• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯
‘ক্ষমতা’র অনেক ক্ষমতা 

‘ক্ষমতা’র অনেক ক্ষমতা 

প্রতীকী ছবি

মতামত

‘ক্ষমতা’র অনেক ক্ষমতা 

  • মহিউদ্দিন খান মোহন
  • প্রকাশিত ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

‘ক্ষমতা’ শব্দটির মধ্যেই কেমন যেন একটি মাদকতা আছে, আছে ভিন্ন রকম শক্তি। এটা যিনি হাতে পান, তিনি বদলে যেতে পারেন মুহূর্তেই। এই ক্ষমতাকে ব্যবহার-অপব্যবহার করে তিনি নাম বদনাম দু’টোই কিনতে পারেন। প্রকৃতই ক্ষমতার অনেক ক্ষমতা। এর স্পর্শে নিরীহ মানুষও হয়ে উঠতে পারে ভয়ঙ্কর। আবার এটা এমনই একটি পরশ পাথর যে, এর ছোঁয়ায় অনেকে পরিণত হন শ্রদ্ধার পাত্রে। যারা প্রাপ্ত ক্ষমতাকে ব্যবহার করে জনহিতকর কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন, তারা সমাজে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিতে পরিণত হন। আর যারা সে ক্ষমতাকে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠী স্বার্থে ব্যবহার করেন, অপরের ওপর জুলুম নির্যাতন চালান, এর অপব্যবহার করে প্রতিশোধ পরায়ণ হন, তারা ধিকৃত হন মানুষের কাছে। তবে, ক্ষমতাধর ওইসব মানুষকে মানুষ সমীহ করেও চলে। কারণ, তা না হলে তিনি তার ক্ষমতার শক্তি দেখিয়ে যে কারো জীবন ওষ্ঠাগত করে তুলতে পারেন। এ রকম নজিরের অভাব নেই আমাদের সমাজে।

গত ৪ ফেব্রুয়ারি দেশ রূপান্তরে ক্ষমতা সংক্রান্ত বিপরীতধর্মী যে দুটি খবর বেরিয়েছে, সচেতন মহলে তা আলোচিত হচ্ছে। পত্রিকাটির শেষ পৃষ্ঠায় একই কলামে ওপরে নিচে প্রকাশিত খবর দুটি সবারই দৃষ্টিতে পড়েছে। প্রথম খবরটি এসেছে দ্বীপজেলা ভোলা থেকে। খবরে বলা হয়েছে, ফেসবুকে তর্ক-বিতর্কের ঘটনাকে কেন্দ্র করে জেলার বোরহাউদ্দিন উপজেলা নির্বাহী অফিসার পরীক্ষার হলে প্রতিশোধ নিয়েছেন এক এসএসসি পরীক্ষার্থীর ওপর। পরীক্ষার্থীর নাম রুবাইয়াত ওয়াদুদ গল্প। সে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। ভোলা প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে ওই পরীক্ষার্থী অভিযোগ করেছে, মাস কয়েক আগে বোরহানউদ্দিন উপজেলা প্রশাসন আয়োজিত সাহিত্য সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার বিচারকার্যে পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ তুলে গল্প ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিল। ওই স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে ইউএনওর সঙ্গে কমেন্টে তার বািবতণ্ডা হয়। এক পর্যায়ে ইউএনও গল্পকে দেখে নেওয়ারও হুমকি দিয়েছিলেন। তারই জের হিসেবে গত ৩ ফেব্রুয়ারি পরীক্ষার হলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে কক্ষ পরিদর্শক গল্পের এমসিকিউ উত্তরপত্র টেনে নিয়ে ১৫ মিনিট বসিয়ে রাখে। এরপর সে মানসিক চাপে আর লিখতে পারেনি। ইউএনও আরো ক্ষতি করতে পারে- এ আশঙ্কায় এবার সে বাকি পরীক্ষা আর দেবে না বলেও জানিয়েছে। এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘পরীক্ষার হলে কথা বললে খাতা আটকে রাখা যায়’। যদিও গল্প পরীক্ষার হলে কথা বলেছিল কি না, বা কোনো অসদুপায় অবলম্বন করেছিল কি না খবরে তার উল্লেখ নেই। গল্পের বাবা ঘটনার বিচার দাবি করে ভোলা জেলা প্রশাসকের কাছে দরখাস্ত দিয়েছেন। জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, তিনি অভিযোগ পেয়েছেন। তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জেলা প্রশাসক কী ব্যবস্থা নেবেন সেটা পরের বিষয়। কিন্তু এটা তো সত্যি যে, ইউএনওর ক্ষমতার দাপটের অসহায় শিকার শিক্ষার্থী গল্পের শিক্ষাজীবনের একটি বছর নষ্ট হয়ে গেল। তার জীবনের এ ক্ষতি কী পূরণ করা সম্ভব হবে?

দ্বিতীয় ঘটনাটি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার। গত ৩ ফেব্রুয়ারি দুপুরে সংশ্লিষ্ট অফিসটি পরিদর্শনে যান ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। এ সময় সেখানে সেবা নিতে আসা এক ব্যক্তি ওই শাখার সার্ভেয়ার পরমেশ্বর চাকমার বিরুদ্ধে হয়রানির বিভিন্ন অভিযোগ মন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেন। মন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে অভিযুক্তকে ডেকে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ফাইল আটকে রেখে মানুষকে ক্ষমতা দেখাও? ফাইল আটকে রাখার প্রবণতা কেন? তোমরা অনেক বড় অফিসার হয়ে গেছ? হোয়াট ননসেন্স ইজ দিস। আমি এসব সহ্য করব না।’ মন্ত্রী ওই সার্ভেয়ারকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘সরকার বেতন দিচ্ছে। তারপরও হারামের পয়সা খাচ্ছেন? একজন মানুষের কত টাকা দরকার?’

একজন মানুষের কত টাকা দরকার-এ প্রশ্নের যেন কোনো উত্তর নেই। কারণ কিছু মানুষকে যেভাবে টাকার পেছনে হন্যে হয়ে ছুটতে দেখা যায়, তাতে প্রশ্নটা উঠেতেই পারে- লোকটার আর কত টাকা দরকার। টাকার জন্য কিছু মানুষ যেন পাগলপারা হয়ে যায়। কারো কারো আচরণ দেখে তো মনে হয় যে, একমাত্র অর্থ-কড়ি কামাই বুঝি তাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। আর সে লক্ষ্য অর্জনে নেই কোনো নীতি-নৈতিকতার বালাই, নেই ন্যায়-অন্যায় বাছ-বিচার। মনুষ্যত্বও পরাজিত হয় টাকার লোভের কাছে। মন্ত্রীর হস্তক্ষেপে চট্টগ্রামের ওই ভুক্তভোগী হয়তো তার সমস্যার সহজ সমাধান পেয়ে থাকবেন। কিন্তু একজন মন্ত্রী তো আর সারা দেশের ভূমি অফিসগুলোয় প্রতিদিন যেতে পারবেন না। ফলে দেশব্যাপী সাধারণ মানুষ এসব কর্মকর্তার লোভের বলি হতেই থাকবে। তবে, আশার কথা, মন্ত্রী এ ধরনের অনিয়ম সহ্য করবেন না বলেছেন। তার এ হুশিয়ারি যদি অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এতটুকু হূৎকম্পও সৃষ্টি করে থাকে, তাহলেও অনেক কাজ হতে পারে।

ক্ষমতার বিষয়টি এখানেও প্রাসঙ্গিক। কেননা, মন্ত্রীর ক্ষমতা আছে তাই তিনি সার্ভেয়ারকে ধমক দিতে পেরেছেন। এমনকি দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থাও নিতে পারেন। কিন্তু যাদের সে ক্ষমতা নেই, তারা কী করবে? তাদের সবকিছু নীরবে সহ্য করা ছাড়া আর গত্যন্তর কী? আজ এদেশে চলছে ক্ষমতা প্রদর্শনের লাগামছাড়া প্রতিযোগিতা। যে যেখানে পারছে তার ক্ষমতা দেখিয়ে চলেছে। এটা যে শুধু বর্তমানেই ঘটছে তা নয়, অতীতেও ঘটেছে। ভবিষ্যতেও যে ঘটবে না তারও নিশ্চয়তা দেওয়া যাচ্ছে না।

ক্ষমতা ও দায়িত্বের মধ্যে বিদ্যমান পার্থক্যটি আমরা প্রায়শই ভুলে যাই। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বকে আমরা ক্ষমতা বলে থাকি। প্রকৃত অর্থে তা যে যা কিছু করার ক্ষমতা নয়, এটা আমাদের বোধে আসে না। জনগণ যাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেন, তারা এক ধরনের ক্ষমতা পান। আসলে ওটা ক্ষমতা নয়, দায়িত্ব। জনগণ একটি দলকে পাঁচ বছরের জন্য রাষ্ট্র তথা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করে। জনগণের দেওয়া সে দায়িত্বকে আমাদের দেশের দায়িত্বশীলরা ক্ষমতাপ্রাপ্তি বলে মনে করেন। আর তাই কারণে অকারণে তাদের সে ক্ষমতার বহর প্রদর্শনের এক অসুস্থ প্রবণতায় আক্রান্ত হন। এ ক্ষমতা দেখাতে গিয়ে তারা অনেক সময় মানুষের চরম ক্ষতি করে ফেলেন। ক্ষমতার জাদুকাঠি হাতে পাওয়ায় তারা যা খুশি করার অবাধ লাইসেন্স পেয়ে যান। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যারা থাকেন বা ক্ষমতার আশপাশে থাকেন, তাদের দাপটে অনেক সময় সাধারণ মানুষ হয়ে পড়ে অসহায়। 

ক্ষমতা এমনই একটি জিনিস যা মানুষকে বেপরোয়া করে তুলতে পারে। অনেক ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে আমরা দেখেছি ধরাকে সরা জ্ঞান করতে। মানুষকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে। তবে, তারাও এক সময় ক্ষমতা হারিয়ে পথে নেমে এসেছেন। ক্ষমতাধর ব্যক্তির কথা না হয় তুলে রাখলাম। ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের আশপাশের লোকদের কথাবার্তা আচরণ কি আমাদের বিস্মিত করে না? মাস কয়েক আগে রাজধানীতে রাস্তায় গাড়ি রাখাকে কেন্দ্র করে কোনো এক মহাপরাক্রমশালীর আত্মীয়া এক পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে যে অসভ্য আচরণ করেছিল তা হয়তো সবারই মনে আছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া সে ঘটনা বুঝিয়ে দিয়েছিল ‘বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দর’ প্রবাদটি কতটা সত্য। ঠিক ওই রকম আরেকটি ঘটনা প্রায় একই বা কাছাকাছি সময়ে ঘটেছিল চট্টগ্রামে। উভয় স্থানে ক্ষমতা প্রদর্শনকারীর কমন হুমকি ছিল-‘আমাকে চিনিস’? না, তাকে বা তাদের তো পরিচয় দেওয়ার আগে কারো পক্ষেই চেনা সম্ভব নয়। কারণ তাদের গায়ে বা পোশাকে তো আর লেখা থাকে না তারা কে বা কোন ক্ষমতাশালী ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজন! কেন এমনটি ঘটে? এ প্রশ্নের একমাত্র উত্তর বোধহয় ‘প্রশ্রয়’। হ্যাঁ, ক্ষমতাশালীদের প্রশ্রয়ই তাদের স্বজন-সুহূদদের অমন ঔদ্ধত্য প্রদর্শনে সাহস জোগায়। তারা প্রশ্রয় দেন বলেই পথে ঘাটে শোনা যায় ‘আমাকে চিনিস’ ধমকের আওয়াজ। আজ আমাদের সমাজে যেসব অনিয়ম অরাজকতা বিরাজ করছে তার বড় অংশই ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে।

আমদের ‘ক্ষমতাধর’রা আইন-আদালতেরও হাতের নাগালের বাইরে থেকে যান। ব্যাংক কিংবা শেয়ারবাজার থেকে লুট হয়ে যায় হাজার হাজার কোটি টাকা, কিন্তু হোতারা থেকে যায় অধরা। মনে পড়ে বছর কয়েক আগে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির তদন্ত কমিটির প্রধান দেশের বিশিষ্ট ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদের সে মন্তব্য। তিনি তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করলেও হোতাদের নামোল্লেখ করতে পারেননি। বলেছিলেন তারা অত্যন্ত ক্ষমতাধর। কী নিষ্ঠুর পরিহাস! ক্ষমতার কারণে দোষীদের নামোল্লেখও করা যায় না! ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নেওয়া দুর্বৃত্তরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর পাঁচ-দশ হাজার টাকা কৃষি বা ক্ষুদ্রঋণ নেওয়া দরিদ্র লোকটির হাতে পড়ে হাতকড়া। এখানেও কাজ করে ক্ষমতার খেলা। দরিদ্র কৃষক বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীটির জায়গামতো ভেটো দেওয়ার বা প্রভাব খাটানোর ক্ষমতা নেই, তাই তাকে যেতে হয় শ্রীঘরে। আর নামে বেনামে যারা ব্যাংকের তহবিল শূন্য করে বিদেশে পাচার করে হাজার হাজার কোটি টাকা, তাদের অনেক ক্ষমতা। সে ক্ষমতা দিয়ে তারা সংশ্লিষ্ট সব মহলকে যেমন ম্যানেজ করতে পারে, তেমনি নিজেরাও থাকতে পারে নিরাপদ।

অনেকদিন আগে একটি বাংলা সিনেমা দেখেছিলাম। নামটি স্মরণে আসছে না। সে ছবিটিতে খলনায়ক সাদেক বাচ্চুর একটি ডায়ালগ ছিল-‘ক্ষমতা রে ক্ষমতা, রক্তে আমারে টানে।’ হ্যাঁ, ক্ষমতার সঙ্গে রক্তের একটা সম্পর্ক আছে। ক্ষমতা কারো কারো রক্ত গরম করে দেয়, যে গরমের শিকার হতে হয় কোনো না কোনো ক্ষমতাহীন মানুষকে। কিন্তু ক্ষমতাশালী ওই মানুষগুলো এটা বিস্মৃত হয়ে যান যে, ক্ষমতা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে পাওয়া কোনো তালুকদারি নয়। দায়িত্ব বা ক্ষমতা যা-ই বলি না কেন, তা কচুপাতার পানির মতো টলটলায়মান। একটু এ কাত সে কাত হলেই টুব্বুস করে পড়ে যেতে পারে। আর বহু ক্ষমতাধরকে দেখা গেছে পপাৎ ধরণীতল হতে। চোখের সামনে এসব দৃষ্টান্ত থাকা সত্ত্বেও কেউ কেউ ক্ষমতার বড়াই করেন। চালচলনে ড্যাম কেয়ার ভাব। কিন্তু এভাবে আর কতদিন চলবে? ক্ষমতাশালীদের ক্ষমতার অপব্যবহারের রাশ কি কখনোই টেনে ধরা সম্ভব হবে না?

 

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads