আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। আমরা সবাই বাংলাভাষী। বাংলায় কথা বলি, বাংলায় গাই, বাংলায় লিখি, বাংলায় পড়ি। কামার, কুমোর, তাঁতি— সবার এ যেন প্রাণের ভাষা। আমাদের মাতৃভাষা বাংলার ইতিহাস পাঠে আমরা জানতে পারি, রসুল (সা.)-এর ওফাতের পর ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর রাজত্বকালে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার শুরু হয়। আর যারা সুদূর মক্কা-মদিনা থেকে এ দেশে ইসলাম প্রচার করতে এসেছিলেন, তাদের মাতৃভাষা ছিল কারো আরবি, আবার কারো ফারসি। সুতরাং তারা তাদের ইসলাম প্রচারের স্বার্থে এদেশের সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা শিখে ইসলামের বাণী পৌঁছাতে শুরু করেছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে, এই সময়টা ছিল ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ। সে হিসেবে আমাদের ভাষার সূচনাকাল ৬৫০ খ্রিস্টাব্দকেই ধরে নিতে পারি।
১২০৪ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি বাংলা বিজয় করলে এদেশের মানুষ রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা রাষ্ট্রীয়ভাবে শাহী মর্যাদাপ্রাপ্ত হয়। মোটামুটিভাবে বলা যায়, বাংলা ভাষার বিকাশ শুরু হয়েছিল এ সময়টা থেকেই। সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ ছিলেন এ দেশের একজন স্বাধীন সুলতান। তিনি আরবি-ফারসি ভাষার পাশাপাশি সংস্করণ এবং হিন্দি ভাষা থেকে বহু বই বাংলায় অনুবাদ করিয়ে বাংলা ভাষাকে মর্যাদার আসনে সমুন্নত করেন। কথিত আছে, তিনি বাংলা অনুবাদকদের পাণ্ডুলিপির ওজনের সমান মেপে সোনার মোহর পারিশ্রমিক দিতেন। বাংলা ভাষার ব্যাপক চর্চা এই সময়টায় শুরু হলেও অনেক ঘাত-প্রতিঘাতও বাংলাকে নিয়ে চলতে থাকে।
১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে পলাশীর আমবাগানে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হলে বাংলার স্বাধীনতা চলে যায় ইংরেজদের হাতে। দুইশ বছর ইংরেজরা পাক-ভারত উপমহাদেশ শাসন করেছিল। তখনই নেমে আসে বাংলা ভাষার ওপর দুর্যোগ। ইংরেজরা এদেশের মানুষ, বিশেষ করে মুসলমানদের শিক্ষিত করে তোলার উদ্দেশ্যে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম বাংলার রাজধানী কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপন করে। কলেজ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরসহ অন্যান্য পণ্ডিত যেসব বাংলা বই-পুস্তক রচনা করেন, তা ছিল সংস্কৃতের মতোই। শুধু সংস্কৃতের অনুস্বর-বিসর্গ বাদে যে বাংলা বই-পুস্তক চালু হলো তা রীতিমতো আর সাধারণের জন্য রইল না। হয়ে গেল উচ্চ শ্রেণির জন্য এক আভিজাত্য পূরণের ভাষা। আগের ভাষার সঙ্গে এ ভাষার কোনো মিলই পাওয়া গেল না। আরবি-ফারসি-তুর্কি শব্দ বাংলার সঙ্গে যোগ হয়ে যে একটি শক্তিশালী ভাষার রূপ বাংলা ভাষায় পেয়েছিল, তা একেবারে বাদ হয়ে গেল। কিন্তু ভাষার নির্মাতারা বসে থাকেননি। তারাও সহ্য করেননি বাংলা ভাষার এমন দুর্দশা। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে বাংলার হূত গৌরব ফিরিয়ে আনতে অনেক পরিশ্রম করে গেছেন তাদের লেখনী চালিয়ে। তার মধ্যে আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা আমাদের অহঙ্কার ও গর্বের। এই ভাষাকে ঘিরেই আমাদের সব চিন্তা-চেতনা, আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, আমাদের স্বপ্ন দেখা। তাই যখনই এই ভাষার ওপর এসেছে আঘাত, তখনই এদেশের মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছে। ব্রিটিশের কবল থেকে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলো। আমরা ছিলাম তদানীন্তন পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দা। পাকিস্তানি শাসকরা আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখের ভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলার পরিবর্তে উর্দু করতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘তমদ্দুন মজলিশ’ নামক একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। এই সংগঠনই প্রথম ভাষার দাবি পেশ করে সেই সময়। এখানে যোগ দেন তৎকালীন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখকরা। পাকিস্তান সৃষ্টির ঠিক এক মাসের মাথায় ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা কলেজের সেই ছাত্রাবাস ‘নূপুর ভিলায়’ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রথম একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয় ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর সভাপতিত্বে। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে একটি জনসভায় ঘোষণা করলেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ আর তখনই বাংলার জনগণ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে।
এভাবেই ১৯৫২ সালে খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঢাকায় এসে ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে এক জনসভায় ঘোষণা দেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ যে নাজিমুদ্দিন ১৯৪৮ সালে বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবি মেনে নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেন তার এ ঘোষণা বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে সবার কাছে চিহ্নিত হয়। ওই বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিবাদেই ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। বাংলা ভাষার সমমর্যাদার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। এ সময় গঠিত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল, জনসভা ও বিক্ষোভ মিছিল আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়। এসব কর্মসূচির আয়োজন চলার সময় সরকার ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে সমাবেশ-শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় আবুল হাশিমের (১৯০৫-৭৪) সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভা হয়। ১৪৪ ধারা অমান্য করা হবে কি-না এ প্রশ্নে সভায় দ্বিমত দেখা দেয়, তবে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভাঙার সঙ্কল্পে অটুট থাকে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুসংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে মিছিল শুরু করেন। দুপুর পার হয়ে বেলা তখন বাজে তিনটি। এমন সময় শুরু হলো পুলিশের বেপরোয়া গুলিবর্ষণ। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল রফিক, সালাম, বরকতসহ আরো অনেকে। শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। শোকাবহ এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন অব্যাহত ছিল। ওই বছরই পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অনুমোদনের মাধ্যমে এই আন্দোলন তার লক্ষ্য অর্জন করে। ১৯৫২ সালের পর থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার জন্য বাঙালিদের সেই আত্মত্যাগকে স্মরণ করে দিনটি উদযাপন করা হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনকে একটি মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করে।
আজ আমরা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের গর্বিত জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছি। এ বছর ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের মাতৃভাষা আন্দোলনের সাতষট্টি বছর পূর্ণ হলো। আমরা আমাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা সংগ্রাম-আন্দোলনে রক্তের মাধ্যমে ভাষাকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। এটা যেমন আমাদের গর্ব, তেমনি অহঙ্কারও। ২১ ফেব্রুয়ারি তথা ভাষা আন্দোলন তাই আমাদের পথের দিশারী। বাংলা ভাষা আন্দোলনের সাতষট্টি বছর পূর্তি উপলক্ষে আমরা আবার শপথ নেব আমাদের কাজে-কর্মে, চিন্তা-ভাবনায় আমাদের প্রাণের ভাষা মায়ের ভাষা বাংলার শুদ্ধ চর্চার। আমরা প্রাণভরে গাইব আবার— ‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা।’
লেখক : নিবন্ধকার