• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

তবে কি অভয়া মুখার্জিকেই দরকার 

  • মহিউদ্দিন খান মোহন
  • প্রকাশিত ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

অনেকটা নীরবেই পার হয়ে গেল সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারওয়ার ও মেহেরুন রুনির সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী। মৃত্যুবার্ষিকী না বলে এটাকে হত্যাবার্ষিকী বলাই শ্রেয়। কেননা ওটা কোনো স্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ছিল না। রাতের অন্ধকারে কে বা কারা শয়নকক্ষে প্রবেশ করে অত্যন্ত নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল ওই দম্পতিকে। তারপর পেরিয়ে গেছে সাত বছর। পুলিশ বা গোয়েন্দা সংস্থা কোনো রকম কূলকিনারা করতে পারেনি। কবর থেকে একাধিকবার তাদের লাশ তোলা হয়েছে। ময়না তদন্ত হয়েছে। ডিএনএ টেস্ট করা হয়েছে। কিন্তু রহস্যের কুয়াশা সরিয়ে সত্য উদঘাটন করতে পারেনি। হত্যাকারীরা রয়ে গেছে রহস্যপর্দার অন্তরালে। তার ফলে পুলিশ আজো চিহ্নিত করতে পারেনি এ বর্বর জোড়া খুনের হোতাদের। কেন পারেনি সে এক রহস্যময় ব্যাপার। অনেকে বলেন, আমাদের পুলিশ পারে না এমন কোনো কাজ নেই। তারা বহু বড় বড় ঘটনার রহস্য উন্মোচন করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সাগর-রুনির ঘটনায় তারা কেমন যেন অপারগ হয়ে পড়েছে। মনে পড়ে, ১৯৮৩ কি ৮৪ সালে গুলিস্তানে সোনালী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখায় এক রাতে ব্যাংক ডাকাতি হয়েছিল। ডাকাতরা ব্যাংকের দারোয়ানকে হত্যা করে ডাকাতি করেছিল। হত্যা বা ডাকাতির কোনো ক্লুই ছিল না। সবাই ধরে নিয়েছিল এ ঘটনার রহস্য বোধহয় অনুদঘাটিতই থাকবে। কিন্তু সম্ভবত মাস খানেকের মধ্যে পুলিশ সে ঘটনার রহস্য উন্মোচনে সক্ষম হয়েছিল। ধরা পড়েছিল ডাকাতি ও হত্যার সঙ্গে জড়িতরা। এই তো মাত্র বছর তিনেক আগে গুলশান এলাকায় খুন হলেন এক ব্যক্তি। কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু অনুসন্ধান করতে করতে পুলিশ ঠিকই খুঁজে পেয়েছিল খুনিকে। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের ধারণা, পুলিশ যদি আন্তরিকতা ও কোনো ধরনের চাপের সম্মুখীন না হয়ে তদন্ত করে, তাহলে যে কোনো অপরাধের রহস্য উদঘাটন ও অপরাধীদের চিহ্নিত করা অসম্ভব কাজ নয়।

আমাদেরই পুলিশ বাহিনীর এক সাবেক সদস্য (ইন্সপেক্টর) তার চাকরি জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি স্মৃতিচারণমূলক বই লিখেছেন। বইটির নাম ‘কেস হিস্ট্রি-১’। লেখকের নাম হামিদুল হক ছানা। তিনি ওই বইতে বিভিন্ন ঘটনা তদন্তের বিস্তারিত কাহিনি তুলে ধরেছেন। কীভাবে ক্লুবিহীন ঘটনার রহস্য উদঘাটন করেছিলেন, সেসবের রোমাঞ্চকর বর্ণনা রয়েছে ওই বইটিতে। একটি ঘটনা মনে পড়ছে এ মুহূর্তে। তেজগাঁও বা ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশনে এক রাতে দুই পুলিশ কনস্টেবলের রাইফেল ছিনতাই হয়ে যায়। কনস্টেবল দুজনকে উদ্ধার করা হয় অচেতন অবস্থায়। কোনো ক্লু নেই। কনস্টেবল দুজনও কিছু বলতে পারছেন না। সে তদন্তভার এসে পড়ে তখনকার সাব-ইন্সপেক্টর হামিদুল হক ছানার ওপর। তিনি বুঝতে পারছিলেন না কোথা থেকে শুরু করবেন। তদন্ত শুরু করলেন ঘটনাস্থল পরিদর্শনের মধ্য দিয়ে। কুড়িয়ে পেলেন পেপসিকোলার কয়েকটি কর্ক (ঢাকনা)। শুরু হলো তদন্ত। এরপর তিনি বর্ণনা করেছেন কীভাবে সেই পেপসিকোলা বিক্রেতার দোকানের সন্ধান পেয়েছিলেন, কীভাবে সেই সূত্র ধরে তিনি একটি পরিত্যক্ত খালের ময়লাযুক্ত পানির নিচ থেকে রাইফেল দুটি উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, ওই রাইফেল ছিনতাই ঘটনার সূত্র ধরে তিনি এর মূল হোতা তখনকার দুর্ধর্ষ ডাকাত মকিম গাজীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, ডাকাত মকিম গাজীকে তিনি তিনবার গ্রেফতার করেছিলেন। এজন্য তাকে নিতে হয়েছিল চরম ঝুঁকি। বর্তমানে মকিম গাজী ১৩২ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে কয়েদখানায় দিনযাপন করছে।

এ ধরনের অনেক ঘটনার উল্লেখ করা যাবে, যেসব ঘটনায় কোনো তথ্য-প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও আমাদের পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনী ডাকাতি বা খুনের ঘটনার রহস্য উন্মোচন করে অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেছে। অপরদিকে শুরু থেকেই সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এর যথেষ্ট কারণও ছিল। তারা দুজনই ছিলেন সুপরিচিত সাংবাদিক। অনেক চমকপ্রদ রিপোর্ট প্রকাশ করে তারা দৃষ্টি কেড়েছিলেন দেশবাসীর। সঙ্গত কারণেই তাদের খুনের ঘটনা দেশব্যাপী চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। এ খুনের পেছনে কী কারণ থাকতে পারে, খুনের মোটিভ কী তা নিয়ে দেশবাসীর কৌতূহলের অন্ত ছিল না। সবাই ব্যথিত হয়েছিলেন এ দম্পতির নৃশংস খুনের ঘটনায়। বিশেষত তাদের একমাত্র সন্তান মেঘের কথা ভেবে অনেকেই অশ্রুসিক্ত হয়েছেন। বলা প্রয়োজন, ওই খুনের ঘটনার একমাত্র সাক্ষী মেঘ। চার বছর বয়সী একটি বালক অমন একটি রোমহর্ষক ঘটনা দেখে থাকলেও তা স্মরণে রেখে খুনিদের শনাক্ত করা সম্ভব ছিল না।

কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, সাত বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত এ আলোড়ন সৃষ্টিকারী হত্যাকাণ্ডের সুরাহা করা গেল না কেন। পুলিশের কাছ থেকে মামলাটির তদন্তভার অর্পিত হয়েছিল র্যাবের ওপর। তারাও পারেনি। সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে এমন অনেক মামলাই অমীমাংসিত থেকে যাওয়ার নজির রয়েছে। তবে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে সে ধরনের যুক্তি গ্রহণযোগ্য?

সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের সপ্তম বর্ষপূর্তিতে বেসরকারি টিভি চ্যানেল একাত্তর টিভির টক শো ‘একাত্তর সংযোগে’ সেদিন উপস্থিত হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট সাংবাদিক ইকবাল সোবহান চৌধুরী এবং মাছরাঙা টিভির বার্তা সম্পাদক রেজোয়ানুল হক। আলোচনার একপর্যায়ে রেজোয়ানুল হক জানান, তারা গোয়েন্দা সংস্থার বাইরে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে ওই নির্মম হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বেশিদূর এগোতে পারেননি। কেন পারেননি- এর জবাবে তিনি বলেছেন, তারা বাধাগ্রস্ত হয়েছিলেন। তবে কাদের দ্বারা তারা বাধাগ্রস্ত হয়েছিলেন তা তিনি খোলাসা করেননি। তিনি এটাও উল্লেখ করেন যে, দৈনিক যুগান্তর এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশের পর হঠাৎ তা ছাপা বন্ধ করে দিয়েছিল। রেজোয়ানুল হক বলেছেন, তারা চেয়েছিলেন তদন্ত কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাকে সহযোগিতা করতে। কিন্তু তারা সেটা পারেননি। ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, বর্তমান সরকার যে কোনো ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তে বিশ্বাসী এবং সেটাই করতে চায়। এ জন্য একটু বিলম্ব হচ্ছে। তবে এই একটু বিলম্ব সাত বছর কি না- উপস্থাপিকার এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বিগত বিএনপি সরকারের শাসনামলে সংঘটিত ২১ আগস্টের গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলেন, তখন ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজিয়ে যেনতনভাবে তদন্ত রিপোর্ট তৈরির চেষ্টা করা হয়েছিল। তাই সত্যিকার ঘটনা উদঘাটনে একটু বিলম্ব হচ্ছে। আলোচনার একপর্যায়ে তিনি এও বলেন যে, হয়তো শিগগিরই তদন্ত রিপোর্ট পাওয়া যাবে। অনুষ্ঠানে একজন পুলিশ কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন। তবে এ বিষয়ে তার বক্তব্য কারোরই মনঃপূত হয়েছে বলে মনে হয় না। তার কথাবার্তা অনেকটা ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র মতো ছিল। বিশেষত তিনি বলতে পারছিলেন না, মামলাটির তদন্ত কবে নাগাদ শেষ হতে পারে বা আদৌ তা শেষ হবে কি না। শেষ পর্যন্ত পিলে চমকানো এই হত্যাকাণ্ডটির তদন্ত রিপোর্ট কোনোদিন পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে অনেকেরই সংশয় রয়েছে।

সর্বশেষ গত ১৭ ফেব্রুয়ারি মামলাটির তদন্ত রিপোর্ট আদালতে জমা দেওয়ার তারিখ নির্ধারিত থাকলেও তা হয়নি। আগামী ৩১ মার্চ তা দাখিলের জন্য নতুন তারিখ দিয়েছেন আদালত। উল্লেখ্য, এ নিয়ে সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া তারিখ ৬৩ বার পেছালো। এটি একটি রেকর্ডও বটে!

রহস্যময় ঘটনার তদন্ত বা তথ্যানুসন্ধান নিয়ে বিশ্বে অনেক গোয়েন্দা কাহিনির জন্ম হয়েছে। গোয়েন্দা কাহিনি লিখে কেউ কেউ বিশ্বজোড়া খ্যতিও অর্জন করেছেন। অপরাধ বিজ্ঞানে বলা হয়ে থাকে, খুনি খুন করার পর তার মনের অজান্তেই অকুস্থলে কোনো না কোনো প্রমাণ বা চিহ্ন রেখে যায়। সে সূত্র ধরে এগোলে গোয়েন্দারা একসময় আসল অপরাধীকে ধরে ফেলতে সক্ষম হন। পৃথিবী-বিখ্যাত গোয়েন্দা কাহিনির জনক স্যার আর্থার কোনান ডয়েল। তিনি সৃষ্টি করছেন ‘শার্লক হোমস’ নামের এক বিস্ময়কর চরিত্র; যিনি কিনা যে কোনো জটিল সমস্যার সমাধানে সক্ষম ছিলেন। শার্লক হোমসের গোয়েন্দা অভিযানের কাহিনি শিশু যুবা বৃদ্ধ সবারই প্রিয়। পশ্চিমবঙ্গের ডা. নীহার রঞ্জন গুপ্তের সৃষ্টি গোয়েন্দা ‘কিরীটি রায়’। খুন ধর্ষণ ডাকাতিসহ বিভিন্ন প্রমাণহীন ঘটনার রহস্য উন্মোচনে পারঙ্গম এই কিরীটি রায় রহস্যোপন্যাসপ্রেমীদের কাছে পরিচিত নাম। আমাদের দেশে কাজী আনোয়ার হোসেনের অনবদ্য সৃষ্টি মাসুদ রানা। গোয়েন্দা কাহিনি নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র বা টিভি সিরিয়ালও দর্শকপ্রিয় হয়ে থাকে। বর্তমানে ভারতীয় বাংলা চ্যানেল স্টার জলসার ‘জয়কালী কলকাত্তাওয়ালী’ সিরিজটি বিপুল দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। সিরিজটির মুখ্য চরিত্রের মহিলার নাম অভয়া মুখার্জি; যিনি প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর হিসেবে নানা ধরনের জটিল ঘটনার তদন্ত করে অপরাধীদের ধরতে পুলিশকে সাহায্য করে থাকেন। সিরিজগুলোতে দেখা যায়, অভয়া মুখার্জি একটি ঘটনার রহস্য উদঘাটনে কত না পরিশ্রম করেন, সৃষ্ট বাধা অতিক্রম করেন।

আমার ধারণা, তদন্তকারী বা তদন্তকারীরা ভয়-ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে সাহসের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করলে ঘটনার রহস্য লুক্কায়িত থাকতে পারে না। আমাদের চৌকষ গোয়েন্দারা কেন এখন পর্যন্ত এই হত্যাকাণ্ডটির রহস্য উদঘাটন করতে পারলেন না- এ প্রশ্নের যেন কোনো জবাব নেই। এ নিয়ে এক সুহূদের সঙ্গে আলাপ করলে তিনি ব্যঙ্গ করেই বললেন, ‘শেষ পর্যন্ত হয়তো কলকাতা থেকে অভয়া মুখার্জিকেই আনতে হবে’।

 

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads