• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯
রসে ভরা বঙ্গ

রসে ভরা বঙ্গ

প্রতীকী ছবি

মতামত

রসে ভরা বঙ্গ

  • মোহাম্মদ অংকন
  • প্রকাশিত ০৬ মার্চ ২০১৯

এখন খবর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ এবং রেডিও-টেলিভিশনে সম্প্রচারের আগেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ঘোরাফেরা করে। মানুষজন পড়েও ভালোই! লাইক দেয়, কমেন্ট করে! সত্য-মিথ্যা ক’জন যাচাই করে? একজন বললেন, ‘বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার আনতে পারব না।’ এই কথাটি বলার পর তার কথাটি ফেসবুকের খবর হয়ে গেল। সবাই পড়তে লাগল। জানতে লাগল, ঘটনা কী। কিন্তু এমন ধ্রুব সত্য কথাটি যদি সবাই জানে, তাহলে নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতার মানে কি বজায় থাকল? তাই আরেকজন বললেন, ‘ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের উপচেপড়া ভিড়।’ এটিও ফেসবুকের খবর হয়ে গেল। আর দিনশেষে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। পরেরদিন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হলো। ফেসবুকের খবরটি ভুয়া হয়ে গেল। জনগণ সত্যকে গুজব ভাবল। এটাই এখন পরাবাস্তবতা।

আমরা শৈশবে খোলামাঠে ফুটবল খেলতাম। খেলা নিয়ে বাজি ধরতাম। এক দল বলত, ‘ওরা খেলায় ফাউল করেছে। ধান্দাবাজি করে গোল দিয়েছে। এ গোল আমরা মানি না।’ আরেক দল বলত, ‘তোরা না মানলে কী হবে? আমরা তো মানি। খেললে খেল, না খেললে যা!’ সত্যই ওরা খেলত না। শক্তি, যুক্তিতে না পেরে রাগ, অভিমান করে মাঠের একপ্রান্তে বসে থাকত অথবা মাঠ ছেড়ে চলেই যেত। আরেকদল ফুটবল নিয়ে মাঠ দাপিয়ে দু-চারটে গোল বসিয়ে দিত। আর জিতে যেত। বাজির টাকা নিয়ে ফুর্তি করত। কিন্তু দর্শক মোটেও বুঝে উঠতে পারল না, ওরা কোন শক্তি বলে এমন নয়ছয় করল। বিনোদন না নিয়ে দর্শকরা ‘কনফিউশন’ নিয়ে বাড়ি ফিরে গেল। সেই দিনগুলোর সঙ্গে বর্তমানের কত না মিল!

আমরা সাধারণ ভোটার। আমাদের মধ্যে সত্যিই ‘কনফিউশন’ যে কাকে ভোট দেব? নির্বাচনে যারা প্রার্থী হচ্ছেন, তারা পয়সার ওপিঠ-এপিঠ। তারা এক গোয়ালের গরু হয়েও দুই ধরনের মতাদর্শ প্রয়োগ করে চলেছেন। কিন্তু জনগণ জানে, অমুক ও তমুক একই ঘরের মানুষ। জনগণ ‘কনফিউশনে’ পড়ে যায়। এর চেয়েও বড় ‘কনফিউশন’ দেখা যায় যখন তারা দেশের উন্নয়ন নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি করে। নিজেদের দোষত্রুটি মাইকে প্রচার করে। আর তখনই সবকিছু হাস্যকর হয়ে যায়। জনগণ টাকা ও সময় নষ্ট করে ভোটকেন্দ্রে যায় না। তাই বলে ভোট কি হয় না?

মাঝে মাঝে মজার মজার খবর চোখের সামনে আসে। সাংবাদিকরা যদি সকালে বলে, ‘কেন্দ্রে ভোটার নেই’, সাংবাদিকদের ‘গডফাদার’ বলে, ‘কেন্দ্রে ভোটারদের স্থান সংকুলান হচ্ছে না।’ আমরা আবার ‘কনফিউশনে’ পড়ে যাই। তবে আশার কথা হলো, বর্তমানে প্রায় শতভাগ ভোট কাস্ট হয়, এটাই চমকপ্রদ! বিষয়টা হচ্ছে— যারা দায়িত্বে থাকেন, তাদের ওপর আস্থা রাখলে ভোট দেওয়া নিয়ে আমাদের অযথা টেনশন কিসের? ভোট নিয়ে আমাদের টেনশন নেই। যে কেউ ভোটে নির্বাচিত হোক, হতে পারে। দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করুক। কিন্তু দায়িত্বগুলো যথাযথভাবে পালন করার সদিচ্ছা কি কারোর আছে? একজন দায়িত্ব পায়, তারপর কোথায় যেন হারিয়ে যায়। জনগণের আড়ালে আড়ালে থাকতে হাওয়ায় ডুব দেয়। হাওয়া যখন অতিরিক্ত গরম হয়ে নিমতলী, চকবাজার, ভাসানটেক বস্তির মতো জায়গায় আগুন লাগে, তখন সবাই মিডিয়ার সামনে এসে জোরে জোরে বলে, ‘এ ঘটনার জন্য আমি দায়ী না।’ আরেকজন বলে, ‘আমিও দায়ী না।’ তাহলে দায় কি ভোটারদের? যারা ভোট দিয়ে দায়িত্বহীন কাউকে নির্বাচিত করেছেন?

দায়িত্বহীন লোকের যেমন আজকাল অভাব নেই, তেমনি স্বেচ্ছাচারী লোকেরও অভাব নেই। প্রতিনিয়ত কর্মব্যস্ত মানুষগুলো দায়িত্বহীন ও স্বেচ্ছাচারী লোকদের কবলে পড়ে রাস্তায় যানজটের শিকার হচ্ছে। না পারে বাস থেকে নেমে হেঁটে যেতে, না পারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসে বসে থাকতে। ফলে ট্রেন মিস হয়, চাকরি মিস হয়, রোগী মারা যায়— তার হিসাব কেউ রাখে না। সবাই নিজের হিসাব নিয়ে ব্যস্ত। কারো কথার গ্রহণযোগ্যতা এখন আর নেই। আপনি জনারণ্যে দুটি মূল্যবান কথা বলবেন, লোকে আপনাকে ‘চাটুকার’ বলবে। একজন অসহায়কে সাহায্য করবেন, লোকে ‘ধান্দাবাজ’ বলবে। রাজনীতিতে বিষয়টি আরো গোলমেলে। আপনি যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চান, তাহলে আপনাকে ‘আওয়ামী লীগ’ বলবে।

আর সাগর-রুনি, বিশ্বজিৎ, ফেলানীর হত্যার বিচার চান, তাহলে আপনাকে ‘বিএনপি’ বলবে। সাধারণ মানুষ কোন পথে হাঁটবে, কাকে ভোট দিবে, কোনো হদিস করতে পারে না। এসব থেকে বাঁচতে এখন অনেকেই মিথ্যার আশ্রয় নিতে শুরু করেছেন।

শহরে এক বাড়িতে এক প্রার্থী ভোট চাইতে গেছেন। ভোটার বলেছেন, ‘ভোট দিব।’ আবার একই দলের আরেক প্রার্থী অন্য প্রতীকে ভোট চাইতে গেছেন। ভোটার বলেছেন, ‘ভোট দিব।’ যখন এটার পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে, তখন ভোটার বলেছেন, ‘আমি এ এলাকার ভোটার না।’ তারপর সব আয়োজন সাঙ্গ। ভোটকেন্দ্রে ভোটার পাওয়া যায় না। নির্বাচনের পরিবেশ আছে, ভোটার নেই। প্রশাসন আছে, ভোটাদের নিরাপত্তা নেই। কাকে ভোট দিবে, কাকে দেবে না আর কে এসে চড়াও হবে- এ ভয়ে থাকে জনগণ। তার চেয়ে বড় কথা, নিজেরাই যদি ভোট নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে থাকেন, এক গাছের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন আদর্শের বাণী শোনান, তাহলে জনগণের আর কী-বা করার থাকে, ভোটকেন্দ্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া ছাড়া! এখন জনগণকে সঠিক প্রার্থী বাছাইয়ের সুযোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে বাঘ ও সিংহের লড়াইয়ের আয়োজন করা হোক, দেশ থেকে মেঘ-বৃষ্টি আপনা-আপনি দূরীভূত হবে। তখন আর ভোটে হেরে যাওয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলের নেতাদের এমনটা লিখে ফেসবুকে পোস্ট দিতে হবে না, ‘চলছে বসন্তকাল, দেখছি বর্ষাকাল, অনুভবে শীতকাল।’

 

লেখক : প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads