• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
দারিদ্র্য বিমোচন ও ইসলামী অর্থনীতির সন্ধানে

দারিদ্র্য বিমোচন ও ইসলামী অর্থনীতির সন্ধানে

প্রতীকী ছবি

মতামত

দারিদ্র্য বিমোচন ও ইসলামী অর্থনীতির সন্ধানে

  • হারুন-আ র-রশিদ
  • প্রকাশিত ২১ মার্চ ২০১৯

নন্দিত অর্থনীতি কী, সাম্যবাদী অর্থনীতি কাকে বলে- একটি বাক্য দিয়ে তার মর্ম আমরা উপলব্ধি করতে পারব। এই বাণীটি নবীজির হাদিস। রসুল (সা.) কোরআনের বাইরে একটি কাজও করেননি। যেহেতু এটা আল্লাহর বাণী আর তা হলো, ‘শ্রমিকের শরীরের ঘাম শুকিয়ে যাওয়ার আগেই তার মজুরি পরিশোধ কর।’ নবীজির নবুয়তপ্রাপ্তির পর ২৩ বছরের জীবন ছিল কোরআনের আলোকে গড়া। কোরআন অর্থনীতির যে দিকনির্দেশনা দিয়েছিল, রসুল (সা.) সেই অর্থনীতি মদিনার শাসনব্যবস্থায় বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন। রসুল (সা.) বলেছিলেন, ‘গরিব প্রতিবেশীদের সাহায্য কর, সে যে ধর্মেরই মানুষ হোক না কেন। তাকে সামর্থ্য অনুযায়ী অর্থ দিয়ে, যদি অর্থ না থাকে তা হলে কর্মের মাধ্যমে বা মৌখিক ভালোবাসা দিয়ে হলেও তাকে সাহায্য কর।’ এতিমদের হক আদায় করা ছাড়া ধনীরা অর্থাৎ সম্পদশালীরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। এর অর্থ হলো, ধনীদের অর্থের ওপর গরিবের হক আছে। সুতরাং জাকাত প্রদান কর। তাহলে ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে বৈষম্য থাকবে না। নামাজে দাঁড়ালে ধনী গরিব এতিম মিসকিন যেমন এক হয়ে যায়, ঠিক তেমনি তোমরা তোমাদের অর্থব্যবস্থা কায়েম কর, তাহলে পৃথিবীটাই বদলে যাবে ইতিবাচকভাবে। মানুষ তখন পৃথিবীতে শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। কোনো রকম হিংসা-বিদ্বেষ, সন্ত্রাস-ফেতনা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা কিছুই থাকবে না। অর্থনীতির দাসত্ব থেকে পৃথিবীর সব মানুষ মুক্তি পাবে। খোলাফায়ে রাশেদিনের ৩০ বছরের শাসনামলে নবীজির চার উত্তরসূরি ওই অর্থনৈতিক শাসনব্যবস্থা অর্ধপৃথিবীর বেশিরভাগ অংশে কায়েম করেছিলেন বিধায় অনৈতিক অর্থব্যবস্থা বর্তমানে যেভাবে দাসত্ব, প্রভুত্ব, বৈষম্য সৃষ্টি করেছে তা তখন ছিল না। থালাবাসন নিয়ে মসজিদের পাশে রাস্তার ধারে কোনো ভিক্ষুককে তখন দেখা যায়নি। হজরত ওমর (রা.)-এর আমলে এমনও দেখা গেছে, সরকারি কোষাগার থেকে অর্থ ও খাদ্য দিয়ে সাহায্য দেওয়ার মতো আরব ভূখণ্ডে কোনো মানুষ খুঁজে পাওয়া যায়নি। যে জন্য হজরত ওমর (রা.) উচ্চকণ্ঠে বলার সাহস পেয়েছিলেন, ফোরাত নদীর পাশে যদি একটি কুকুরও না খেয়ে থাকে তা হলে আল্লাহর দরবারে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে। এরকম অর্থব্যবস্থা বিশ্বের কোথাও এখন খুঁজে পাওয়া যাবে কি? যে কথাটি প্রথম বলেছিলাম— একমাত্র ইসলাম ছাড়া বৈষম্যহীন অর্থব্যবস্থা বিশ্বে আর কেউ দিতে পারেনি। কাজের বিনিময়ে পাওনা পরিশোধ, তাও সঙ্গে সঙ্গে পাওনা মিটিয়ে দেওয়া হতো। জামানত রাখলে বা কোনো কিছুর বিনিময়ে ওয়াদাবদ্ধ হলে তা খেয়ানত করা হতো না। এমন এক অর্থব্যবস্থা বা জীবনপ্রণালি, ইংরেজিতে যাকে বলে চবড়ঢ়ষবং ঙৎরবহঃবফ ঊপড়হড়সরবং, বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় গণমুখী অর্থনীতি। এই অর্থব্যবস্থা ইসলামের সোনালি যুগে অর্ধপৃথিবীতে কায়েম করা হয়েছিল। শোষণের কোনো প্রক্রিয়া সেই অর্থব্যবস্থায় ছিল না। বুর্জুয়া ও আমলাতান্ত্রিক সৃষ্টির কোনো সুযোগ রাখা হয়নি সেই অর্থব্যবস্থায়। কেউ থাকবে গাছতলায়, কেউ থাকবে পাঁচতলায়- এই শিক্ষা ইসলামিক অর্থনীতিতে ছিল না। ইসলামের অর্থনীতির মূল শিক্ষা ছিল- রাজার আগে প্রজার বাড়ি নির্মিত হতে হবে। রাজা বা শাসকসম্প্রদায় শানশওকতে থাকবে, বিলাসী জীবনযাপন করবে আর প্রজা শুধু শোষিত হয়ে কষ্ট পাবে, এ ধরনের অর্থনীতি ইসলামের ৩০ বছরের শাসনামলে দেখা যায়নি। বিদেশি কোনো মেহমান এলে স্বচক্ষে দেখতে পেতেন ‘অর্ধপৃথিবীর শাসনকর্তা শুয়ে আছেন বা বিশ্রাম নিচ্ছেন ক্ষণিকের জন্য খেজুরের পাতায় নির্মিত চাটাইয়ে উন্মুক্ত আকাশের নিচে খোলা ময়দানে।’ তার কোনো নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না, দেহরক্ষী পর্যন্ত তার জন্য বরাদ্দ করা হয়নি। এটাই ছিল খলিফার নির্দেশ। তিনি বলতেন তার নিরাপত্তার জন্য আল্লাহর সাহায্যই যথেষ্ট; কারণ হলো শাসনকর্তা সব মানুষকে একই নিয়মে পর্যবেক্ষণ করতেন। দল মত ধর্ম এবং বর্ণ এসব তখন বিবেচনায় ছিল না। বিচেনায় ছিল মানুষ।

হজরত ওমরের কঠোর বার্তা- ফোরাত নদীর কূলে কোনো কুকুর যদি না খেয়ে থাকে তাহলে আমি ওমরকে রোজ কেয়ামতের দিন জবাবদিহি করতে হবে। ধর্ষণ, সন্ত্রাস, দুর্নীতি কাকে বলে মানুষ সেই সময় জানত না। এক রূপবতী মহিলা জরুরি প্রয়োজনে গভীর রাতে মরুময় সড়ক দিয়ে পথ চললে কেউ তার শালীনতা নষ্ট করার সাহস পেত না। সিস্টেমই বলে দিত তোমার নজর খারাপ কাজ থেকে অবনমিত করো। অন্যথায় কঠোর শাস্তি। ইসলামী শাশ্বত বাণী যখন অন্তরে প্রবেশ করে, তখন সে আর খারাপ কাজ করতে পারে না। আজ আমাদের হূদয়ে কতগুলো রোগ বাসা বেঁধেছে, যেমন— লোভ-লালসা, কামনা-বাসনা, প্রতিহিংসা, গীবত, অন্যের ক্ষতির চিন্তা- যার কারণে কোনো কাজই সুষ্ঠুভাবে সুপরিকল্পিতভাবে সম্পন্ন হচ্ছে না। পুলিশ, মিলিটারি, র্যাব, বিজিবি দিয়েও কাজ হচ্ছে না। নৈতিকতা যদি শক্ত না হয় তাহলে কোনো প্রক্রিয়া দিয়ে অপরাধ দমন করা যাবে না। সাম্যবাদী রাষ্ট্র এবং তার অর্থনৈতিক কাঠামোগত ব্যবস্থা কেমন ছিল, উল্লেখিত স্বল্প আলোচনায় যে কোনো জ্ঞানী মানুষ তা উপলব্ধি করতে পারবেন। আজকের বিশ্বায়ন পুরো পৃথিবীকে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত করতে পারেনি, যেটা মধ্যযুগে ইসলামের ৩০ বছরের শাসনামলে সম্ভব হয়েছিল।

অনেকেই ভেবে থাকেন- ইসলাম পারলৌকিক ধর্ম, ইহলোকিক ধর্ম নয়। এটা বোঝার ভুল। ইসলাম বলছে, ‘রাব্বানা আতিনা ফিদ দুনিয়া হাসানাত ওয়া...’ পবিত্র কোরআনের সুরা বাকারার ২০১ আয়াতে প্রথমে দুনিয়ার কল্যাণের কথা বলা হয়েছে, আখিরাতের কল্যাণের আগে। ইসলাম এ কথাও জোরালোভাবে বলেছে- তোমরা কাজ কর, আমল কর। কিন্তু তোমরা অলস হয়ে বসে থেকো না। ইসলাম কর্মের ধর্ম। ইসলাম এ কথাও বলেছে— তোমরা ব্যবসা কর হালাল পথে আর এটাই উত্তম পথ। সম্পদের সুষম বণ্টনের কথা এবং মানুষের অধিকারের কথাও বলেছে। মানুষের মৌলিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করতেও নিষেধ করেছে ইসলাম। ইসলাম হলো ‘হাক্কুল ইবাদ’। বান্দার অধিকার ও কল্যাণের জন্য কাজ করতে বলেছে। সাধারণ মানুষ, যাদের ইসলাম সম্পর্কে গভীর জ্ঞান নেই, তারা যথানিয়মে ধর্মীয় কাজগুলো করে। কিন্তু বিজ্ঞ আলেম সমাজ জুমার নামাজের দিন বা কোনো ওয়াজ মাহফিলে, যেখানে সাধারণ মানুষের সমাগম ঘটে অথবা দুই ঈদের খুতবায় উপরে বর্ণিত ইসলামের শাশ্বত সুন্দর ভেজালমুক্ত অর্থনীতির কথা খুব কমই বলেন। সাধারণ মানুষ যদি জানতেন ইসলামের অর্থনীতি এত সুন্দর এবং শোষণের কোনো ফাঁকফোকর নেই তা হলে জনকল্যাণ অনেক এগিয়ে যেত। মানুষের কল্যাণ ঘটলেই উপলব্ধি করা যাবে দেশে অর্থনীতি সাঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে। যখনই দেখা যাবে চলন্ত অর্থনীতিকে বাঁকা পথে নিজেদের স্বার্থে পরিচালিত করা হচ্ছে, তখনই অর্থনীতি বুর্জুয়াদের স্বার্থে, আমলা ও পুঁজিপতিদের স্বার্থে কাজ করে। তারা অর্থের পাহাড় গড়ে অথচ গরিব মানুষ জাকাত হিসেবে সেই সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত থাকে। দারিদ্র্য বিমোচনে এত সুন্দর কৌশল ইসলামে থাকা সত্ত্বেও অর্থব্যবস্থায় তা প্রয়োগ করি না। কোরআনের প্রায় দুইশ আয়াতে মানুষের প্রতি ইনসাফ করার কথা বলা হয়েছে। ইনসাফের মূল অর্থ হলো মানুষের প্রতি জুলুম থেকে বিরত থাকা এবং মানুষের কল্যাণ কামনা করা। প্রয়োজন মেটানোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। ইংরেজিতে যার অর্থ দাঁড়ায়, ঘববফ ভঁষভরষষসবহঃ বা বিষভধৎব. পাশ্চাত্যের এবং ইসলামের ডবষভধৎব ঊপড়হড়সরপ ঝুংঃবস-এ অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। আমি এক নিবন্ধে লিখেছি, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যারা ধনবান, তারা জাকাত হিসেবে পরিবারের অসচ্ছল সদস্যদের মধ্যে বিতরণ বা বণ্টন করলে রাষ্ট্রের বোঝা কমে যায়। ফলে সুদ এবং নানা ধরনের ট্যাক্সের ঝামেলা থেকে রাষ্ট্র বেঁচে যায়। ইসলাম যে সমবণ্টন অর্থব্যবস্থার কথা বলেছে, সেখানে সুদকে পরিহার করে চলতে বলেছে এবং এর পরিবর্তে জাকাতকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বেশি সম্পদশালী ব্যক্তিরা জনস্বার্থে ওয়াক্ফ আইনে টাকা বরাদ্দ করলে এবং উন্নয়নমূলক কাজ করলে বর্তমান হারের চেয়ে আরো বেশি রাষ্ট্র উপকৃত হতো শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে। রাষ্ট্রের জন্য ঋণ এবং সুদ হলো একটি দুষ্ট খেলা। এই খেলায় জুয়াড়ি অর্থাৎ অর্থশালী ব্যক্তিরাই লাভবান হয়। ইসলাম এই কাজটি পরিবার ও সমাজভিত্তিক ধনবান ব্যক্তিদের ওপর ফরজ কাজ জাকাত হিসেবে পরিচালিত করতে বলেছে। এতে সম্পদশালী ব্যক্তির কোনো ক্ষতি হয় না এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠী উপকৃত হয়। পরিশেষে দেখা যায়, উভয় শ্রেণির মানুষ পাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়। অভাবে স্বভাব নষ্ট হয় এই রোগেও মানুষ আক্রান্ত হয় না। রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সেক্টর হলো অর্থনীতি। এই জায়গাটা যদি পরিশুদ্ধ হয় তাহলে গোটা দেশের চেহারায় ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে। এক কথায় বলা যায়, জাকাত এমনভাবে বণ্টন করতে হবে, যাতে প্রতিটি মানুষ কাজ করে (ঝবষভ-বসঢ়ষড়ুসবহঃ) সংসার চালাতে পারে। হজরত ওমর (রা.) এক্ষেত্রে উপমাটি দিয়েছেন এভাবে- এমনভাবে তুমি দান কর যাতে সে ধনী হয়ে যায়। তাকে যেন বার বার জাকাত চাইতে না হয়। এর অর্থ, তাকে তুমি একটি উত্তম কাজে লাগিয়ে দাও।

 

লেখক : অর্থনৈতিক বিশ্লেষক

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads