• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
দূষণের শিকার প্রিয় মাতৃভাষা

দূষণের শিকার প্রিয় মাতৃভাষা

পৃতীকী ছবি

মতামত

দূষণের শিকার প্রিয় মাতৃভাষা

  • বিশ্বজিত রায়
  • প্রকাশিত ০২ মার্চ ২০১৯

প্রতিবারের মতো এবারো বিদায় নিল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বছর ঘুরে ফের আসবে আমাদের গর্বের মাস ফেব্রুয়ারি, আসবে গর্বিত ভাষা দিবস অর্থাৎ একুশে ফেব্রুয়ারি। আন্তর্জাতিক মর্যাদায় অভিষিক্ত ভাষা দিবস একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের বসিয়েছে বিশ্ব আসনের সর্বোচ্চ মর্যাদায়। একমাত্র জাতি হিসেবে বাঙালিই মাতৃভাষার মান রক্ষায় বুকের তাজা রক্ত ঢেলে ইতিহাস রচনা করেছে- যার অন্যতম গর্বিত অংশীদার বাঙালি এবং বাংলাদেশ; যা সম্ভব হয়েছে বাঙালির হার-না-মানা বীরত্বে। কিন্তু বুকের তাজা রক্ত পিচঢালা পথে ঢেলে প্রাণ বলিদানের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগে যে ভাষা আজ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মাতৃভাষা দিবসে রূপান্তরিত হয়েছে, সেই ভাষা যেন নিজ দেশেই অনেকটা অবহেলিত। বাঙালি নিজেরাই মাতৃভাষা বাংলাকে দূষণের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে। হিন্দি-ইংলিশের সংমিশ্রণ এবং ভুলেভরা যাচ্ছেতাই ব্যবহারে বাংলা তার প্রমিত রূপ হারাতে বসেছে। আমরা নিজেদের আধুনিক, চতুর ও প্রাণবন্ত করে গড়ে তুলতে বাংলায় ইংরেজি ও হিন্দি মিশিয়ে বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছি। কে কত আধুনিক, সেই প্রতিযোগিতায় ভাসতে গিয়ে আপন ভাষাকে দূষিত করার জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এই ভাষাবোধই সবাইকে পড়াচ্ছে মাথা নত না করার ইতিহাস। মায়ের মুখে শেখা পবিত্র বুলির আবেগী জায়গা থেকে বলছি— খুব কষ্ট হয়, অন্তরে লাগে! সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও শফিকের উত্তরসূরি হিসেবে অপরাধী হয়েই আমাদের ভাষা দুর্বলতা ও বিকারগ্রস্ত ভাষা বোধের যন্ত্রণাদায়ক কথাগুলো তুলে ধরায় ব্রতী হয়েছি। ভুলেভরা ভাষাচর্চা এবং ভিন্ন ভাষার প্রতি আমাদের দরদ উথলানো প্রেম ব্যথার ব্যাপকতা ছড়িয়ে দেয়। মনের ভেতর বাসা বাঁধে উদ্বেগী উন্মাদনা। ক্ষুব্ধ মন প্রশ্নে ভাসে— তাজা প্রাণ বলিদানের মাধ্যমে অর্জিত এই ভাষার প্রতি কেন এমন অসদাচরণ? একজন আপাদমস্তক বাঙালি হিসেবে তা মেনে নেওয়া কঠিন।

আমরা একদিনের বাঙালি। দিবসকেন্দ্রিক ভাষাচর্চা চলে এখানে। একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই দলে দলে ফুলেল ভাব দেখাই। হায়রে বাঙালি, ভাবে আছি চেতনায় নেই। দিবস গত হলে আবারো ভাষাদূষণে মিলিত হই আমরা আমাদের মতো করে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার পাশাপাশি বিদ্যমান আইন ও হাইকোর্টের আলাদা দুটি আদেশ থাকার পরও নিশ্চিত হচ্ছে না সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন ও বাংলা ভাষার দূষণরোধ। ফলে কোনো কোনো এফএম রেডিও ও টিভির মাধ্যমে দেদার চলছে ভাষার দূষণ। বিশেষ করে টিভি ও এফএম রেডিওতে উপস্থাপক ও উপস্থাপিকার ইংরেজি-বাংলার জগাখিচুড়ি মার্কা ভাষা শুনলে মনে হয় কোন্্ গ্রহের মানুষ ওরা! কোন্্ ভাষায় কথা বলছে! এই আধুনিক সংকরীকরণ মানুষদের উপস্থাপনা শুনেই বড় হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।

সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে— ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। এই সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার আলোকে ১৯৮৭ সালের মার্চে পাস হয় বাংলা ভাষা প্রচলন আইন। এ আইন অনুযায়ী বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস-আদালত, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়োজন ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে বাংলা ব্যবহার করবে। নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে। আইনে আরো বলা হয়েছে, উল্লিখিত কোনো কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন, তাহলে সেটা বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে। দীর্ঘদিন এ আইন অকার্যকর অবস্থায় পড়ে আছে। এ অবস্থায় ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে হাইকোর্টে রিট করেন এক আইনজীবী। ওই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে একই বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি কাজী রেজাউল হক নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭ অনুযায়ী অফিস-আদালত, গণমাধ্যমসহ সর্বত্র বাংলা ভাষা ব্যবহারের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে একটি রুল জারি করেন। পাশাপাশি দূতাবাস ও বিদেশি প্রতিষ্ঠান ছাড়া দেশের সব সাইনবোর্ড, নেমপ্লেট ও গাড়ির নম্বর প্লেট, বিলবোর্ড এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিজ্ঞাপন বাংলায় লেখা ও প্রচলনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মাঠপর্যায়ে ওই আদেশ বাস্তবায়নের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি। উপরন্তু ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ইংরেজি ও বাংলার মিশ্র ভাষায় বিজ্ঞাপন প্রচার বৃদ্ধি পেয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।

বাংলাবিরোধী এ হালচাল আমাদের সবার আগে চেপে বসেছে। মাতৃভাষা বাংলার মান রক্ষা করতে হলে রাষ্ট্র থেকে ব্যক্তি পর্যায়ে যত্নশীল হতে হবে। ২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকে ‘ভাষাদূষণ নদীদূষণের মতোই বিধ্বংসী’ শিরোনামে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। নিবন্ধটি হাইকোর্টের নজরে আনা হলে আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেছিলেন, এই ভাষা বঙ্গবন্ধুর ভাষা, রবীন্দ্রনাথের ভাষা, শরৎচন্দ্র, জীবনানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র, আলাওল, সৈয়দ মুজতবা আলী, লালন, হাসন রাজা, শাহ আবদুল করিম, জসীম উদ্দীন ও কায়কোবাদের ভাষা। এই ভাষার ওপর আজ প্রলয়ঙ্করী কাণ্ড চলছে। আমাদের জাতিসত্তার অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই অনতিবিলম্বে এটা রোধ করতে হবে। (সূত্র : একটি জাতীয় দৈনিক, ১৯.০২.১৭)

বাংলা বাহক বাঙালিই এই অত্যাচারী জন্তু। প্রমিত বাংলার টুঁটি চেপে ধরেছে দূষণ দুর্বৃত্ত। এখন প্রশ্ন, প্রাণের ভাষা বাংলার দূষণরোধ কীভাবে সম্ভব? রাষ্ট্রের সব পর্যায়ে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাড়াতে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। জাগ্রত করতে হবে দেশপ্রেম। সর্বোপরি সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই।

 

লেখক : সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads