• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
নির্দোষ জাহালমের কারাবাস

নির্দোষ জাহালম

ছবি : সংগৃহীত

মতামত

নির্দোষ জাহালমের কারাবাস

  • আফরোজা পারভীন
  • প্রকাশিত ১২ মার্চ ২০১৯

জাহালম তিন বছর জেল খেটে মুক্তি পেয়েছে। এই তিনটি বছর আবু সালেক না হয়েও সালেক বানিয়ে রাখা হয়েছে তাকে। তার কোনো আর্জি আকুতি হাহাকার কারো হূদয়ে মন্থন তোলেনি। সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির ৩৩টি মামলায় জেল খেটেছে জাহালম। অথচ প্রকৃত আসামি সালেক। জাহালম দেখতে সালেকের মতো, এটাই তার অপরাধ। সেই অপরাধে আবু সালেকের বদলে জেল খেটেছেন, আদালতে হাজিরা দিয়েছেন জাহালম। তিনি পেশায় পাটকল শ্রমিক।

পাঁচ বছর আগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি চিঠি বদলে দেয় জাহালমের জীবন। তার বাড়ি টাঙ্গাইলের ঠিকানায় দুদকের একটি চিঠি যায়। সেই চিঠিতে ২০১৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৯টায় জাহালমকে হাজির হতে বলে দুদক। জাহালম তখন নরসিংদীর ঘোড়াশালের বাংলাদেশ জুট মিলে শ্রমিকের কাজ করছিলেন।

দুদকের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ভুয়া ভাউচার তৈরি করে সোনালী ব্যাংকের ১৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এই জালিয়াতির সঙ্গে আবু সালেক নামের এক লোক জড়িত। তার সোনালী ব্যাংক ক্যান্টনমেন্ট শাখায় হিসাব রয়েছে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, আবু সালেকের ১০টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ভুয়া ঠিকানাগুলোর একটিতেও জাহালমের গ্রামের বাড়ির ঠিকানা নেই। রয়েছে পাশের আরেকটি গ্রামের একটি ভুয়া ঠিকানা।

নির্ধারিত তারিখে জাহালম ভাইসহ হাজির হন দুদকের ঢাকার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। জাহালম দুদকের কর্মকর্তার সামনে বলেছিলেন, ‘স্যার, আমি জাহালম। আবু সালেক না। আমি নির্দোষ।’ দুদক কর্মকর্তারা জাহালমের কাছে জানতে চান, আবু সালেক নাম দিয়ে তিনি সোনালী ব্যাংকে হিসাব খুলেছিলেন কি-না? জাহালম স্পষ্ট করে জানান, সোনালী ব্যাংকে তার কোনো হিসাব বা লেনদেন নেই। তিনি সামান্য বাংলা জানেন। ইংরেজিতে স্বাক্ষরও করতে পারেন না। আবু সালেক নামে ব্যাংকের হিসাবটিও তার না। হিসাব খোলার ফরমে আবু সালেকের যে ছবি, তা-ও তার না। অথচ সেদিন দুদকে উপস্থিত বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তারা সবাই জাহালমকেই ‘আবু সালেক’ বলে শনাক্ত করেন। কারণ দুজনই দেখতে প্রায় একই রকম।

সেদিন ছেড়ে দিলেও ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি নরসিংদীর ঘোড়াশালের মিল থেকে জাহালমকে আটক করে পুলিশ। জাহালম জানতে পারেন, তার নামে দুদক ৩৩টি মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছে। তার বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংকের সাড়ে ১৮ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। তিনি একজন বড়মাপের অপরাধী। যে লোকটি একজন শ্রমিক, ১৮ কোটি তো দূরের কথা, ১৮ হাজার টাকাও কখনো একসাথে দেখেছে কি-না সন্দেহ। সে রাতারাতি সাড়ে ১৮ কোটি টাকা আত্মসাতের দায়ে বড় অপরাধীতে পরিণত হয়। সেদিন পুলিশের কাছেও জাহালম একই কথা বলেন, ‘স্যার, আমি জাহালম। আবু সালেক না। আমি নির্দোষ।’ কেউ শোনে না তার আকুতি।  ঠাঁই হয় কারাগারে।

কারাগারে কাটতে থাকে তার দিন। জাহালমকে আদালতে হাজির করলে তিনি বার বার বলেন, ‘আমি জাহালম। আমার বাবার নাম ইউসুফ আলী। মা মনোয়ারা বেগম। বাড়ি ধুবড়িয়া গ্রাম, সাকিন নাগরপুর ইউনিয়ন, জেলা টাঙ্গাইল। আমি আবু সালেক না।’ ভাই শাহানূর দিনের পর দিন আদালতের বারান্দায় ঘুরতে থাকেন। জাহালমের স্ত্রী থাকেন নরসিংদীতে। তিনিও সেখানকার একটি কারখানার শ্রমিক। বৃদ্ধা মা থাকেন ধুবড়িয়া গ্রামে। ছেলে টাকা পাঠাতে পারে না, সে জেলে। ঝিগিরি করে পেট চালান মা। ধারদেনা করে মামলার খরচ চালান।

আদালতের বারান্দায় ঘুরে ঘুরে চরম হতাশ আর ক্লান্ত শাহানূর গত বছরের শুরুর দিকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে হাজির হন। ঘটনা খুলে বলেন। সব শুনে অনুসন্ধানে নামে মানবাধিকার কমিশন। কাশিমপুর কারাগারে গিয়ে জাহালমের সঙ্গে কথা বলেন কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। কমিশনের তদন্তে বেরিয়ে আসে, আবু সালেক আর জাহালম এক ব্যক্তি নন। জাহালম নিরপরাধ। এ কথা ঢাকার আদালতকেও জানায় কমিশন। জানায় বিনা অপরাধে জাহালম তিন বছর জেল খাটছেন। সামাজিকভাবে নির্যাতিত, অপদস্থ হয়েছেন।

অপরাধী সালেক গত বছর ভারতে পালিয়ে গেছে বলে জানা গেছে। দুদক বলছে, তদন্তকারীরা ভুল করে আবু সালেকের বদলে জাহালমের নামে অভিযোগপত্র দিয়েছেন। ভুল যার কারণেই হোক, জাহালমের জীবনের তিনটি বছর খসে গেছে এটাই বাস্তবতা। সমাজের চোখে, রাষ্ট্রের চোখে তিনি চিহ্নিত হয়েছেন অপরাধী হিসেবে। হারিয়েছেন সামাজিক সম্মান। না জানি তার স্ত্রী-পরিজনকে কত অসম্মান সইতে হয়েছে! তাছাড়া ভুল হবেই বা কেন? ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সময় ভোটার আইডি কার্ডের কপি দেওয়া বাধ্যতামূলক। সেটা কী যাচাই করেনি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ? নাকি আইডি কার্ড ছাড়াই অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন? যে স্বাক্ষর জাহালমের নয় বলে সে বার বার দাবি করেছে, সেই স্বাক্ষরটি ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্ট দিয়ে পরীক্ষা করানো যেত না? তাছাড়া একরকম দেখতে এটাই যদি বিচারের মানদণ্ড হয়, তাহলে তো এদেশের যমজ সন্তানদের বড়ই বিপত্তি। কখন যে কে কার অপরাধে জেল খাটে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাছাড়া জাহালম পাটকলে কাজ করতেন। তিনি যে পাটকলে কাজ করতেন, সেখানে গেলেই তো জানা যেত তিনি কে। বা তার এলাকায় গেলেই যাচাই করে নেওয়া যেত। এর কোনো কিছু না করেই তার বিরুদ্ধে চার্জশিট হয়ে গেল? আরেকটা কথা, সালেক পালিয়ে গেল কী করে? এদেশের অধিকাংশ অপরাধী পালিয়ে যায় কীভাবে বছরের পর বছর? এটা কি খতিয়ে দেখা হয় না? ব্যাংকের এক বা একাধিক ব্যক্তি এই চুরির ব্যাপারে তাকে সহযোগিতা করেছে বলে আমার বিশ্বাস। এমনই যদি হয় ব্যাংকের অবস্থা, তাহলে এসব ব্যাংকে গচ্ছিত জনগণের কষ্টের আমানত কতটা নিরাপদ!

অন্যদিকে ২২টি বছর খসে গেছে ফজলু মিয়ার জীবন থেকে। সিলেট কারাগারে বন্দি ছিলেন তিনি। মুক্তি পাওয়ার পর তাকে বরণ করতে আসেন রাষ্ট্রের পিপি (পাবলিক প্রসিকিউটার)। তাতে কি ফজলুর জীবনের হারানো ২২ বছর ফিরে আসবে! ফজলু মিয়াকে ১৯৯৩ সালের ১১ জুলাই ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করে পুলিশ। তার আচরণে অস্বাভাবিকতার কথা বলে উন্মাদ আইনে গ্রেফতার দেখিয়ে অভিযোগপত্র দেয়। তিনি আজ এক ন্যুব্জ ভেঙে যাওয়া মানুষ। এই চব্বিশ বছরের কারাবাসকালে তিনি প্রায় ২০০ বার আদালতে হাজিরা দিয়েছেন। রায় বা মুক্তি কোনোটিই মেলেনি। শেষ পর্যন্ত ফজলুর জামিনের ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু বিনা বিচারে অপচয় হওয়া ২২ বছর আজ কে তাকে ফিরিয়ে দেবে? ফজলু মিয়া এখন অপ্রকৃতিস্থ। কিছুই মনে নেই তার। কে কে ছিল তার? বউ ছেলে মেয়ে! ছিল কি?

বাবুলের জীবনের ইতিহাসও এক। ১৯৯২ সালে এক ডাকাতির মামলায় গ্রেফতার হয়েছিলেন বাবুল। ২৪ বছর ধরে চলছে বাবুলের মামলা। এই ২৪ বছরে মামলার ১১ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র চারজন সাক্ষীকে আদালতে হাজির করেছে পুলিশ। মামলার বাদী নজরুল কিংবা তদন্ত কর্মকর্তা আশরাফ কখনো আদালতে হাজির হননি। শেষ পর্যন্ত আদালত তাকে নির্দোষ সাব্যস্ত করেছে। কিন্তু অন্ধকার কারা প্রকোষ্ঠে কেটেছে তার অকারণ ২৪ বছর।

কিন্তু কেন এই জীবনের অপচয়? জানা যায় বিনা বিচারে ৬০ বছর ধরে জেলে আছেন এমন ঘটনাও আছে। জেলে যারা আছেন, তাদের মধ্যে বিরাট সংখ্যক মানুষ নির্দোষ। আইনের মারপ্যাঁচ আর কমজোর হওয়ার কারণে তারা বছরের পর বছর জেল খাটছেন। অথচ আইনে বলা আছে, একজন নির্দোষ ব্যক্তিও যেন সাজা না পায়।

চলচ্চিত্র নির্মাতা অমিতাভ রেজা তার ‘আয়নাবাজি’ চলচ্চিত্রে এক ব্যক্তির কাহিনি তুলে ধরেছিলেন। অন্যের জন্য জেল খাটা যার পেশা। এমন লোকও আছেন জেলখানায়, টাকার বিনিময়ে যারা জেল খাটেন আর সেই টাকায় বাইরে প্রতিপালিত হয় তার পরিবার। ছেলের শিক্ষা, মেয়ের বিয়ে সব চলে ওই বন্দি জীবনের বিনিময়ে। আর আইনও এমন যে তাদের ধরতে পারে না। অথবা ধরতে চায় না। ধরা পড়ে নির্দোষ মানুষেরা। আর বিনা অপরাধে জেল খাটে জাহালমের মতো মানুষেরা। সুচিত্রা-উত্তম অভিনীত ‘সবার উপরে’ চলচ্চিত্রে আমরা পেয়েছিলাম এমন এক আসামিকে (ছবি বিশ্বাস), যিনি বিনা অপরাধে ১২ বছর জেল খেটেছিলেন। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘ফিরিয়ে দাও আমার সেই হারানো বারোটি বছর।’ কিন্তু যে সময় চলে যায় তা আর ফেরে না। তাই সাজা দেওয়ার ব্যাপারে প্রয়োজন সর্বোচ্চ সতর্কতা।

যাদের কারণে নিরীহ জাহালম, বাবুল, ফজলু মিয়ারা অপরাধী না হয়েও কারাগারে থাকে, তাদের চিহ্নিত করা জরুরি। জাহালমের ব্যাপারে দুদক ইচ্ছা করলে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। যা হয়েছে, তা চরম অন্যায়। জাহালমের পরিবার আদালতের কাছে প্রতিকার চেয়ে আবেদন করতে পারে। ইতোমধ্যে ক্ষতিপূরণ হিসেবে তাকে ১০ কোটি টাকা প্রদানের দাবি উঠেছে। তবে সমস্যা হচ্ছে, আমাদের দেশে কোনো একটি ঘটনা ঘটার পর বিচারের দাবি, ক্ষতিপূরণের দাবিসহ নানান দাবি-দাওয়া ওঠে। দু-চারদিন মাঠ গরম হয়। তারপর সব হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্তরা পড়ে থাকে সেই একই তিমিরে।

বিনাবিচারে কাউকে কারাগারে আটকে রাখা চরম অন্যায়। বিনাবিচারে কারাগারে কেউ আটক রয়েছে কি-না, সে বিষয়ে জরুরি তদন্ত করা প্রয়োজন। ভিকটিমদের চিহ্নিত করে তাদের মুক্ত করার ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। তাছাড়া যেসব বন্দি দীর্ঘদিন জেলখানায় থেকে শারীরিকভাবে অচল হয়ে পড়েছে, তাদের বিষয়ে বিবেচনা করাও প্রয়োজন।

আমাদের দেশের দরিদ্র ও নিরক্ষর জনগণ আইনি অধিকার সম্পর্কে জানে না। সচেতনও নয়। দেশের প্রতিটি মানুষের আইনি অধিকার নিশ্চিত করতে হলে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সচেতনতা বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া আবশ্যক। আইন নাগরিককে কতটুকু কী অধিকার দিয়েছে, সেটা জানলে অকারণ জেল-জুলুমের হার কমে যাবে।

 

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাবেক যুগ্ম সচিব

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads