• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ

বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ

ছবি : সংগৃহীত

মতামত

বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ

  • আহমেদ তানভীর
  • প্রকাশিত ০৪ মার্চ ২০১৯

দুনিয়ায় স্বার্থহীন মানুষ যদি থাকে তবে দেশের বীরশ্রেষ্ঠরাই অন্যতম। অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিয়ে সহযোদ্ধাদের বাঁচাতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করেননি। তেমনই আরেকজন বীরশ্রেষ্ঠ ছিলেন, যিনি মর্টার শেলের আঘাতে ডান কাঁধ হারিয়েও রাইফেল হাতে পেছন থেকে কভার দিয়ে শেষ নিঃশ্বাস অবধি সহযোদ্ধাদের বাঁচিয়েছিলেন। হানাদার বাহিনীর অত্যাধুনিক সব অস্ত্রের সামনে শেলের আঘাতে জর্জরিত এক ইপিআর সৈনিক মাত্র একটি রাইফেলের সীমিত গুলি দিয়ে কতক্ষণ টিকে থাকতে পারবেন? কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি সক্ষম হয়েছিলেন বাকিদের বাঁচাতে। তিনি একাই ছিলেন একশ যোদ্ধার সমান, একজন বীরশ্রেষ্ঠ। মাত্র একটি সাধারণ এলএমজি মেশিনগান দিয়ে এবং আহত হওয়ার পরে একটি রাইফেল দিয়ে এতটা ক্ষতিসাধন করে তিনি শত্রুপক্ষের বিষোদ্গারে পরিণত হয়েছিলেন তা তার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসার সময় বেয়নেট দিয়ে বিকৃত, নৃশংসভাবে খুঁচিয়ে চোখ উপড়ে ফেলার মতো পৈশাচিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।

বাংলার সেই বীর সন্তানের নাম নূর মোহাম্মদ শেখ, যার জন্ম ১৯৩৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি যশোর জেলার অন্তর্গত নড়াইল সদরের চন্ডীপুকুরের মহিষখোলা গ্রামে। একজন বলীয়ান, অকুণ্ঠ আর সাহসী ইপিআর সৈনিক। বাবা মোহাম্মদ আমানত ছিলেন একজন কৃষক আর মা জেন্নাতুন্নেসা ছিলেন গৃহিণী তবে খুব অল্প বয়সেই বাবা-মাকে হারিয়ে ডানপিটে এই বালকের শিক্ষাজীবন শেষ হয় সপ্তম শ্রেণিতেই। গানবাজনা, যাত্রাপালায় প্রচণ্ড শৌখিন ছিলেন আর গানের গলাও ছিল অসাধারণ তার। জীবনসঙ্গিনী হিসেবে বেঁচে নেন কৃষকের মেয়ে তোতাল বিবিকে। স্থানীয় আনসার বাহিনীতে কর্মজীবন শুরু করলেও তাতে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হতো। পরে চাকরির সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন। কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৫৯ সালের ১৪ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসে (ইপিআর) যোগ দিয়ে। বহুদিন দিনাজপুর সীমান্তে নিজের কর্মজীবন পার করে অবশেষে ১৯৭০ সালের ১০ জুলাই তিনি যশোর সেক্টর হেড কোয়ার্টারে বদলি হন এবং ওই সময় তিনি ল্যান্স নায়েক পদে পদোন্নতি পান। ২৫ মার্চ ১৯৭১ নূর মোহাম্মদ শেখ যোগ দিলেন মুক্তিযুদ্ধে। পূর্বঅভিজ্ঞতা থাকায় ৮ নং সেক্টরে সরাসরি অধিনায়ক পদে যোগদান করেন এবং সুতিপুর গোয়ালহাটি গ্রামের সামনে স্থায়ী টহল স্থাপন করেন যা নিজেদের রক্ষার্থে অনেক প্রয়োজনীয় ছিল।

৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সকাল তখন সাড়ে নয়টা। টহলের দায়িত্বে থেকে প্রতিনিয়ত নজর রাখছেন শত্রুপক্ষের ওপর; কিন্তু বিধিবাম, সেদিন নজরে পড়ে গেলেন তারা। মুহূর্তের মধ্যেই তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলল তাদের প্রতিরক্ষা ঘাঁটিকে। প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ করতে করতে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে হানাদার বাহিনী। মুক্তিবাহিনীর কাছে ছিল একটি এলএমজি আর দুটি রাইফেল। তা ছাড়া গুলি প্রায় শেষের পথে। তা ছাড়া তিনজন মুক্তিযোদ্ধার বিপক্ষে বিশাল হানাদার বাহিনী। নূর মোহাম্মদ শেখ চিন্তা করতে লাগলেন, প্রতিরোধ ছাড়া পিছু হটলে বরং হানাদার বাহিনী অতিদ্রুত মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে পৌঁছে যাবে যা মোটেও সুখকর অভিজ্ঞতা হবে না। তাই যতক্ষণ সম্ভব প্রতিরোধ করতেই হবে। এতে বরং মূল ক্যাম্পের যোদ্ধারা পিছু হটতে পারবে বা মোকাবিলা করার সময় পাবে। ইতোমধ্যে অন্য যোদ্ধা নান্নু মিয়া গুলি খেয়ে আহত হলেন। ত্বরিত সিদ্ধান্তে নান্নু মিয়াকে কাঁধে তুলে নিলেন এবং হাতে তুলে নিলেন নান্নু মিয়ার হাতে থাকা এলএমজিটা। শুরু করলেন গুলি চালানো। পাকবাহিনী অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়ল। বুদ্ধি করে একটিমাত্র এলএমজি নিয়ে একবার এই পয়েন্ট থেকে গুলি করে তো আবার অন্য পয়েন্টে গিয়ে গুলি করেন। এতে করে হানাদার বাহিনীর মনে ভ্রান্ত ধারণা হলো মুক্তিবাহিনী সংখ্যায় একজন নয় বরং আরো অনেকেই আছে। তারা স্তম্ভিত হয়ে গুলি করা কমিয়ে দিল। এই সুযোগটা নূর মোহাম্মদ হাতছাড়া করলেন না; বরং নান্নু মিয়াকে নিয়ে দ্রুত সরে পড়ে নিরাপদ স্থানে চলে আসেন।

তবে ভাগ্য নেহাত নিষ্ঠুরভাবে দেখা দিল, যখন আচমকা মর্টার শেলের গোলা এসে নূর মোহাম্মদের ডানপাশে পড়ল। শেলের স্প্লিন্টারের আঘাতে নূর মোহাম্মদের হাঁটু প্রায় ভেঙে গেল এবং কাঁধে বিরাট এক ক্ষতের সৃষ্টি হলো। দেশমাতৃকার মাটি সিক্ত হলো তার পবিত্র রক্তে; কিন্তু সূর্যসন্তান এতটুকুতেই দমে যাওয়ার পাত্র নন। সাক্ষাৎ মৃত্যুকে সামনে দেখেও তিনি স্থির থাকলেন এবং সহযোদ্ধা সিপাহি মোস্তফা কামালকে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব সমর্পণ করে হাতে থাকা এলএমজি তুলে দিলেন নতুন অধিনায়কের হাতে। তিনি আদেশ দিলেন মোস্তফা কামালকে- মোস্তফা কামাল, তুমি নান্নু মিয়াকে নিয়ে দ্রুত সরে পড়ো। আমি শত্রুপক্ষকে যতটা পারি দমিয়ে রাখব। হতবিহ্বল সিপাহি মোস্তফা কামাল বললেন-  ‘আপনাকে এ অবস্থায় রেখে কীভাবে যাই?’ জবাবে নূর মোহাম্মদ বললেন- ‘মোস্তফা, ভালো করে তাকিয়ে দেখো, যেভাবে জখম হয়েছি তাতে আমার বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আমাকে নিতে গেলে তোমরা দুজনও মারা যাবে। দেশের স্বাধীনতাকে আনার জন্য তোমাদের বাঁচতে হবে। তোমরা সরে যাও।’

মোস্তফা কামাল হতভম্ব, মন কিছুতেই তার সায় দিচ্ছে না ক্যাপ্টেনকে ছেড়ে যেতে কিন্তু যেতে তো হবেই। নান্নু মিয়াকে কাঁধে তুলে এলএমজি নিয়ে দ্রুত পিছু সরে যেতে লাগলেন। পেছন থেকে আহতাবস্থায় বীরবেশে নূর মোহাম্মদ শেখ একাই প্রতিরক্ষার দুর্গ গড়ে তুললেন। বেশিক্ষণ পারলেন না, প্রচণ্ড রক্তপাতের ফলে একসময় শরীর নেতিয়ে পড়ল তার। শেষ নিঃশ্বাস অবধি রাইফেলের ট্রিগার চেপে ধরে শত্রুপক্ষকে যতটা সম্ভব ঘায়েল করতে লাগলেন। বিলিয়ে দিলেন নিজেকে আর বাঁচিয়ে দিলেন সহযোদ্ধাদের।

নতুন জীবন ফিরে পেয়ে সহযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ করলেন পাকবাহিনীর ওপর। এতটাই আক্রমণাত্মক ছিলেন তারা যে বেশিক্ষণ টিকতে পারল না হানাদার বাহিনী। তারা পিছু হটার সঙ্গে সঙ্গেই অন্যরা নূর মোহাম্মদ শেখের সন্ধানে বেরোলেন। এক ঝাড়ের মধ্যে নূর মোহাম্মদ শুয়ে আছেন দেশের মাটির ওপর। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখা গেল, পাক হায়েনারা মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি সমূলে ধ্বংস করতে না পারার ক্ষোভ এই বীর সন্তানের ওপর ঝেড়েছে। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে উপড়ে ফেলা হয়েছিল তার দুটি চোখ, সেই চোখ যে চোখে স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি স্বাধীন বাংলার। মৃত্যুকে জয় করতে পেরেছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ। যুদ্ধে তার বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাকে ‘তকমা-এ-জং’ ও ‘সিতারা-এ-হরব’ পদকে ভূষিত করেন এবং ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধি প্রদান করে।

 

লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads