• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

ভোক্তা অধিকার আইন এবং কিছু কথা

  • মাহমুদ সালেহীন খান
  • প্রকাশিত ০৫ মার্চ ২০১৯

আজকাল খাদ্যে ভেজাল বিষয়টি আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে। বোধহয় আমরা সবাই একে ভাগ্য বলে ধরে নিয়েছি। না হলে এতকিছুর পরেও এর কোনো প্রতিকার হচ্ছে না কেন? কেনইবা এর বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না? কিছুদিন আগে ‘বাংলাদেশের প্যাকেটজাত দুধে সিসা আর বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক’ পাওয়া নিয়ে সংবাদমাধ্যমে হৈচৈ পড়ে গেল। চারদিকে শুধু শুনি খাদ্যে ভেজাল, দুধে ভেজাল, মাছে-ফলে ফরমালিন, শিশুখাদ্যে ভেজাল! আসলে কী খাচ্ছি আমরা? কী খাওয়াচ্ছি আমরা আমাদের সন্তানদের? কোন দিকে যাচ্ছি আমরা? ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, মানবিকতা এমনকি ধর্মীয় মূল্যবোধও আমরা হারিয়ে ফেলেছি? দুধের মতো একটা বিশুদ্ধ ও পবিত্র দ্রব্যে বিষ মেশাচ্ছি? লোভ আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

যারা খাদ্যপণ্যে ভেজাল দিচ্ছেন, তারা কি একবারো ভেবেছেন আপনারাও ভেজাল খাদ্য খাচ্ছেন? হয়তো আপনি দুধে ভেজাল দিয়ে অতিরিক্ত লাভ করছেন, কিন্তু আপনিও ফরমালিনযুক্ত মাছ খেয়ে অসুস্থতার চিকিৎসা করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। আবার যিনি মাছে ফরমালিন দিচ্ছেন, তিনিও কিন্তু দুধ-ফল খেয়ে একই পরিণতি ভোগ করছেন। বলুন তো, তাহলে লাভটা হচ্ছে কার? আমরা যারা বাজার থেকে পণ্য কিনি, তারা কি জানি আমাদের অধিকার সংরক্ষণে একটি আইন আছে? এই আইনটির ব্যাপারে আমরা মোটেই অবগত নই।

একজন নাগরিকের বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন। এর কিছু প্রদান করে থাকে পরিবার, কিছু করে রাষ্ট্র। তবে অন্যান্য অধিকার থেকে ভোক্তা অধিকার কিছুটা ভিন্ন। যিনি উৎপাদিত পণ্য ও সেবা চূড়ান্ত ভোগের জন্য ক্রয় করেন, অর্থনীতির ভাষায় তাকে ভোক্তা বলে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, যিনি কোনো পণ্য ক্রয় করেন কেবল নিজে ভোগ করার জন্য, তিনিই ভোক্তা।

একজন ব্যক্তি যখন কোনো পণ্য ক্রয় করেন, তখন তার জানার অধিকার রয়েছে পণ্যটি কবে উৎপাদিত হয়েছে, কোথায় উৎপাদিত হয়েছে এবং এর কাঁচামাল কী কী, মূল্য কত ইত্যাদি। এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে একজন বিক্রেতা বাধ্য। যদি কোনো বিক্রেতা এসব প্রশ্নের উত্তর না দেন বা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন, তখন আইন অনুযায়ী তাতে ভোক্তা অধিকার ক্ষুণ্ন হয়। জাতিসংঘ স্বীকৃত ভোক্তা অধিকার ৮টি, এগুলো হলো— মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার, তথ্য পাওয়ার অধিকার, নিরাপদ পণ্য বা সেবা পাওয়ার অধিকার, পছন্দের অধিকার, জানার অধিকার, অভিযোগ করা ও প্রতিকার পাওয়ার অধিকার, ভোক্তা অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষালাভের অধিকার, সুস্থ পরিবেশের অধিকার।

পণ্য ক্রয়ে প্রতারণার হাত থেকে ভোক্তাদের সুরক্ষা দিতে বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সালে বহু প্রতীক্ষিত ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করেছে। এ আইনের ফলে কোনো ভোক্তা পণ্য ক্রয়ে পণ্যের ওজন, পরিমাণ, উপাদান, মূল্যসহ কোনো বিষয়ে প্রতারিত হলে তার প্রতিকার পেয়ে থাকেন। অথচ বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ এই গুরুত্বপূর্ণ আইনটি সম্পর্কে অবগত নয়। এই আইন সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকার জন্য প্রতারিত হওয়ার ঘটনা বেড়েই চলেছে। বর্তমানে অনলাইনে কেনাকাটা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। কিন্তু ওয়েবসাইটে পণ্যের যে মান উল্লেখ থাকে, মূল্য পরিশোধের পর পণ্য হাতে পেয়ে দেখা যায়— বর্ণিত গুণাগুণ সেই পণ্যের মধ্যে নেই। তাই ভোক্তাকে এই আইন সম্পর্কে জানতে হবে এবং নির্ধারিত পন্থায় অভিযোগ দায়ের করতে হবে। তাহলেই অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য কমবে এবং ভোক্তাদের প্রতারিত হওয়ার সংখ্যাও কমে আসবে।

২০০৯ সালে প্রণীত ভোক্তা অধিকার আইনে মোট ৮২টি ধারা রয়েছে। এ ছাড়া কয়েকটি ধারার উপধারা রয়েছে। ৩৭ ধারা মোতাবেক পণ্যের মোড়ক না থাকলে বা মোড়কে পণ্যের তথ্য না থাকলে বিক্রেতা অনধিক ১ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। ৩৮ ধারায় পণ্যের দাম সহজে দৃশ্যমান কোনো স্থানে না রাখলে ১ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। ৩৯ ধারায় উল্লেখ করা আছে, সেবার দাম সংরক্ষণ এবং সহজে দৃশ্যমান কোনো স্থানে না রাখলে বিক্রেতা অনধিক ১ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। ৪০ ধারা অনুযায়ী, ধার্যকৃত মূল্যের অধিক মূল্যে পণ্য, সেবা বা ওষুধ বিক্রি করলে বিক্রেতা অনধিক ১ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।

 

৪১ ধারা অনুযায়ী ভেজাল পণ্য বা ওষুধ বিক্রি করলে বিক্রেতা অনধিক ৩ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। ৪২ ধারা অনুযায়ী খাদ্যপণ্যে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোনো নিষিদ্ধ দ্রব্য মিশিয়ে বিক্রি করলে বিক্রেতা অনধিক ৩ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। ৪৩ ধারায় উল্লেখ আছে, জীবন বা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এমন পণ্য অবৈধ উপায়ে বিক্রি করলে বিক্রেতা অনধিক ২ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। ৪৪ ধারামতে, পণ্যের মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা করলে অনধিক ১ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন ইত্যাদি।

পণ্য কিনে প্রতারিত হলে অভিযোগ দায়ের করার পদ্ধতি খুবই সহজ। বর্তমানে প্রত্যেকের হাতে হাতে স্মার্টফোন। গুগলে সংরক্ষিত ‘ভোক্তা অধিকার ও অভিযোগ’ অ্যাপসের মাধ্যমে খুব সহজেই প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে অভিযোগ দায়ের করা যায়।

এ ছাড়া ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে সরাসরি ই-মেইলের (হপপপ-ফহপৎঢ়.মড়া.নফ) মাধ্যমেও অভিযোগ করা যায়। এছাড়া ০১৭৭৭-৭৫৩৬৬৮ ও ০৩১-৭৪১২১২ নম্বরে কল দিয়েও অভিযোগ জানানো যাবে। এরপর তদন্ত শেষে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেলে যে আর্থিক জরিমানা করা হবে, তার ২৫ শতাংশ অভিযোগকারী ভোক্তাকে ক্ষতিপূরণ বাবদ দেওয়া হবে। তবে অভিযোগটি পণ্য কেনার ৩০ দিনের মধ্যে দায়ের করতে হবে।

কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের ব্যাপারে অনেকেই সচেতন নন। কনজ্যুমার্স ফোরামের একটি জরিপ সেরকম তথ্যই জানাচ্ছে। ওই জরিপে দেখা যায়, এখনো ৩৬ দশমিক ২০ শতাংশ মানুষ জানেন না দেশে ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণমূলক একটি আইন বলবৎ আছে। ৪৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ মানুষ জানেন না ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে একটি অধিদফতর আছে।

সুতরাং ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে নিয়মিত এ আইন সম্পর্কে প্রচার-প্রচারণা চালানো প্রয়োজন। ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করতে হলে জনসচেতনতা সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। তবে তা শুধু ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের একক প্রচেষ্টা দিয়ে সম্ভব হবে না। সরকারের পাশাপাশি সামাজিক সংগঠনগুলোকেও উদ্যোগী হতে হবে।

 

লেখক : সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads