্তু মেক্সিকো সে দাবি প্রত্যাখ্যান করে। তবে এ থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মেক্সিকো সীমান্তে তার দেয়াল নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত থেকে সহসাই পিছু হটছেন না। আর ডেমোক্র্যোটরা সহজেই ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত মেনে অর্থ ছাড় করাবেন বলেও মনে হয় না। তবে আপাতত যেহেতু সমস্যার একটা কূলকিনারা হয়েছে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ স্বস্তি ফেলতেও পারে। এতে ডেমোক্র্যাটরা যদি নিজেদের আংশিক বিজয় হয়েছে ভাবে তাহলে সেটা ভাবতে পারে। খোলা দৃষ্টিতে দেখতে গেলে বিষয়টি এমনই। ডেমোক্র্যাটদের কাছে ট্রাম্পের এক্ষেত্রে পরাজয় ঘটেছে বলা যায়।

আবার বিষয়টি যদি ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা যায়, তাহলে ট্রাম্প কিন্তু হেরে যাননি। কারণ এই অচলাবস্থার অবসান চেয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ জনগণ। আর সাধারণ জনগণই তো সকল ক্ষমতার উৎস। অন্তত একটা গণতান্ত্রিক দেশে তো বটেই। যেহেতু প্রেসিডেন্ট জনগণের সাময়িক দুর্দশার অবসান করেছেন তাই এটা তার পরাজয় হতে পারে না। বরং তার চিরাচরিত চরিত্র থেকে বেরিয়ে এসে তিনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

আবার এই মুহূর্তে ভেনিজুয়েলা নিয়ে বিশ্বের নজর রয়েছে। বিশেষ করে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর তো বটেই। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র আর অন্যদিকে রাশিয়া, চীন। এই পরাশক্তিগুলোর পেছনে আবার বড় বড় দেশের সমর্থন রয়েছে। তাই ভেনিজুয়েলার এই পরিস্থিতিতে বিজয় লাভ করাটা জরুরি। এটা এক প্রকার স্নায়ুযুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন দিচ্ছে ভেনিজুয়েলার স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট গুইদোকে। আর রাশিয়া-চীন শক্তি সমর্থন দিচ্ছে বিতর্কিত নির্বাচনে ক্ষমতায় বসা নিকোলাস মাদুরোকে। ২০১৩ সালে হুগো শাভেজের পর মাদুরো ক্ষমতায় বসেন। ভেনিজুয়েলায় রয়েছে তেলের বিশাল বাজার। যুক্তরাষ্ট্র যদি তার পছন্দের নেতাকে ক্ষমতায় বসাতে পারে তাহলে তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সুবিধাজনক হবে। কারণ মাদুরো এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাবে দেখিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য শাট ডাউন চালিয়ে যাওয়াটা সঠিক কাজ হতো না। এতে নিজ দেশের দ্বন্দ্বে বাইরের রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ দুর্বল হয়ে পড়ত। এখন যেহেতু মার্কিন মুলুকে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে সুতরাং ট্রাম্প এখন ভেনিজুয়েলার দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারবেন বলেই মনে হয়। তার হার-জিত যাই হোক জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে। যদিও ট্রাম্পের নিজের দলের কয়েকজন ট্রাম্পের এই সরে আসার সিদ্ধান্তকে ভালো চোখে দেখেননি, তারপরও এটা অবসানের দরকার ছিল।

 

লেখক : সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads