• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
স্ত্রীর অনুমতি এবং স্বামীর সিদ্ধান্ত

স্ত্রীর অনুমতি এবং স্বামীর সিদ্ধান্ত

প্রতীকী ছবি

মতামত

স্ত্রীর অনুমতি এবং স্বামীর সিদ্ধান্ত

  • অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
  • প্রকাশিত ১৩ মার্চ ২০১৯

পৃথিবীতে সবচেয়ে মধুর সম্পর্ক হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। স্বামী-স্ত্রী একে অপরের পরিপূরক। যে কোনো সংসারেই সাবলীল ও মধুর আনন্দ বজায় রাখতে প্রয়োজন দুজনার ঐকমত্য। স্বামীকে মনে রাখতে হবে, স্ত্রীকে হেয় করে বা তার কথা বা কাজকে অবহেলা করলে কিংবা গুরুত্ব না দিলে হূদয়ের টান কমতে থাকে, জন্ম নেয় অজানা চাপা ক্ষোভ, যা ভালোবাসার দুর্গে আঘাত হানতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে একেবারেই স্বামী-স্ত্রীর অমতে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। যদি একতরফা সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে রয়েছে শাস্তির ব্যবস্থা। এবার জেনে নেওয়া যাক কোন কোন ক্ষেত্রে স্ত্রীর অমতে স্বামী সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।

 

দেনমোহর, ভরণপোষণ ও সন্তানের অধিকার

দেনমোহর ও ভরণপোষণ স্ত্রীর অধিকার। এ দুটি থেকে স্ত্রীকে কখনো বঞ্চিত করা যাবে না। ‘সহবাসের আগে এবং পরে স্ত্রী স্বামীর কাছে দেনমোহর দাবি করতে পারে এবং স্বামী পরিশোধে ব্যর্থ হলে স্ত্রী সহবাসে যেতে অস্বীকার করতে পারেন’ (মাহমুদা খাতুন বনাম আবু সাইদ ২১ ডিএলআর)। এ অজুহাতে স্বামী স্ত্রী থেকে দূরে অবস্থান করলেও তা পরিশোধে বাধ্য (১১ ডিএলআর, পৃষ্ঠা ১২৪)। স্ত্রী যতদিন তার স্বামীর আস্থাভাজন থাকবেন ও স্বামীর ন্যায়সঙ্গত আদেশ পালন করবেন, ততদিন স্বামী স্ত্রীকে ভরণপোষণ দেবেন। তবে কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণে স্ত্রী আলাদা বসবাস করলে স্বামী ভরণপোষণ দিতে বাধ্য (মো. ইব্রাহিম হোসেন সরকার বনাম মোসা. সোলেমান্নেসা ১৯৬৭, ১৯ ডিএলআর, পৃষ্ঠা ৭৫১)।

‘ধনী ব্যক্তির ওপর তার সামর্থ্য অনুযায়ী এবং গরিব ব্যক্তির ওপর তার সামর্থ্য অনুযায়ী ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা কর্তব্য’ (সুরা আল বাকারা : ২৩৬)।

এ ছাড়া কোনোভাবে বিয়ে বলবৎ থাকুক আর না থাকুক, বৈধ কারণ ছাড়া সন্তানকে কাছে রাখা থেকেও বঞ্চিত করা যায় না। তবে আবু বকর সিদ্দিকী বনাম এস এম এ বকর ৩৮ ডিএলআরের মামলায় এই নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, যদি আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয় যে, সন্তান মায়ের হেফাজতে থাকলে তার শারীরিক ও মানসিক বিকাশ স্বাভাবিক হবে, সন্তানের কল্যাণ হবে এবং স্বার্থ রক্ষা হবে— সে ক্ষেত্রে আদালত মাকে ওই বয়সের পরেও সন্তানের জিম্মাদার নিয়োগ করতে পারেন।

 

জমিজমা টাকা-পয়সা বিষয়ে 

স্ত্রীর নামে যদি কোনো জমিজমা থাকে, তবে তার অনুমতি ব্যতিরেকে এ সম্পত্তি বিক্রি করা যাবে না। যদি কোনো স্ত্রী তার স্বামীকে অনুমতি দেয় কিংবা বিক্রির ক্ষমতা প্রদান করে থাকে (আমমোক্তারের মাধ্যমে), সে ক্ষেত্রে কেবল সম্ভব। তবে আমমোক্তার অবশ্যই আইন অনুযায়ী সম্পাদন করতে হবে। এছাড়া স্বামী-স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া বা সম্মতি ছাড়া পুরো সম্পত্তি উইল করতে পারবেন না। কারণ স্ত্রী হচ্ছেন তার উত্তরাধিকার। স্ত্রীর নামে কোনো ব্যাংক হিসাব খুললে এবং তাতে টাকা জমা রাখলে কিংবা সঞ্চয়পত্র খুললে তা স্বামী চালু করলেও স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া এবং স্ত্রী ছাড়া স্বামী তা থেকে টাকা উত্তোলন করতে পারবেন না। স্ত্রী হচ্ছেন সেই সম্পত্তির মালিক। হিসাবটি স্ত্রীর নামে খোলা হয়েছে। স্ত্রীকে কোনো কিছু উপহার দিলে তা স্ত্রীরই সম্পত্তি। তার অমতে তা সরিয়ে নেওয়া যায় না। যেমন স্ত্রীকে যদি কোনো স্বর্ণালঙ্কার দিলে তা স্ত্রীরই সম্পত্তি। স্ত্রীর নামে ফ্ল্যাট বা জমি কেনা হলে তা তার সম্পত্তি। স্ত্রী ছাড়া কেউ তা হস্তান্তর করতে পারবে না।

 

স্ত্রীর অনুমতি ব্যতিরেকে বিয়ে

আইন অনুযায়ী এক স্ত্রী জীবিত থাকা অবস্থায় আরেকটি বিয়ে করা যাবে না। এক্ষেত্রে স্ত্রী সম্মতি না দিলে তা কোনোভাবেই জায়েজ হবে না অর্থাৎ দ্বিতীয় বিয়ে করা যাবে না। স্ত্রীর অমতে দ্বিতীয় বিয়ে করলে তা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হবে। তবে কারো যদি স্ত্রী বর্তমান থাকাকালে আরেকটি বিয়ে করার প্রয়োজন হয়, তাহলে তাকে তার বর্তমান স্ত্রী যে এলাকায় বসবাস করছেন, সেই এলাকার সালিশি পরিষদের কাছে আরেকটি বিয়ে করার অনুমতি চেয়ে আবেদন করতে হবে। সালিশি পরিষদে যদি বর্তমান স্ত্রী অনুমতি প্রদান না করেন, তাহলে কোনোভাবেই দ্বিতীয় বিয়ে করা যাবে না।

সালিশ পরিষদ এবং স্ত্রীর অমতে বিয়ে করলে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৬(৫) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ সৃষ্টি হয়। আদালতে দোষী প্রমাণিত হলে দোষী ব্যক্তিকে এক বছর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে। আবার দ্বিতীয় স্ত্রীর কাছে যদি আগের বিয়ের কথা গোপন করেন, তাহলেও দণ্ডবিধি অনুযায়ী কঠিন শাস্তি পেতে হবে।

 

স্ত্রীর অনুমতি ব্যতিরেকে দীর্ঘদিন বাইরে অবস্থান করা

কোনো ন্যায়সঙ্গত কারণ ছাড়াই স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া দীর্ঘদিন বাইরে থাকা যাবে না। এর জন্য ইসলামী বিধান সর্বোচ্চ চার মাসের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে। স্বামীর কর্তব্য হচ্ছে এ সময়ের মধ্যে সে তার স্ত্রীর সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক স্থাপন করে নেবে।

‘যারা নিজেদের স্ত্রীদের কাছে না যাওয়ার শপথ করে, তাদের জন্য চার মাসের অবকাশ রয়েছে। যদি তারা এ থেকে প্রত্যাবর্তন করে তাহলে আল্লাহ ক্ষমাশীল ও মেহেরবান। আর যদি তারা তালাক দেওয়ারই সংকল্প করে, তাহলে আল্লাহ সবকিছুই শোনেন ও জানেন’ (সুরা আল বাকারা : ২২৬-২২৭)।

এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, স্ত্রী হিসেবেও ইসলাম নারীর অধিকার সংরক্ষণ করেছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, তারা তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরাও তাদের পরিচ্ছদ (সুরা আল-বাকারা, আয়াত ১৮৭)। ইসলাম বিয়ের ব্যাপারে সুস্পষ্ট বিধান প্রদান করেছে। বহুবিবাহ প্রথাকে নস্যাৎ করার জন্য চারজন পর্যন্ত স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি দেওয়া হলেও সে ক্ষেত্রে কিছু শর্ত আরোপ করা হয়েছে। যার কারণে ইচ্ছা করলেই একাধিক স্ত্রী গ্রহণের প্রবণতা রোধ হয়ে যায়। প্রত্যেক স্ত্রীর ওপর সুবিচার করার ক্ষমতা ও সামর্থ্য না থাকলে একটি বিয়ে করার নির্দেশ জারি রাখা হয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর বিয়ে বিচ্ছেদকে ইসলাম নিরুৎসাহিত করেছে। মহানবী (সা.) বলেছেন, এটি শরিয়তে জায়েজ হলেও আল্লাহতায়ালা পছন্দ করেন না। আর তা হচ্ছে তালাক।’

 

লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads