• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
প্রসঙ্গ : সরকারি হাসপাতাল ও চিকিৎসাসেবা

সরকারি হাসপাতাল ও চিকিৎসাসেবা

প্রতীকী ছবি

মতামত

প্রসঙ্গ : সরকারি হাসপাতাল ও চিকিৎসাসেবা

  • নাজমুল হোসেন
  • প্রকাশিত ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

ডাক্তার, নার্স ও দালালদের দৌরাত্ম্যে জিম্মি হয়ে পড়েছেন সরকারি হাসপাতালের রোগীরা। এমন পরিণতিতে হাসপাতালগুলোতে আসা রোগীদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার নামে চলমান নৈরাজ্য ও নির্মমতা দেখার যেন কেউ নেই। দেশের ৬৪টি জেলা শহরের বেশিরভাগ হাসপাতালে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও জনবল নেই। আর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ক্লিনিকগুলোর অবস্থা আরো নাজুক। এসব হাসপাতালে প্রয়োজনের তুলনায় এমবিবিএস চিকিৎসক নেই, আবার কোনো কোনো হাসপাতালে একাধিক এমবিবিএস কর্মরত। যেখানে এমন ডাক্তারের স্বল্পতা, সেখানে ডাক্তারের সহকারী ও ওয়ার্ড বয় জনসাধারণের স্বাস্থ্যসেবার একমাত্র ভরসা। হাসপাতালগুলোতে শুধু ডাক্তার সঙ্কট নয়; বরং সিনিয়র স্টাফ নার্সসহ অন্যান্য বিভাগের লোকবলও চরম সঙ্কটে।

জেলা সদর ও উপজেলার বেশিরভাগ হাসপাতালে এক্স-রে, মেশিন, ডেন্টাল যন্ত্রপাতি, প্যাথলজিস্ট যন্ত্রপাতি, আর্ট বিভাগের যন্ত্রপাতি ইত্যাদিসহ বহু নাম-না-জানা মূল্যবান চিকিৎসাসামগ্রী ব্যবহারের অভাবে অকেজো হয়ে পড়ছে। ফলে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা সাধারণ মানুষ ওইসব চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিভাগীয় শহরের সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতেও রয়েছে বেহাল দশা। একটু ভালো আর বিনামূল্যে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা পেতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বড় আশা নিয়ে দরিদ্র রোগীরা হাসপাতালে আসেন। কিন্তু এখানে এসেই তাদের পড়তে হয় বিপাকে এবং নানা বিড়ম্বনায়। হাসপাতালের প্রবেশ গেট থেকে শুরু করে কেবিন-বেড পর্যন্ত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে একশ্রেণির দালাল চক্র। নানা প্রলোভন, যেমন— দ্রুত ডাক্তার সেবা পাইয়ে দেওয়া, প্রয়োজনীয় ওষুধ, থাকার জন্য কেবিন ইত্যাদি দেখিয়ে তারা দরিদ্র ও সহজ সরল রোগীদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এমনকি এদের চক্রে পড়ে অনেকে সর্বস্বান্ত হয়ে তবে ফিরছেন। অর্থাৎ বিষয়টা অনেকটা এমনই- আগে টাকা পরে চিকিৎসাসেবা। এদের খপ্পরে পড়ে অনেককেই চিকিৎসাসেবা তো দূরের কথা, উল্টো দ্বিগুণ অসুস্থ হয়ে কখনো হাসপাতালের বারান্দায় শুয়েও কাতরাতে দেখা যায়। এসব দালালই এই পর্ব শেষে আবার সরকারি মেডিকেলের কাজের হতাশাপূর্ণ বর্ণনা দিয়ে প্রাইভেট ডাক্তারদের কাছে চিকিৎসা নিতে উদ্বুদ্ধ করেন। অভিযোগ আছে, এরা সরকারি ডাক্তারদের দ্বারা নিয়োজিত ও নিয়ন্ত্রিত আর রোগীপ্রতি এসব দালালকে ডাক্তাররা কমিশন দিয়ে থাকেন।

এমনও দেখা গেছে, রোগী দেখার সময় ডাক্তাররা বিভিন্ন মিটিংয়ে ব্যস্ত থাকেন। দুপুরের খাবারের আগেই ডাক্তারসহ নার্সরা বিরতিতে চলে যান। নির্দিষ্ট সময়ের অনেক পরেও তাদের দেখা মেলে না। ভুক্তভোগী রোগীদের অভিযোগ, ডাক্তাররা তাদের সরকারি কর্মক্ষেত্রের চেয়ে নিজের ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। আরো একটি উল্লেখযোগ্য চিত্র হচ্ছে, ডাক্তাররা কর্তব্যরত থাকা অবস্থায় বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিদের ঢালাও উপস্থিতি। দামি গিফট কিংবা বড় ধরনের সুবিধা পাওয়ার আশায় অনেক সময় ওইসব প্রতিনিধির সঙ্গে ডাক্তারদের গল্প ও আলাপ-চারিতায় মেতে উঠতে দেখা যায়। তাদের এই কার্যক্রমের মাধ্যমেও লাইনে অপেক্ষমাণ রোগীদের নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। ডাক্তারদের অবহেলা ও অনুপস্থিতির সুযোগে নার্স, ওয়ার্ড বয় ও আয়ারাই হয়ে ওঠেন সর্বেসর্বা। রোগী দেখা থেকে শুরু করে অস্ত্রোপচার পর্যন্ত করছেন অবলীলায়। সুযোগ-সুবিধাহীন সরকারি হাসপাতালে একশ্রেণির ডাক্তার, নার্স, আয়া-কর্মচারীদের চরম দুর্ব্যবহারের শিকার হতে হয় অসহায় রোগীদের। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীসহ অন্য রোগীরা পর্যাপ্ত ওষুধ থাকা সত্ত্বেও যথাযথ ওষুধ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন। ডাক্তারদের লেখা স্লিপ নিয়ে ওষুধ আনতে গেলেই দু-একটি সস্তা ওষুধ দিয়ে বলা হয় বাকিগুলো স্টোরে নেই, তাই বাইরে থেকে কিনতে হবে। অথচ বাইরের ফার্মেসিতে গেলেই দেখা যায় ওইসব ওষুধের অগ্নিমূল্য। এতসব দামি ওষুধ তাহলে যায় কোথায়? দেশের বেশিরভাগ চিকিৎসকের বাণিজ্যিক মন-মানসিকতার কবলে পড়ে সাধারণ মানুষ সরকারি চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না। এসব যন্ত্রণা থেকে মুক্তির আশায় নিকটস্থ বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে সেবা নিতে গিয়েও সাধারণ রোগীরা পড়েন নতুন হতাশা ও যন্ত্রণায়। উন্নত চিকিৎসার নামে চাকচিক্যের ওইসব ক্লিনিকে ভালো চিকিৎসার নামে চলছে গলাকাটা বাণিজ্য। সাধারণ রোগীরা মূলত চিকিৎসকদের নামিদামি ডিগ্রি দেখে চিকিৎসা নিতে গিয়ে বিপাকে পড়েন।

ডাক্তারদের অতিরিক্ত ফি, প্রয়োজনীয় ওষুধের সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় ওষুধ, ঊর্ধ্ব মূল্যের টেস্ট ফি, বেড ভাড়া দিয়েই ধারদেনা করে আসা অসহায় রোগীদের পকেট খালি হচ্ছে। এসব চার্জ তারা নিজেদের খেয়াল খুশিমতোই বাড়াচ্ছেন। তাছাড়া রোগীকে দরকারি ও অদরকারি প্যাথলজি টেস্টের জন্য লম্বা স্লিপ দিয়ে মনোনীত ক্লিনিক কিংবা ল্যাবরেটরি থেকে পরীক্ষা করার পরামর্শ দেন। অন্য কোথাও থেকে করলে সেগুলো অগ্রহণযোগ্য। এখানেও রয়েছে কমিশন বাণিজ্য। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়মনীতি আর হুশিয়ারির কোনো কিছুতেই পরোয়া নেই হাসপাতালগুলোর। আবার কথিত অভিজাত হাসপাতালগুলোর চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক বা কর্তৃপক্ষের বাণিজ্যিক নীতিই মুখ্য হয়ে ওঠে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর তথ্যানুযায়ী জানা যায়, সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৫ শতাংশ দুর্নীতি হয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে, ২৪ দশমিক ৯ শতাংশ জেনারেল হাসপাতালে ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০ দশমিক ৭ শতাংশ।

অথচ উন্নত দেশের মতো আমাদের দেশেও রয়েছে উন্নত চিকিৎসাসেবা। বড় বড় ও জটিল রোগের অপারেশন করার মতো সরকারি ব্যবস্থা ও আধুনিক যন্ত্রপাতিও এদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে রয়েছে। তাহলে কেন রোগীরা এতসব চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন? বর্তমান সরকার চিকিৎসাসেবা খাতে অনেক বড় বাজেট রেখে আসছেন বিগত সময় থেকে। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মেডিকেল কলেজ স্থাপন, হাসপাতালগুলোতে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা, অসংখ্য ডাক্তার নিয়োগ ইত্যাদি কমবেশি সব ব্যবস্থা থাকলেও সেই হিসেবে নেই চিকিৎসাসেবা। প্রতিনিয়তই দেখা যাচ্ছে বার বার ডাক্তারদের অবহেলা, কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিতির চিত্র দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে।

সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এসব ডাক্তারকে চাকরি ছাড়ারও হুশিয়ারি দিয়েছেন। সরকারি হাসপাতালে দালালদের উৎখাত ও ডাক্তারদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে মনিটরিং সেল জোরদার করাসহ কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং পাশাপাশি ডাক্তাররা যেসব যৌক্তিক সমস্যায় জর্জরিত, সেগুলোকেও আমলে নিতে হবে। এ ছাড়া অন্যান্য আনুষঙ্গিক সমস্যার সমাধানকল্পে দ্রুতই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে কার্যকর উদ্যোগ নিতে অনুরোধ জানাচ্ছি। তবেই সাধারণ জনগণের শতভাগ স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া নিশ্চিত হবে।

 

লেখক : প্রকৌশলী

হধুসঁষযঁংংবহ—ুধযড়ড়.পড়স

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads