• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
থমকে গেল কালের কলস

কবি আল মাহমুদ

ছবি : সংগৃহীত

মতামত

থমকে গেল কালের কলস

  • আজহার মাহমুদ
  • প্রকাশিত ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

আল মাহমুদ আর আজহার মাহমুদ। শেষের দিকে মাহমুদটা মিল বলে ছোট থেকেই অনেক আনন্দিত ছিলাম। এখনো অনেককে এ কথাটি বলে নিজেকে একটু বড় করতে চেষ্টা করি। যদিও এটা মনের ভেতর থেকে ভালোবাসার ছলে বলা। কিন্তু কবি সম্পর্কে কিছু বলার আগে তার সম্পর্কে কিছু জানা আমাদের জরুরি। আমরা যাকে কবি আল মাহমুদ নামে চিনি, তার আসল নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বাংলা সাহিত্যের এ কিংবদন্তি। ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্প লেখক, শিশুসাহিত্যিক এবং সাংবাদিক। তার বাবার নাম মীর আবদুর রব ও মায়ের নাম রওশন আরা মীর। ব্যক্তিগত জীবনে সৈয়দা নাদিরা বেগমের সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে রয়েছে।

শিক্ষাজীবনে তিনি কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি থানার সাধনা হাইস্কুল এবং পরে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড হাইস্কুলে পড়ালেখা করেন। মূলত এ সময় থেকেই তার লেখালেখির শুরু। তবে কবির শৈশব কেটেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ১৯৫০-এর দশকে যে কয়েকজন লেখক বাংলা ভাষা আন্দোলন, জাতীয়তাবাদ, রাজনীতি, অর্থনৈতিক নিপীড়ন এবং পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারবিরোধী আন্দোলন নিয়ে লিখেছেন, তাদের মধ্যে আল মাহমুদ একজন।

১৯৫৪ সাল অর্থাৎ ১৮ বছর বয়স থেকে তার কবিতা প্রকাশ পেতে থাকে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকা এবং কলকাতার নতুন সাহিত্য, চতুষ্কোণ, ময়ূখ ও কৃত্তিবাস এবং বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় লেখালেখির সুবাদে ঢাকা-কলকাতার পাঠকদের কাছে তার নাম সুপরিচিত হয়ে ওঠে এবং তাকে নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়। কাব্যগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তর’ (১৯৬৩) সর্বপ্রথম তাকে স্বনামধন্য কবিদের সারিতে জায়গা করে দেয়। এরপর কালের কলস (১৯৬৬), সোনালি কাবিন (১৯৭৩), মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো (১৯৬৯) কাব্যগ্রন্থগুলো তাকে প্রথম সারির কবি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে।

সংবাদপত্রে লেখালেখির সূত্র ধরে ১৯৫৪ সালে মাহমুদ ঢাকায় পা রাখেন। সমকালীন বাংলা সাপ্তাহিক পত্র-পত্রিকার মধ্যে কবি আবদুর রশীদ ওয়াসেকপুরী সম্পাদিত ও নাজমুল হক প্রকাশিত সাপ্তাহিক কাফেলায় লেখালেখি শুরু করেন। তিনি পাশাপাশি দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় প্রুফ রিডার হিসেবে সাংবাদিকতা জগতে পদচারণা শুরু করেন। ১৯৫৫ সালে তিনি দৈনিক মিল্লাতে সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়াংশে সক্রিয় থেকে তিনি আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে, চেতনায় ও বাক্ভঙ্গিতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সম্মুখ সমরেও অংশ নিয়েছেন এ কবি। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত সরকারবিরোধী হিসেবে পরিচিত দৈনিক গণকণ্ঠ (১৯৭২-১৯৭৪) পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। সম্পাদক থাকাকালীন এ সময় সরকারের বিরুদ্ধে লেখার কারণে এক বছরের জন্য কারাবরণ করেন।

১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি গল্প লেখার দিকে মনোযোগী হন। ১৯৭৫ সালে তার প্রথম ছোটগল্প গ্রন্থ ‘পানকৌড়ির রক্ত’ প্রকাশিত হয়। পরে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের সহ-পরিচালক পদে নিয়োগ দেন। দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনের পর তিনি পরিচালক হন। পরিচালক হিসেবে ১৯৯৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন।

তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার শহরমুখী প্রবণতার মধ্যেই ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ আবহ, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের জীবনপ্রবাহ এবং নরনারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহকে তার কবিতায় অবলম্বন করেন। নারী ও প্রেমের বিষয়টি তার কবিতায় ব্যাপকভাবে এসেছে। উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী হিসেবে নারীর যৌনতা, আকাঙ্ক্ষা ও ভোগের লালসাকে তিনি শিল্পের অংশ হিসেবেই দেখিয়েছেন। আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলিত কাঠামোর মধ্যে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগ তার অনন্য কীর্তি।

১৯৬৮ সালে ‘লোক লোকান্তর’ ও ‘কালের কলস’ নামে দুটি কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। তার সবচেয়ে সাড়া জাগানো সাহিত্যকর্ম ‘সোনালি কাবিন’; যার কারণে আজো তাকে সোনালি কাবিনের কবি বলা হয়। কবির প্রথম উপন্যাস ‘কবি ও কোলাহল’ ১৯৯৩ সালে বের হয়।

তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো- লোক লোকান্তর (১৯৬৩), কালের কলস (১৯৬৬), সোনালি কাবিন (১৯৭৩), মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো (১৯৭৬), আরব্য রজনীর রাজহাঁস, বখতিয়ারের ঘোড়া, অদৃশ্যবাদীদের রান্নাবান্না, দিনযাপন, দ্বিতীয় ভাঙ্গন, একটি পাখি লেজ ঝোলা, পাখির কাছে ফুলের কাছে। আল মাহমুদের গল্পে ছিল অন্যরকম এক আনন্দ। তার উল্লেখযোগ্য গল্পের মধ্যে রয়েছে- গল্পসমগ্র, প্রেমের গল্প, যেভাবে বেড়ে উঠি, কিশোরসমগ্র, কবির আত্মবিশ্বাস, কবিতাসমগ্র, কবিতাসমগ্র-২, পানকৌড়ির রক্ত, সৌরভের কাছে পরাজিত, গন্ধ বণিক, ময়ূূরীর মুখ, না কোন শূন্যতা মানি না, নদীর ভেতরের নদী, উপমহাদেশ, বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ, উপন্যাস সমগ্র-১, উপন্যাস সমগ্র-২, উপন্যাস সমগ্র-৩, তোমার গন্ধে ফুল ফুটেছে (২০১৫), ছায়ায় ঢাকা মায়ার পাহাড় (রূপকথা), ত্রিশেরা, উড়াল কাব্য।

ব্যক্তিজীবনে কবি আল মাহমুদ অসংখ্য পুরস্কার এবং সম্মাননা পেয়েছেন। বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৮), জয় বাংলা পুরস্কার (১৯৭২), হুমায়ুুন কবীর স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭২), জীবনানন্দ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭২), কাজী মোতাহার হোসেন সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৬), কবি জসীম উদ্দীন পুরস্কার, ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬), একুশে পদক (১৯৮৬), নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৯০), ভানুসিংহ সম্মাননা পদক (২০০৪), লালন পুরস্কার (২০১১) সহ আরো অনেক পুরস্কার তিনি পেয়েছেন।

কবি আল মাহমুদ বেশ কিছুদিন ধরে নিউমোনিয়াসহ বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯-এ তিনি চিরতরে বিদায় নিলেন। তিনি ছিলেন একটি অধ্যায়, একটি চলন্ত ইতিহাস এবং জীবন্ত সাহিত্য কোষ। আর তাই ভাষার মাসেই তাকে চিরবিদায় দিতে হলো আমাদের। কবির বিদায়কালে তার লেখা কবিতা পড়ে তাকে চিরবিদায় জানালাম-

প্রেম কবে নিয়েছিলো ধর্ম কিংবা সংঘের স্মরণ?

মরণের পরে শুধু ফিরে আসে কবরের ঘাস।

যতক্ষণ ধরো এই তাম্রবর্ণ অঙ্গের গড়ন

তারপর কিছু নেই, তারপর হাসে ইতিহাস।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক

azharmahmud705@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads