• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

মতামত

পরিকল্পিত ও পরিবেশবান্ধব নগর প্রয়োজন

  • নিতাই চন্দ্র রায়
  • প্রকাশিত ০৫ মার্চ ২০১৯

সম্প্রতি পুরান ঢাকার চকবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জনের মৃত্যু, আহত মানুষের বুকভাঙা বেদনা ও আত্মীয়-স্বজনের আর্তনাদ এবং কোটি কোটি টাকার সম্পদের বিনাশ আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দেয় যে, এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে পরিকল্পিত ও পরিবেশবান্ধব নগরায়ণের কোনো বিকল্প নেই। যে উন্নয়ন জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করে না, শুধু লাশ উপহার দেয়, সে উন্নয়ন টেকসই হতে পারে না। অর্থের লোভে আমরা ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অমান্য করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের মাধ্যমে আবাসিক এলাকায় দাহ্য রাসায়নিক পদার্থের গুদাম তৈরি ও মিলকারখানা স্থাপন করে নিজেরাই নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনছি। বহুতল ভবন নির্মাণের নামে প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো ভরাট করে আগুন নেভানোর কাজকেও করছি বাধাগ্রস্ত। গাছপালা ও বনভূমি ধ্বংস করে নগরগুলোকে করে তুলছি মানুষের বসবাসের অযোগ্য ইটপাথরের তপ্তাঞ্চল। যানজট, জলাবদ্ধতা, আবর্জনার দুর্গন্ধ, মাটি, পানি ও বাতাস দূষিত করে আমরা নগরজীবনকে করে চলেছি নরকের মতো দুর্বিষহ।

বুয়েটের এক গবেষণা বলছে, পুরান ঢাকার ৮০ শতাংশ ভবনে রাসায়নিকের মজুত রয়েছে, যা থেকে যে কোনো সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। ভূমিকম্প ও অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি বিবেচনায় পুরান ঢাকার ওপর গবেষণাটি পরিচালনা করেন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস ইউনিভার্সিটির সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল  বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্লানিং বিভাগের তিন গবেষক। ‘জিআইএস বেইজড ম্যাপিং অব ভালনারেবিলিটি টু আর্থকোয়েক অ্যান্ড ফায়ার হ্যাজার্ড ইন ঢাকা সিটি’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটি ২০১৫ সালে ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ডিজাস্টার রিস্ক রিডাকশন’-এ প্রকাশিত হয়। ওই গবেষণার জন্য পুরান ঢাকার ৩৫০টি ভবনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সেখানকার  প্রায় ৮০ শতাংশ বাড়িতে অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে— এমনসব উপকরণ মজুত রয়েছে। পরবর্তী সময়েও পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পরিচালিত একাধিক গবেষণা জরিপে এ পরিস্থিতির উন্নতি লক্ষ করা যায়নি। সাম্প্রতিক তথ্যও বলছে, সেখানে ৭০ শতাংশ বাসার নিচে গুদামঘর আছে, যার মধ্যে ৫০ শতাংশ বাসার নিচেই রয়েছে কেমিক্যাল গুদাম।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, গবেষণা সংশ্লিষ্ট এলাকার ৫৮ দশমিক ৬ শতাংশ ভবন অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ রয়েছে অতি ঝুঁকিতে। ৫৪ শতাংশ ভবনের কাছের সড়ক অগ্নিনির্বাপক যান প্রবেশের উপযোগী নয়। অধিকাংশ ভবন বসবাস ও শিল্পসংশ্লিষ্ট কাজে ব্যবহার হওয়ায় অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিও বেশি। পুরান ঢাকায় জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি হওয়ায় দুর্যোগের ঝুঁকিও সেখানে তুলনামূলক বেশি। গবেষণা পরিচালিত এলাকার ৫০ দশমিক ৮৬ শতাংশ ভবন রয়েছে অগ্নিকাণ্ড ও ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে। এর মধ্যে ৪ দশমিক ২৯  শতাংশ ভবন দুই ধরনের দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই অতি ঝুঁকিতে রয়েছে। ঘনবসতিপূর্ণ এ এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের উচ্চ ও অতি উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে ৩৮ শতাংশ ভবন।

চকবাজারের চুড়িহাট্টা মোড়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ফায়ার সার্ভিসের ১৫ ঘণ্টা চেষ্টার পর নিয়ন্ত্রণে আসে। পুরান ঢাকা জনবহুল হওয়ায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হয় ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের। ফলে হতাহতের সংখ্যাও বেড়ে যায়। অগ্নিকাণ্ডের পর ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচে রাসায়নিকের মজুত পাওয়া যায়। দুর্ঘটনার সময় এলাকাটিতে বেশি জনসমাগম থাকায় উদ্ধার কাজ পরিচালনা করতে বেশ বেগ পেতে হয়। পানি সঙ্কটের কারণেও আগুন নেভানোর কাজ বিঘ্নিত হয়। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্য বলছে, ২০০৪ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রায় ৯০ হাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২ হাজার ৯৭৮ জন। এতে ক্ষতি হয়েছে ২ হাজার ৯৯ কোটি টাকার বেশি। শুধু ২০১৮ সালে ১৯ হাজার ৬৪২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষতি হয়েছে ৩৮৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা এবং এসব ঘটনায় প্রাণহানি ঘটেছে ১৩০ জন মানুষের।

২০১০ সালে নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক মানুষ মারা যাওয়ার পর পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম সরানোসহ ১৭টি সুপারিশ এসেছিল সরকারি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিমতলীর ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে তদন্ত কমিটির সিদ্ধান্তগুলো সময়মতো বাস্তবায়িত হলে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় এমন দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতো না। তদন্ত প্রতিবেদনের ওই ১৭ দফা সুপারিশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো— জরুরিভিত্তিতে আবাসিক এলাকা থেকে গুদাম বা কারখানা সরিয়ে নেওয়া, অনুমোদনহীন কারখানার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া, অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপক আইন-২০০৩ ও ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করা, রাসায়নিক দ্রব্যের মজুত, বাজারজাতকরণ এবং বিক্রির জন্য লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে তদারকি প্রক্রিয়া জোরদার করা, আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক বা বিস্ফোরক জাতীয় পদার্থ মজুতকরণ বা বিপণন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা, বাড়িঘরে ব্যবহূত বৈদ্যুতিক তারের গুণগতমান নিশ্চিত করা, সম্ভাব্য দুর্ঘটনা পরিহার করতে মাসে অন্তত একবার ট্রান্সফরমার সরেজমিনে পরীক্ষা করা, দুর্ঘটনা মোকাবেলায় জাতীয় পর্যায়ে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন, রাসায়নিক ও এ-জাতীয় দাহ্য বস্তুর আলাদা দফতরের পরিবর্তে সব দফতরের সমন্বয়, সময়ের চাহিদা অনুয়ায়ী ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের অকাঠামো, জনবল, প্রশিক্ষণ ও সাজসরঞ্জামের আধুনিকায়ন, সচেতনতা বাড়ানো, পাঠ্যসূচিতে অগ্নিকাণ্ড, উদ্ধার ও প্রাথমিক চিকিৎসার বিষয় বাধ্যতামূলক করা এবং বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ডেকোরেটরের উপকরণের সঙ্গে প্রয়োজনীয় সংখ্যক অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রাখা ইত্যাদি। কিন্তু সুপারিশের কোথাও পরিকল্পিত, পরিবেশবান্ধব নগরায়ণ ও নগর সরকারের কথা উল্লেখ করা হয়নি।

নিমতলীর দুর্ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। দুটি মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। তার নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে কমিটি গঠন করা হয়েছিল। পুনর্বাসনের ব্যাপারে কমিটির দায়িত্বে থাকা ফায়ার ব্রিগেডের তৎকালীন ডিজি বাড়ির মালিক, ব্যবসায়ী ও শ্রমিক সবাইকে নিয়ে আলোচনায় বসেছিলেন। কিন্তু তারপর কেন রাসায়নিক গুদামগুলো পুরান ঢাকার মতো জনবহুল আবাসিক এলাকা থেকে স্থানান্তরিত হলো না— সে রহস্য আমাদের জানা নেই। পুরান ঢাকায় শুধু অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিই নয়; এর ভবনগুলোও পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। অনেকেই ফাটল ধরা ভবনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কোনো রকমে প্লাস্টার দিয়ে বসবাস করছেন, ভাড়া দিচ্ছেন। যেখানে ছোটখাটো ভূমিকম্পেও ভয়াবহ প্রাণহানি ঘটতে পারে। ভবন মালিকরা আবাসনের অনুমতি নিয়ে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করছেন। বেশি টাকার লোভে রাসায়নিক পদার্থের গুদাম হিসেবে ভাড়া দিচ্ছেন— এটা অনৈতিক ও নিয়মবহির্ভূত। এগুলো দেখার দায়িত্ব রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক)। কিন্তু এসব ব্যাপারে রাজউকের কোনো কর্মকাণ্ড দেখা যায় না। বহুবার দেখা গেছে, পানির অভাবে আগুন নেভানোর কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে। ঢাকা পৃথিবীর মধ্যে একটি ব্যতিক্রমী নগর, যার চারদিকে রয়েছে বেশ ক’টি নদী। কলকাতায় অগ্নিনির্বাপণের জন্য ব্রিটিশ আমলে বিভিন্ন গলিতে ওয়াটার হাইড্রেন্ট লাগানো হলেও ঢাকায় সেই ব্যবস্থা নেই। এজন্য ঢাকায় আগুন নেভাতে এত বেগ পেতে হয় ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের।

এ ব্যাপারে বিশিষ্ট নগর পরিকল্পানবিদ ও স্থপতি  মোবাশ্বের হোসেনের মতে, সেবা সংস্থার ৫৪টি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়হীনতার কারণে ঢাকার মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। এখানে একক কোনো প্রতিষ্ঠান নেই, যাকে অগ্নিকাণ্ডের জন্য জবাবদিহির মধ্যে আনা যাবে। বাংলাদেশের বাইরে প্রতিটি সিটি মেয়রের বহু দায়িত্ব থাকে। কিন্তু ঢাকা সিটি মেয়রের হাতে ক্ষমতা নেই। নগরীর সব বিষয় তদারকির জন্য যদি সিটি করপোরেশনকে ছাতা হিসেবে ব্যবহার করা হতো, তাহলে তাকে দায় দেওয়া যেত। নিমতলীর ভয়াবহ ঘটনার পরও কেন এত বছরেও রাসায়নিক গুদাম সরানো হলো না- এসব মেয়রকে জিজ্ঞেস করা যেত। কিন্তু সমন্বয়হীনতা থাকায় সবাই একে অন্যের ওপর দায় চাপানোর সুযোগ পাচ্ছে। নিমতলী ও চকবাজার অগ্নিকাণ্ডের মতো ভয়াবহ দুর্ঘটনা এড়াতে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন নাগরিক সেবা সংস্থাকে একক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার। সরকারকে বিষয়টি ভাবতে হবে। বিভিন্ন সেবা ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকলেও তা তদারকির দায়িত্ব একটি প্রতিষ্ঠান ও একজন মানুষের হাতে থাকা উচিত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এটা নগরপিতার হাতেই থাকে।

আমরা জানি, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নগর উন্নয়ন ও নগরবাসীর সব সমস্যা সমাধানে নগর সংসদ, নগর নির্বাহী বিভাগ, নগর বিচারিক বিভাগ ও নগর নির্বাচনী বিভাগের সমন্বয়ে স্বশাসিত, স্বনির্ভর ও গণতান্ত্রিক নগর সরকার রয়েছে। সেখানে নগরের প্রত্যেক ওয়ার্ড থেকে একজন পুরুষ এবং একজন নারী কাউন্সিলর নির্বাচিত হন জনগণের সরাসরি ভোটে। কাউন্সিলরদের সমন্বয়ে গঠিত হয় নগর সংসদ। নগর সংসদের সভাপতি কাউন্সিলরদের ভোটে নির্বাচিত হন। তার কাজ হলো অনেকটা আমাদের জাতীয় সংসদের স্পিকারের মতো। নগর সংসদ বিধানিক বিভাগ হিসেবে কাজ করে থাকে। নগরের বার্ষিক বাজেট নগর সংসদে পাস করা হয়। নগর সংসদের গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো নগর নির্বাহী বিভাগের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। মেয়র নগর নির্বাহী বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করেন। পুলিশসহ নগরের সব সেবা প্রদানকারী সংস্থার নিয়ন্ত্রণ থাকে মেয়রের হাতে। পরিকল্পিত ও পরিবেশবান্ধব নগর নির্মাণে বিদেশের মতো করে নয়; আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, জলবায়ু, জনসংখ্যা, সংস্কৃতি, সমস্যা ও সম্ভাবনাকে বিবেচনা করে দেশের প্রতিটি নগরে একরূপ স্বশাসিত, স্বনির্ভর ও গণতান্ত্রিক নগর সরকার গঠন করতে হবে। গড়ে তুলতে হবে নগরীয় কৃষিব্যবস্থা। সেই সঙ্গে পুরনো নগরগুলোকে পরিকল্পিতভাবে পুনর্নির্মাণ এবং নতুন নগরগুলোকে একশ বছরের পরিকল্পনা সামনে রেখে গড়ে তুলতে হবে। সংরক্ষণ করতে হবে নগর ও তার আশপাশের বনভূমি, গাছপালা, নদনদী ও প্রাকৃতিক জলাশয়।

এর ব্যত্য ঘটলে নিমতলী, তাজরীন ফ্যাশনস, রানা প্লাজা ও চকবাজারের মতো দুর্ঘটনাসহ যানজট, জলাবদ্ধতা, দূষণ প্রক্রিয়া থেকে নগরবাসী কখনোই পরিত্রাণ পাবে না। হাজার বছরেও এদেশে গড়ে উঠবে না পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নগর।

 

লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)

নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লিমিটেড, গোপালপুর, নাটোর

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads