• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

ঝুঁকি ও সাহসের রাজনীতি

  • মোহাম্মদ আবু নোমান
  • প্রকাশিত ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

আওয়ামী লীগ চায় বিএনপি ঝুঁকি ও সাহস নিয়ে আন্দোলন করুক! এই ঝুঁকি, সাহস ও আন্দোলন বলতে কী বুঝায়! মারামারি, আইনশৃঙ্খলা লঙ্ঘন, পেশিশক্তি প্রদর্শন, ঘাত-সংঘাত, জ্বালাও-পোড়াও, প্রশাসন ও ক্ষমতাসীনদের সাথে রক্তারক্তি? সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘দুঃসময়ে বিএনপির নেতারা ঝুঁকি নিতে না পারলে দলের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তিনি বিএনপিকে উদ্দেশ করে বলেন, ঝুঁকি নেওয়ার সাহস নেই, কী রাজনীতি করে?’ বিএনপি কী করছে, কী করবে, বিএনপির ‘ভরাডুবি’ কী কী কারণে, এসব নিয়ে কারো কারো যেন ঘুম হারাম! বিএনপির পরাজয়ের কারণগুলো এক শ্বাসেই বলা যায়। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের জয়ের কারণ ও রহস্যটা কেউ কি কোনোদিন বলবেন?

পেশিতন্ত্র, ক্ষমতার স্বাদ ও লোভ মানুষকে বিবেকহীন করে দেয়। সাম্রাজ্যমোহ আর ক্ষমতার লোভে মানবিকতা, স্বদেশ প্রেম, স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা আমাদের অস্তিত্ব থেকে হারিয়ে গেছে। অথচ জাতিকে ধোঁকা ও বোকা বানানোর কোনো সুযোগ নেই। কারো পায়ে শিকল পরিয়ে দিয়ে যদি বলা হয়, পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, এবার সর্বোচ্চ গতিতে দৌড়াও! তাহলে তার অবস্থা তো হবে— হাত-পা বেঁধে দিয়ে সাঁতার কাটতে বলার মতো অবস্থা! যখন কোনো রাষ্ট্র ও প্রশাসনযন্ত্র সর্বসাধারণের যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ের আন্দোলনের ওপর অস্ত্র তাক করে, সেখানে ‘ঝুঁকি নেওয়ার সাহস’ কার কতটুকু থাকতে পারে?

মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বিএনপি নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য, মতামতের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘ওবায়দুল কাদের এখন স্বেচ্ছায় বিএনপির উপদেষ্টা হতে চলেছেন। খামাখা আওয়ামী লীগে থেকে তার লাভ কী? বরং ওবায়দুল কাদেরকে বিএনপিতে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি, বিএনপির দরজা খোলা আছে।’ কথা একটাই, বেশি কথা কখনোই শ্রুতিমধুর লাগে না। রাজনৈতিক নেতারা বরাবরই উসকানিমূলক ভাষা ব্যবহার করে থাকেন। এ দেশ সবার। এটাই সব দলের নেতাদের মনে রাখা উচিত। ক্ষমতার অন্ধমোহে, লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে চর দখলের মতো গায়ের জোরে ভোটের নামে নাটকের অভিনয় ’৭৯ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত সব দলই করেছে। এতে সাধারণ জনগণের জানমালের ব্যাপক হানি হয়েছে।

এখন একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশে প্রয়োজন একটি শক্তিশালী বিরোধী দল। পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির জাগরণের প্রয়োজন রয়েছে। গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যেসব অভিযোগ রয়েছে, তাও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ আছে কি? গণতন্ত্রে সংঘাত ও অস্থিতিশীলতার কোনো স্থান নেই। কিন্তু বাংলাদেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে সংঘাত ও অস্থিতিশীলতা সর্বদাই অনিবার্য। সাধারণ মানুষ এখনো বিএনপি ও আওয়ামী লীগ— এই বড় দু’দলের ওপর পূর্ণ আস্থা অর্জন করতে পারেনি, এখানেই ঘটেছে বিপত্তি।

দেশের সব দলেই কতিপয় সুবিধাভোগী (আবাসিক!) স্তাবকরা তাদের আসন পোক্ত করার জন্য বিরোধী দলকে নিয়ে অপ্রয়োজনীয় কথার খই ফুটান। এ ধরনের ফুলটাইম ‘ইয়েস স্যার’ মার্কা তোষামোদী দেশের ও দলের জন্য অমঙ্গলজনক। এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও মাঝেমধ্যে নেতাদেরকে কথাবার্তায় সংযত হতে বলেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দলীয় এবং প্রশাসনিক পর্যায়ে একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি। ব্যাপক কাজ দেখভালের দায়িত্ব তার হাতে। দেশে চলমান উন্নয়নের যে বিশাল বা মেগা প্রজেক্ট আছে, এসবে খুব বেশি খরচ হয়ে যাচ্ছে এবং কাজের সময়ের সঙ্গে সমন্বয় থাকছে না। কাজ শেষ করতে দীর্ঘসূত্রতা হচ্ছে। সময় পার হয়ে যাওয়ার পর আবার সময় বাড়ানো হচ্ছে। এতে আবার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। অনেক সময় দুর্নীতির কারণে খরচ বেড়ে যায়। দুর্নীতি যে হয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সমস্ত উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে দুর্নীতির বিষয়টি জড়িয়ে আছে। এসব জায়গায় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর নিখুঁত তদারকি জরুরি।

নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে উদ্দেশ করে মোহন লালের সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘রাজাকে রাজনীতি জানতে হয়।’ বিএনপিকেও বুঝতে হবে, রাজনীতিতে চাল দিতে না জানলে রাজনীতি করা যায় না। বিএনপি ইতোপূর্বে দেশ শাসনে এমন কিছু করেনি যে, জনগণ তাদের ধরে নিয়ে চেয়ারে বসিয়ে দেবে। তাদের জনপ্রিয়তা যতটুকু লক্ষণীয় তা আওয়ামী লীগের ব্যর্থতার কারণ। বিএনপি এখন মাতাহারা, ভ্রাতাহারা, নেতাহারা, ঘরহারা, অর্থহারা! এক কথায় বিএনপি আজ সর্বহারা! যদি কখনো কিছু হয়, সেই ভরসায় বসে না থেকে, মধু খেতে হলে বিএনপিকে গোড়ালি শক্ত করে মৌচাকে হাত দিতে হবে। কিছুটা হলেও জনসমর্থন থাকার পরও বিএনপি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।

নির্বাচনী পরাজয়কে বিএনপির ইতিবাচকভাবে চিন্তা করতে হবে। এই পরাজয় দল পুনর্গঠনের বিশাল সুযোগ এনে দিয়েছে বিএনপির সামনে। বাংলাদেশে কোনো দলই নিজেদের জনবান্ধব রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে দাঁড় করাতে পারেনি। বিএনপি এই সুযোগ নিতে পারে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারাবাসের এক বছর পূর্ণ হলো ৭ ফেব্রুয়ারি। গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হয়ে কারাবন্দি হন তিনি। দলীয় প্রধানের মুক্তির জন্য আইনি পথে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি বিএনপি। রাজপথের আন্দোলনেও কাঙ্ক্ষিত ফল পায়নি বিএনপি। বিএনপিকে এখন আগে নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে।

রাজনীতিতে সুস্থ ধারার প্রতিযোগিতা থাকবে; কিন্তু প্রতিহিংসা নয়। মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার চেয়ে মধ্যম মানসিকতার দেশ হওয়া অনেক বেশি জরুরি। প্রতিহিংসাপরায়ণই যদি রাজনীতির লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে শুধু যে গণতন্ত্রই ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাই নয়, জনগণ ক্ষমতাচ্যুত হবে, সর্বসাধারণের প্রত্যাশাও হোঁচট খাবে।

 

লেখক : সাংবাদিক

abunoman1972@gmail.com

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads