• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

আকাশের আত্মহত্যা এবং কিছু প্রশ্ন

  • আফরোজা পারভীন
  • প্রকাশিত ০৪ মার্চ ২০১৯

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ডাক্তার মোস্তফা মোরশেদ আকাশের আত্মহত্যা নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে। পরকীয়ার কারণে এই আত্মহত্যা। মৃত্যুর আগে ফেসবুকে স্ত্রীর সঙ্গে বিভিন্ন ব্যক্তির আপত্তিকর ছবি, মেসেজ ও চ্যাটের স্ক্রিনশটসহ আত্মহত্যার কারণ উল্লেখ করে পরপর দুটি পোস্ট দেওয়ার পর তিনি আত্মহত্যা করেছেন শরীরে ইনজেকশন পুশ করে। আত্মহত্যার জন্য স্ত্রী তানজিলা হক চৌধুরী মিতুকে সরাসরি দায়ী করে গেছেন। স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘ভালো থেকো আমার ভালোবাসা, তোমার প্রেমিকদের নিয়ে।’ কাজটা তিনি করেছেন ভেবেচিন্তে, ঠান্ডা মাথায়। অনেকটা হত্যা পরিকল্পনা করার মতো, ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনামাফিক এ আত্মহত্যা।

ডাক্তার আকাশের জন্য সত্যিই আমার কোনো সমবেদনা জন্মাচ্ছে না। কষ্ট পাচ্ছি তার বাবা-মা আর পরিবারের কথা ভেবে। রাষ্ট্র একজন ছাত্রকে ডাক্তার বানায় যে অর্থে, তার মধ্যে জনগণের ট্যাক্সের টাকাও থাকে। থাকে জনগণের স্বপ্নের সংযোজন। জনগণ চায় একজন মেধাবী ছেলে ডাক্তার হয়ে দেশের সেবা করবে, মানুষের সেবা করবে। জনগণ কখনোই চায় না পাস করার পর একজন ডাক্তারের চিন্তা-ভাবনা শুধু নিজেকে নিয়ে বা নিজের স্ত্রীর মাঝে কেন্দ্রীভূত থাকবে। সেজন্য আরো অনেক অনেক পেশা আছে। সেসব পেশার মানুষের কাছেও জনগণের প্রত্যাশা আছে; কিন্তু ডাক্তারদের কাছে প্রত্যাশা অনেক বেশি। কারণ ডাক্তাররা জীবন-মরণের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকেন।

পরিবার, বাবা-মা, আত্মজনের প্রত্যাশা তো থাকেই। প্রত্যাশা থাকে, ছেলেটা জীবনে বড় হবে। বৃদ্ধ বয়সে বাবা -মায়ের পাশে থাকবে। সুখে-শান্তিতে জীবন কাটাবে সবাইকে নিয়ে। সেরকম একজন ডাক্তার কিনা আত্মহত্যা করলেন স্ত্রীর পরকীয়ার কারণে! একজন ডাক্তার শুধু পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধ নন, তিনি দায়বদ্ধ দেশের প্রতি, সমাজের প্রতি। স্ত্রী যদি পরকীয়া করে থাকেন, আর তাকে যদি তিনি নিবৃত্ত করতে ব্যর্থ হন, তাকে তালাক দেবেন। তা যদি না করেন স্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করবেন। যদি স্ত্রীকে খুব বেশি ভালোবেসে থাকেন, স্ত্রীকে ডিভোর্স দেওয়ার পর সারা জীবন অবিবাহিত থাকবেন। কিন্তু এই কি তার ভালোবাসার নমুনা! তিনি তো তার আত্মহত্যার মাধ্যমে স্ত্রীকে জব্দ করতে চেয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। যে পুরুষ তার স্ত্রীকে সত্যিই ভালোবাসে, সে কি অন্য পুরুষের সঙ্গে স্ত্রীর আপত্তিকর ছবি পোস্ট দেয়? এ মানসিকতা কি সুস্থ!

তিনি ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, বার বার তার স্ত্রীকে বলেছেন, আমাকে ভালো না লাগলে ছেড়ে চলে যাও, চিট করো না। স্ত্রী তাকে ছাড়েননি। মেনে নিলাম। আমার প্রশ্ন, তিনি তাকে ছাড়েননি কেন? আমাদের ধর্মে তো স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই ডিভোর্স দেওয়ার অধিকার আছে। স্ত্রী তাকে ভালোবাসেন না, তার প্রতি আসক্ত নন— এটা জানার পরও তিনি তার সঙ্গে সংসার করেছেন কেন, কীভাবে? তার স্ট্যাটাসে উল্লেখ আছে বিয়ের আগেই তিনি জানতে পেরেছিলেন মাহবুব নামের একজন পুরুষের সঙ্গে তার স্ত্রী রাত কাটিয়েছে। সেটা জানার পরও তিনি তাকে বিয়ে করলেন লোকজনকে দাওয়াত দেওয়া হয়ে গেছে বলে? তার সারা জীবনের ভালো থাকা বড়, না মানুষকে দাওয়াত দেওয়া বড় বুঝতে পারলাম না। তিনি তো জেনেশুনেই বিয়ে করেছেন, তার স্ত্রী একাধিক পুরুষে আসক্ত। তাহলে আজ বিয়ের তিন বছর পর এ ঘটনা নিয়ে আত্মহত্যা কেন? স্ত্রীকে তালাক দিয়ে আরেকটা বিয়ে করাই তো ছিল সহজ সমাধান।

সাত বছর প্রেম করার পর মিতুকে বিয়ে করেছিলেন আকাশ। এই সাত বছরে কি তিনি মিতুকে এতটুকুও চিনতে পারেননি? তিনি মিতুর উচ্ছৃঙ্খল জীবনাচারের জন্য দায়ী করেছেন তার শাশুড়িকে। তিনি নাকি তার মেয়েকে আধুনিক বানাতে চেয়েছেন। সাত বছরেও কি মিতুর আধুনিকতা চোখে পড়েনি আকাশের? জানা গেছে, মিতুর বিয়ের দেনমোহর ৩৫ লাখ টাকা। অত টাকা দিতে পারেননি বলে বাধ্য হয়ে স্ত্রীকে ছেড়ে দিতে পারেননি আকাশ। তা-ই যদি হয়, সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে এত টাকা দেনমোহরে তিনি রাজি হলেন কেন? এ ব্যাপারে তার পরিবারের ভূমিকা কী ছিল? সাধ্যের বাইরে দেনমোহর দেওয়ার বিধান তো ইসলামে নেই। আর দেনমোহরের টাকা শোধ না করতে পারলে নিদেনপক্ষে তিনি তো স্ত্রীর সঙ্গে সেপারেশনে থাকতে পারতেন।

আমি কোনোক্রমেই আকাশের স্ত্রী মিতুর ক্রিয়াকর্মকেও সমর্থন করছি না। তিনি কেন বা কী কারণে পরকীয়ায় মত্ত ছিলেন তা আমরা জানি না। তবে তার যদি স্বামী সাহচর্য ভালো না লাগে, স্বামীকে দিনের পর দিন না ঠকিয়ে তারও উচিত ছিল স্বামীকে ত্যাগ করা। পবিত্র বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে স্বামীর বাড়িতে থেকে এ ধরনের অনাচার কোনোক্রমেই সমর্থনযোগ্য নয়। তাও আবার একজন নয়, একাধিক পুরুষের সঙ্গে। এটাও কি কোনো সুস্থতার লক্ষণ?

জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বলেছেন, পরিবারের চাপে আকাশকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। আকাশের সঙ্গে সংসার করার কোনো ইচ্ছে তার ছিল না। তিনি নিজেও তো একজন ডাক্তার। এমন তো নয় যে, তিনি পরিবারের প্রতি নির্ভরশীল, তাই তাদের কথা না মেনে তার উপায় ছিল না। তা ছাড়া তিনি সাত বছর প্রেম করে জেনেশুনে আকাশকে বিয়ে করেছেন। হ্যাঁ হতে পারে, প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন কিন্তু বিবাহিত জীবনে এসে যে কোনো কারণেই হোক আকাশকে ভালো লাগেনি। তা তিনি তাকে ডিভোর্স দেননি কেন? তার এ কথা ধোপে টেকে না।

আমাদের সমাজে নানা কারণেই নারী পরপুরুষে আসক্ত হয়। সে কারণগুলো কখনোই আলোচিত হয় না। কোনো নারীর পরপুরুষে আসক্তি মানেই বিষয়টি অন্যায়, লজ্জার, সমাজের জন্য ক্ষতিকর এটা আমরা ধরেই নিই। তাই আলোচনা যেটুকু হয়, তার পুরোটাই নারীর বিপক্ষে যায়। আজ পর্যন্ত কোনো সমাজ সমালোচক বা সচেতন লেখককে দেখিনি বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করতে যে কেন নারী পরপুরুষে আসক্ত হয়। আর পুরুষের পরনারী আসক্তি যেন অনেকটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। আসক্তির কথা জেনেও স্ত্রীরা সংসার করে যায়। পরনারীতে আসক্ত স্বামীর অনুগতও থেকে যায়। যারা প্রতিবাদ করেছে, তাদের অনেককেই জীবন দিতে হয়েছে। যেমন সালেহা, শারমিন রীমা হত্যার কথা আমরা জানি। এ সমাজ চায় নারী মুখ বুজে সব সহ্য করুক। সে সংসারে সুখী হলেও সুখী থাকুক, না হলেও সুখী হওয়ার ভান করুক। যেন কোনোক্রমেই প্রতিবাদ না করে।

এ সমাজে অনেক নারী আছেন, যারা বিয়ের রাতেই বুঝে যান স্বামীর অক্ষমতা। কিন্তু ওই স্বামী নিয়েই তারা জীবন কাটিয়ে দেন। স্বামীর অক্ষমতার কথা প্রকাশও করতে পারেন না। বিষয়টি জানাজানি হওয়া যেন লজ্জার, ব্যাপারটা অনেকটা এরকম। আর যদি কখনো পরিবারে বলেন, পরিবার বলে ঠিক হয়ে যাবে। মানিয়ে চলো। যেন মানিয়ে চলাই নারীজীবনের লিখন। এই যে নারীরা অকারণ জীবনপাত করেন, অথচ তাদের ত্যাগের কথা কখনোই আলোচিত হয় না। তাদের আত্মত্যাগ স্বাভাবিকের লিস্টে পড়ে অনুল্লেখ্য থেকে যায়।

কথা বলছিলাম মিতুকে নিয়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিতুর স্বীকারোক্তির একটি ভিডিও দেখলাম। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তাকে মারধর করা হয়েছে। আর যে ভাষায় তার কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে, সেটা কোনো গ্রহণযোগ্য ভাষা নয়। আমরা চাই না, কোনো নারীকে এভাবে অশালীন অমার্জিত ভাষায় প্রশ্ন করা হোক। সে নারী যা-ই করুক না কেন। কারণ প্রমাণিত হওয়ার আগে কাউকেই অপরাধী বলা যায় না। যদি কেউ অপরাধও করে থাকে, তাকে এসব নোংরা ভাষায় প্রশ্ন করা যায় না। নোংরা প্রশ্ন সংবলিত এসব ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসে কী করে! এ ব্যাপারে কি কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই?

আমরা যে কোনো ঘটনার শুধু উপরটাই দেখি। নেপথ্যে বা গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করি না। যে কারণে অনেক অপরাধের মূলোৎপাটন হয় না। অনেক নির্দোষ মানুষ শাস্তি পায়, দোষী ছাড়া পেয়ে যায়। আকাশকে ভালোবাসার পাগল বলতে পারতাম, তিনি যদি নিঃশব্দে চলে যেতেন। কিন্তু ফেসবুকে স্ত্রীকে উদোম করে দিয়ে তার এই আত্মহনন প্রমাণ করে, তিনি মোটেও স্ত্রীকে ভালোবাসেননি। আত্মহত্যা ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় অপরাধ, সেটাই তিনি করেছেন। তিনি কোনো কিশোরও নন যে, আবেগপ্রবণ হয়ে আত্মহত্যা করে ফেলেছেন। তাকে তো আর জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে না। পুরো বিষয়টাই এখন নারীর একক অপরাধকেন্দ্রিক হয়ে গেছে।

যে সমাজে এক বাড়ির দু-দুজন ডাক্তার মানসিক রোগী হয়, তাদের কাছে রোগীরা কতটা নিরাপদ সেটা ভেবে দেখার বিষয়। আকাশের মা বলছেন, তিনি ওই মহিলার জেল চান। তা তিনি চাইতেই পারেন, তিনি ছেলে হারিয়েছেন, তিনি শোকাতুরা। সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা তারই হয়েছে। কিন্তু ছেলে কি তার প্রতি আদৌও সুবিচার করেছে। মেয়েটা পরকীয়া করে অন্যায় করেছে। কিন্তু আকাশ কি তার স্ত্রীর প্রতিও কোনো সুবিচার করেছে? আমরা চাই বিষয়টির সঠিক সত্য বেরিয়ে আসুক। চাই সুবিচার। আর হ্যাঁ, ডাক্তারি পেশায় প্রবেশের ব্যাপারে মানসিক সুস্থতার বিষয়টি সঠিকভাবে যাচাই করার জোর দাবি জানাচ্ছি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে।

 

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাবেক যুগ্ম-সচিব

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads