• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

অদৃশ্য দূষণের কবলে বিশ্ববাসী

  • আলম শাইন
  • প্রকাশিত ১০ মার্চ ২০১৯

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যুগটা বিজ্ঞানের। অবধারিত সত্যটি হচ্ছে, বিজ্ঞানের অবদানেই আজ বিশ্ববাসী হরেকরকম সুবিধা ভোগ করার সুযোগ পেয়েছেন। সেই সুবাদে বলা যায় ঊনবিংশ থেকে একবিংশ শতাব্দীর মানুষ অনেকটাই ভাগ্যবান গত সব শতাব্দীতে জন্মগ্রহণ করা মানুষের তুলনায়। ঊনবিংশ-একবিংশ শতাব্দীর মধ্যে জন্মগ্রহণ করতে পেরে আমরা গর্বিত তাই। কারণ এ সময়েই আমরা পেয়েছি রেডিও থেকে শুরু করে হালের ফোর-জি মোবাইল ফোন পর্যন্ত। শুধু ফোর-জি নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফাইভ-জি চালু হলেও বাংলাদেশে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। হয়তো বছর দুয়েকের মধ্যে আমরা সে সুবিধাও পেয়ে যাব। বিজ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিকের সমন্বয়ে আমরা যা পেয়েছি তা সত্যিই বিস্ময়কর বটে। আমাদের প্রাপ্তির ছোট্ট উদাহরণটি হচ্ছে, বিজ্ঞানের কল্যাণেই মানুষ পৃথিবী ছেড়ে মহাশূন্যে পঁইপঁই করে ঘোরার সুযোগ পেয়েছে। গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ঘোরাঘুরি শুধু বিশালই নয়, মহাবিশাল এক প্রাপ্তি। যে প্রাপ্তি মানবজাতির জন্য বিরাট অহঙ্কার। এ প্রাপ্তি অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। আমরা ঋণী তাই বিজ্ঞানের কাছে।

শুধু তা-ই নয়, বিজ্ঞান বা বৈজ্ঞানিকের কারণেই আজ আমরা দুর্যোগ আবহাওয়ার আগাম তথ্যাদি পেয়ে থাকি, যাতে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির কবল থেকে রেহাই পান আমজনতাসহ আমাদের সহায়-সম্বলও। পৃথিবীর ওই প্রান্তে কী ঘটছে নিমেষেই খবর পেয়ে যাচ্ছি আমরা। সবকিছু মিলিয়ে আমরা বলতে পারি, এসব শুধু বিজ্ঞানের কল্যাণেই সম্ভব হয়েছে; অন্যথায় আদিম যুগের মানুষের মতো কাটাতে হতো আমাদের। গুহায় বসবাস কিংবা পাতা পরিধান করে কাঁচা খাবারাদি খেয়ে জীবনযাপন করতে হতো। সোজা কথা আমাদের সভ্য হতে শিখিয়েছে বিজ্ঞান। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, বিজ্ঞানের আশীর্বাদে মানবজাতির গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে যেমনি, তেমনি আয়ু হ্রাসও পাচ্ছে দ্রুত। বিজ্ঞানের অধিক হিতকর কাজে এক ধরনের অদৃশ্য দূষণের কবলে পড়ে বিভিন্ন ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মানুষ মৃত্যুর পথে দ্রুত পা বাড়াচ্ছে, যা খুব সহজে টের পাওয়া যায় না।

কারণ এ দূষণ হচ্ছে সম্পূর্ণ অদৃশ্য দূষণ। যে দূষণ খালিচোখে নজরেও পড়ছে না। এমনকি অনুভবও করা যাচ্ছে না; কারণ এটি থাকছে একেবারেই অদৃশ্য। এর প্রতিক্রিয়াও দীর্ঘমেয়াদি। আর সে দূষণটি হচ্ছে ‘তড়িৎ চৌম্বকীয় দূষণ’, যার উৎস অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি এবং আধুনিক সুবিধাদি ভোগের ফলাফলের কারণ। এসব যন্ত্রপাতি বা সুবিধাভোগের কারণে মানুষ লিকোমিয়া, ব্রেন টিউমার এবং ক্যানসারের মতো প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হচ্ছে ব্যাপকহারে। এ ছাড়া এ দূষণের ফলে স্বায়ুতন্ত্রে সমস্যা, অবসন্নতা, স্মরণশক্তি লোপ, হজমে বিপাক এবং অল্প বয়সেই বৃদ্ধ হতে বাধ্য করছে। তড়িৎ চৌম্বকীয় দূষণের শিকার শুধু এ দেশের মানুষই হচ্ছে না, হচ্ছে সমগ্র বিশ্ববাসীই। তবে বেশি শিকার হচ্ছেন তারা-ই, যারা তড়িৎ বিকিরণ ক্ষেত্রে কর্মরত রয়েছেন। যেমন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কর্মরত টেকনিশিয়ান, বিদ্যুতের লাইনম্যান, টেলিফোন বা সেলফোন টাওয়ারের ইলেকট্রিশিয়ান, ইলেকট্রিক রেলওয়ের অপারেটররা। এতসব পেশার লোকেরা অন্যান্য পেশায় কর্মরত লোকের তুলনায় দশগুণ বেশি লিউকোমিয়াসহ ব্রেন টিউমারে অক্রান্ত হচ্ছেন। বিষয়টি নিয়ে লস অ্যাঞ্জেলেসের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব পাবলিক হেলথের গবেষক সুসান প্রিন্সটন মার্টিন ব্যাপক গবেষণা করে এর সত্যতা যাচাই করেছেন।

তিনি জানিয়েছেন, ‘তড়িৎ চৌম্বকীয় বিকিরণে শিশুরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে শিশুর মানসিক বিকাশ যেমন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি শারীরিক বর্ধনশীলেও সমস্যা দেখা দিচ্ছে। উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে, আমরা খবরের কাগজে মাঝে-মধ্যে দেখি, বালকের বয়স দশ বছর অথচ দেখাচ্ছে পঞ্চাশ বছরের মতো। কপালের ভাঁজ কিংবা ঝুলে যাওয়া চামড়ায় বার্ধক্য ধরা পড়ছে। আসলে বয়স খুবই কম। পক্ষান্তরে আবার বেঁটে বামুনের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিশু শারীরিক বিকাশে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে; যার ভূরিভূরি প্রমাণ রয়েছে।

পরিসংখ্যান মোতাবেক জানা যায়, বর্তমান বিশ্বের দেড় শতাধিক কোটি মানুষ তড়িৎ চৌম্বকীয় বিকিরণের শিকার হচ্ছে। বিশেষ করে যারা সেলফোন ব্যবহার করছেন, তাদের প্রত্যেকেই এ দূষণের কবলে পড়ছেন। আর যুব সম্প্রদায় তো তড়িৎ দূষণের শিকার হচ্ছে বহুগুণ বেশি। সেলফোনে তারা প্রতিনিয়ত গান শুনছে হেয়ারফোন কানে ঠেসে ধরে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রিয়জনদের সঙ্গে কথা বলছে; গেমও খেলছে। তার ওপর আবার অনবরত পড়ে থাকে ফেসবুকে। এতে করে ফোনসেটের অদৃশ্য তরঙ্গ যে তাদের কর্ণ প্রদাহসহ ব্রেন টিউমার সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে তা তারা ঘুণাক্ষরেও টের পাচ্ছেন না। বিশেষ করে রাতের অন্ধকারে যারা ফেসবুকে থাকে, তাদের জন্য রয়েছে মহাবিপদ সঙ্কেত। ফোনের নীল আলোকরশ্মি চোখসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে যা সহজে টের পাওয়া যায় না। এ চিত্র শুধু আমাদের দেশেই নয়, সমগ্র বিশ্বের তরুণ সমাজেই এটি পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে উপমহাদেশীয় অঞ্চলে যেন একটু বেশিই লক্ষ করা যাচ্ছে।

উল্লেখ্য, হালে শুধু তরুণরাই নয়, বয়স্করাও ফেসবুকে আকৃষ্ট হয়ে নীল রশ্মির কোপানলে পড়ছেন। সেলফোনের তড়িৎ চৌম্বকীয় বিকিরণ নিয়ে এ পর্যন্ত বহু গবেষণাও হয়েছে। ফল বরাবরই একই রকম, মোটেই সন্তোষজনক নয়। সম্প্রতি ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব মেডিসিন ও কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের গবেষণায় দেখা যায়, সেলফোন থেকে বের হওয়া মাইক্রোওয়েভ রেডিয়েশন মানুষের মস্তিষ্কের ডিএনএ অণুকে ৫০ শতাংশ খণ্ডিত করছে। যার ফলে মানুষের স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়ে যাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। গবেষণায় আরো দেখা যায়, যারা নিয়মিত সেলফোন ব্যবহার করেন, তাদের প্রত্যেকেই তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে চোখ, মুখ, নাক, গলা এমনকি মস্তিষ্কে দারুণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে। ক্ষতিগ্রস্ত করছে চোখের নরম টিস্যুকেও। সমীক্ষায় জানা যায়, দশ বছরের বেশি সময় ধরে যারা সেলফোন ব্যবহার করছেন, তাদের ব্রেন টিউমার হওয়ার আশঙ্কা অন্যদের চেয়ে ৪০ শতাংশগুণ বেশি। আমরা জানতে পেরেছি, ২০১০ সালে সুইডেন মেডিকেল ইনস্টিটিউট প্রায় এগারো হাজার সেলফোন ব্যবহারকারীর ওপর এক সমীক্ষা চালিয়েছে।

সমীক্ষার ফলাফল থেকে জানা যায়, ‘সেলফোন ব্যবহারের ফলে ব্যবহারকারী তড়িৎ চৌম্বকীয় দূষণের শিকার হয়ে নিয়মিত ক্লান্তিবোধের পাশাপাশি মাথাব্যথা রোগে ভুগছেন’। এ গবেষণার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসকরাও। তারা তৎসঙ্গে সতর্কবাণী জুড়ে দিয়ে বলেছেন, ‘তড়িৎ চৌম্বকীয় বিকিরণের কারণে শিশুদের দেহকোষ দুর্বল হয়ে যাচ্ছে; তৎসঙ্গে জেনেটিক ড্যামেজও ঘটছে। ভয়ঙ্কর এ দুর্যোগের খবরের ওপর ভিত্তি করে ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গ ও ক্যানসার ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. রোনাল্ড হেবারম্যান গবেষণা করে তার সংস্থার প্রায় হাজার তিনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে তড়িৎ চৌম্বকীয় বিকিরণের ব্যাপারে সতর্ক করে দেন। তিনি সবাইকে জানিয়ে দেন সেলফোন শরীর থেকে যেন খানিকটা দূরে রাখা হয় এবং অবশ্যই যেন তা শিশুদের নাগালের বাইরে রাখা হয়, সে বিষয়েও দৃষ্টি দেওয়ার কড়া হুশিয়ারি সঙ্কেত দেন। তিনি আরো জানিয়েছেন, ‘রাতে শোয়ার সময় সেলফোন যেন তিন গজ দূরত্বে রাখা হয়।’

গত দশক ধরেও আমরা জেনে এসেছি শুধু পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তার ফলেই এ ধরনের অদৃশ্য দূষণ ঘটছে। উপরোক্ত বিষয়ের কারণে যে তড়িৎ চৌম্বকীয় দূষণ ঘটতে পারে তা আমাদের অনেকেরই অজানা ছিল। আমরা আধুনিক যন্ত্রপাতির সুবিধা ভোগ করে সবাই খানিকটা মজে গিয়েছি সত্য কিন্তু এটি যে মানবজাতির জন্য প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়াবে তা হয়তো ঘুণাক্ষরেও কেউ ভাবেননি আগে, যে ভাবনাটা এখন ভাবতে হচ্ছে আমাদের। সেই ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বলতে হচ্ছে, সেলফোন বন্ধ করে নয় বরং উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে তড়িৎ চৌম্বকীয় দূষণের কবল থেকে বিশ্ববাসীকে মুক্ত করতে সচেষ্ট হোন। সেই অনুরোধটিই জানাচ্ছি আমরা সেলফোন কোম্পানি এবং সেট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানকে। আশা করছি বিষয়টি মাথায় নিয়ে মানবকল্যাণে এগিয়ে আসবেন, সে প্রত্যাশাই রইল।

 

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও বন্যপ্রাণীবিশারদ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads