বেশ কিছুদিন আগের কথা। কানে হেডফোন গুঁজে এফএম রেডিও শুনছিলাম। কী জানি একটা অনুষ্ঠান চলছিল, আজ আর মনে নেই। তবে অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে গান চলছিল। গানটা শেষ হতেই শোনা গেল উপস্থাপকের কণ্ঠ। আমি তার কথা শুনে তো হতবাক! সে বাংলা বলছে না ইংরেজি বলছে সেটা বুঝতে পারাটা প্রায় দুঃসাধ্য। বাংলা কথার মাঝে ইংরেজি আবার ইংরেজি বাক্যের মাঝে টুকটাক বাংলা বলছে। এবং কথাগুলো এত দ্রুত বলছে যে, সেটাকে ভাষার দূষণ বললেও বোধহয় ভুল হবে না।
প্রায়ই দেখা যায়, এরকম ভাষার বিকৃতি, ভাষার দূষণ। আমরা বোধহয় খুব করে ভুলতে বসেছি যে, আমাদের মাতৃভাষা অর্জনের গৌরবময় ইতিহাসটা। শুধু মাতৃভাষার জন্য রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল এদেশের তরুণরা। বিশ্বের ইতিহাসে আমাদের মতো এত বড় ত্যাগ স্বীকার করে আর কোনো জাতি ভাষা অর্জন করেনি এবং সেই ইতিহাসটা পুরো বিশ্ব জানে। অথচ আজ নিজের দেশেই সেই মাতৃভাষা যেন অবহেলিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দেখলেও বোঝা যায় কীভাবে বাংলা ভাষা বিকৃত করা হচ্ছে। বাংলা নয় বরং আমরা বুঝতে পারছি, বাংলিশে খুব করে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি এ প্রজন্ম। একটা ভাষার মধ্যে আরেকটা ভাষা জুড়ে দেওয়া, একটা পূর্ণাঙ্গ শব্দকে সংক্ষেপে উচ্চারণ করাটা যেন এখনকার প্রজন্মের কাছে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে আমরা যাচ্ছেতাইভাবে আমাদের বাংলা ভাষার ব্যবহার করছি। ভাইকে বলছি ‘ব্রো’ বোনকে বলছি ‘সিস’! আরো কত কী! অথচ আমরা কি একবারও ভেবে দেখেছি, একনাগাড়ে পাঁচ মিনিট মাতৃভাষায় কথা বলতেও অনেকের কপালের ঘাম ঝরে যায়।
এদেশের বিভিন্ন এফএম রেডিওর কিছু কিছু অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা শুনলে তো গা শিউরে ওঠে! তাদের উচ্চারণ ও বাচনভঙ্গি রীতিমতো ভয় জাগানিয়া! এসব অনুষ্ঠানের প্রভাব পড়ছে আমাদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে। তাদের কাছে যাচ্ছে ভুল বার্তা। বাস্তবে এসে এ প্রজন্মের কিছু ছেলেমেয়েরা সেসব অনুসরণ করার চেষ্টা করছে। কথা বলার সময় বাংলা বাক্যের মধ্যে ইংরেজি শব্দ, ইংরেজির মধ্যে বাংলার সংমিশ্রণ ঘটাচ্ছে। বার্তা আদান-প্রদান হচ্ছে বাংলিশে, সেখানে কিছু কিছু শব্দ বাক্য আবার এতটাই সংক্ষেপ যে মাঝে মাঝে সেটা বুঝতেও খানিকটা সময় লেগে যায়।
রাস্তাঘাটে চলাচলের সময় লক্ষ করা যায় ভাষার এই দূষণীয় সংমিশ্রণ। অনেক বিজ্ঞাপন, গণপরিবহন, প্রতিষ্ঠান, দোকান ইত্যাদির নামেও দেখা যায় ভাষাগত ভুল। বাংলা-ইংরেজির এক অদ্ভুত জগাখিচুড়ি! যেন এভাবেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি আমরা! অনেকের আবার দেখা যায় মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা শুধু বিশেষ দিবসের মধ্যেই আটকে থাকে। সারাটা বছর কী করছি, সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই।
ভাষার দূষণ, ভাষা বিকৃতির এই কঠিন অসুখ থেকে আমাদেরকে বের হয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনের তাগিদে আমরা যেকোনো ভাষা শিখতে, জানতে পারি এবং তার ব্যবহার করতেই পারি। তাই বলে কোনোভাবেই আমরা আমাদের মাতৃভাষাটাকে দূষিত বা বিকৃত করতে পারি না। আমাদের উচিত সবখানে সর্বাবস্থায় গর্বের সঙ্গে বাংলা ভাষাকে ব্যবহার করা। শুধু দিবসকেন্দ্রিক নয় বরং মাতৃভাষাটাকে হূদয়ে লালন করতে হবে— প্রতিটা দিন, প্রতিটা সময়। আমাদের উচিত রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ ভাষা সর্বদা গর্বের সঙ্গে শুদ্ধভাবে ব্যবহার করা।
বিশ্বের দরবারে আমাদের মাতৃভাষাকে উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করতে, ভাষাকে আরো উজ্জ্বল করতে ভাষার দূষণ, ভাষার এই বিকৃতি বন্ধে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে। বিশেষ করে এক্ষেত্রে রাষ্ট্রকেই উদ্যোগ নিতে হবে সর্বাগ্রে। আসুন, আমরা নিজের মাতৃভাষার শুদ্ধ চর্চায় মনোনিবেশ করি। শিক্ষিত, পরিশীলিত জাতি হিসেবে বিশ্বদরবারে নিজেদেরকে অধিষ্ঠিত করি।
লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়