• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

মননশীল শিক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা

  • রহিম আবদুর রহিম
  • প্রকাশিত ২৯ মার্চ ২০১৯

গত ১৩ মার্চ জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে বলেন, ‘শিশুদের শিক্ষার জন্য অতিরিক্ত চাপ দেওয়া উচিত নয়। তাদের পড়াশোনাটা তারা যেন খেলতে খেলতে, হাসতে হাসতে সুন্দরভাবে নিজের মতো করে পড়তে পারে, সেই ব্যবস্থা করা উচিত। সেখানে অনবরত পড় পড় পড় বলা বা তাদের ধমক দেওয়া, চাপ প্রয়োগ করা- শিক্ষার ওপর তাদের আগ্রহ কমে একটা ভীতি সৃষ্টি করবে। সেই ভীতিটা যেন সৃষ্টি না হয়, সে জন্য আমাদের শিক্ষক ও অভিভাবকদের আমি অনুরোধ করব।’ তার বক্তব্যের সার-সংক্ষেপ হলো, ‘অতিরিক্ত চাপে শিশুদের মধ্যে যেন কোনো ধরনের ভীতির সৃষ্টি না হয়। শিক্ষা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হবে আনন্দঘন, যেখানে শিশুরা খেলার ছলে শিক্ষা অর্জন করবে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে, প্রাথমিকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা থাকছে না। বিষয়টি নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনা সত্যি প্রশংসনীয় এবং গবেষণালব্ধ যা উন্নত বিশ্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং শিশুবান্ধব। অর্থাৎ (ৎবধফরহম ভড়ৎ ঢ়ষবধংঁৎব) আনন্দের জন্য পড়াশোনা। প্রশ্ন, তাহলে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত মূল্যায়ন ধারা কী হবে?

জাপানে শিক্ষাব্যবস্থায় আগে ‘নীতি’ পরে ‘শিক্ষা’; সেই দেশে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত অর্থাৎ ১০ বছর বয়স পর্যন্ত কোনো শিশুকে শিক্ষা নামক প্রতিযোগিতায় নামতে দেওয়া হয় না। অর্থাৎ পরীক্ষা নেওয়া হয় না। তবে তাদের মূল্যায়ন করা হয়। শিশুদের যৌক্তিক ও গবেষণালব্ধ শিক্ষায়, নীতি- নৈতিকতায় যুক্ত হয় ভদ্রতা, নম্রতা, শিষ্টাচার, দেশপ্রেম ও ন্যায়পরায়ণতা। আমরা জানি, তিনটি যোগ্যতা অর্জনকারী একটি প্রাণই পূর্ণাঙ্গ মানুষ। তার প্রথমটা ‘শারীরিক’ যা অর্জন হয় প্রকৃতি ও পরিবেশ থেকে। যাকে আমরা ফরমাল শিক্ষায় শিক্ষিত বলি। এক্ষেত্রে শিশুরা লাফ-ঝাঁপ, দৌড়াদৌড়ি, হাঁটাচলা, খেলাধুলার মাধ্যমে অর্জন করে থাকে। দ্বিতীয় যোগ্যতা ‘মানসিক’ অর্থাৎ এবার শিশুটি ‘ভালো-মন্দ’ বুঝতে শিখবে, যা শিখতে হলে বাস্তবতার সঙ্গে শিশুটি নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারবে। জগৎ সৃষ্টি করতে পারবে। তৃতীয়টি, ‘শিক্ষাগত যোগ্যতা’, যা অর্জন করতে শিশুটিকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। শিক্ষা গ্রহণের জন্য শিশুটিকে ১০ বছর বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। এ সময়ের মধ্যে শিশুটিকে মূল্যায়ন করতে, শিক্ষকদের পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি অবলম্বন করলেই চলবে। শিক্ষার্থী নিয়মিত প্রতিষ্ঠানে আসছে কি-না, সে খেলাধুলায় অংশ নেয় কি-না, বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে পারছে কি-না, পড়ালেখা পারে কি-না, শিক্ষকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছে কি-না? অর্থাৎ একক এবং দলীয় কাজে শিশুটি কতটুকু স্মার্ট। এটুকু হলেই শিশু শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন যথাযথ।

তবে এই শিক্ষার্থীদের পাঠ্যসূচির সঙ্গে একটি মূল্যায়ন ডায়রি রাখতে হবে। যে ডায়রি প্রতিদিন অথবা সাপ্তাহিক মূল্যায়ন মার্কস শিক্ষক প্রদান করবেন। বছর শেষে নম্বর যোগ হয়ে শিক্ষার্থীর সার্বিক মূল্যায়ন মানদণ্ড নির্মিত হবে। শিশুশিক্ষায় সরকার যে পিইসি পরীক্ষা চালু করেছে তা যৌক্তিক। এতে শিক্ষাক্ষেত্রে যথেষ্ট শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। একসময় লেখাপড়া করুক আর না করুক, নাম লিখতে পারলেই পঞ্চম শ্রেণি পাস সার্টিফিকেট পাওয়া যেত। এখন তা আর সম্ভব নয়। এই পরীক্ষা আরো সহজ ও ভীতিমুক্ত করা গেলে শিশুশিক্ষার দ্বার উন্মোচিত হবে। এক্ষেত্রে সারা দেশের সব ধরনের অর্থাৎ কিন্ডারগার্টেন, ইংরেজি মাধ্যম কিংবা মাদরাসার শিশুশিক্ষার পদ্ধতি এবং মূল্যায়ন দণ্ড একীভূত প্রক্রিয়া করায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিশ্চিত করাটাই যৌক্তিক। প্রাথমিক স্তর পার হওয়ার পর মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় ধারাবাহিকতা বজায় রাখাও জরুরি। এক্ষেত্রে পাঠ্যসূচির সঙ্গে ফরমাল শিক্ষা সমান্তরাল করায় গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমান সরকার কোয়ালিটি এডুকেশন নিশ্চিত করতে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

কোয়ালিটি এডুকেশনকে গ্রহণ করতে একজন শিক্ষার্থীকে পারিপার্শ্বিক এবং আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের সম্মুখীন হতে  হয়। এক্ষেত্রে ফরমাল শিক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করার প্রয়োজনীয়তাও আবশ্যিক। বিষয়টি নিয়ে সেমিনার, আলোচনা ও পর্যালোচনা হতে পারে। তবে প্রধানমন্ত্রী যেহেতু শিশুশিক্ষায় গবেষণালব্ধ, উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষাদান পদ্ধতি চালু করতে চাচ্ছেন, তাতে করে শিক্ষার মূল্যায়নের মানদণ্ড আন্তর্জাতিক মানের হওয়াই উচিত। এক্ষেত্রে জিপিএ পদ্ধতি বিলুপ্ত করে জাপানের পদ্ধতি গ্রহণ করা যায় কি-না, ভেবে দেখতে হবে। জাপানের মূল্যায়নের মানদণ্ডের মধ্যে বীপবষষবহঃ   (চমৎকার), মড়ড়ফ (ভালো), হববফ সড়ৎব রসঢ়ৎড়াবসবহঃ (আরো অধিক উন্নতি)-এর প্রয়োজন।

বর্তমানে সৃজনশীল পদ্ধতির যে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে তা অত্যন্ত ভালো। তবে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এই পদ্ধতি না থাকাটাই যুক্তিযুক্ত। যে ছেলেটি ষষ্ঠ, সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণিতে সৃজনশীল পদ্ধতি পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ-৫ অথবা ৪, ৩ পেয়েছে, সেই ছেলেটি তার প্রতিষ্ঠানের ওপর একটি রচনা লেখতে অক্ষম। কারণ কী? যে বয়সে যা শেখানো দরকার, তা শেখাতে আমরা যেমন ব্যর্থ, তেমনি কোন শিক্ষায় কী পদ্ধতি হওয়া চালু করা উচিত, তা নির্ণয় করতেও আমরা অযোগ্য।

পৃথিবীর সব উন্নত দেশে শিক্ষায় সর্বোচ্চ বিনিয়োগ ও বিশেষ দৃষ্টিতে সরকার বদ্ধপরিকর। আমাদের বর্তমান সরকারপ্রধান যথেষ্ট আন্তরিক এই বলে যে, দেশের শিক্ষার মান উন্নত এবং জনমানুষকে জনশক্তিতে রূপান্তর করতে বদ্ধপরিকর। দুঃখজনক, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীরা শুধু প্রাইভেট কোচিংয়ের বিরুদ্ধে হুশিয়ারি উচ্চারণ ছাড়া শিক্ষার সার্বিক উন্নয়নে কোনো গবেষণালব্ধ প্রস্তাবনা প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করতে পারেননি। দেশের জনশক্তিকে জনসম্পদে পরিণত করতে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অতিদ্রুত জাতীয়করণ করা দরকার। এতে করে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় রোধ এবং জবাবদিহিতা শতভাগ নিশ্চিত হবে। একই সঙ্গে গতানুগতিক শিক্ষা নয়, উন্নত বিশ্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ জনসম্পদ তৈরির শিক্ষাদান পদ্ধতি চালু করার প্রয়োজনীয়তা এখন সময়ের দাবি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই সুশিক্ষিত জাতি ও জনসম্পদ সৃষ্টিতে শিক্ষা খাতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ চালু করে গেছেন। এক সময়কার মুষ্টির চালে পরিচালিত মাদরাসা শিক্ষকদের সর্বপ্রথম মাসিক পাঁচ টাকা হারে বেতনভাতা চালু করেন, বর্তমানে ওই শিক্ষকরা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জীবনযাত্রা অতিবাহিত করার মতো বেতনভাতা পাচ্ছেন।

বঙ্গবন্ধু একযোগে ৩৬ হাজার প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করেছিলেন। এরপর কোনো সরকারই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের মতো মহৎ কাজে এগিয়ে আসতে পারেননি, যা করতে পেরেছেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে লালিত শেখ হাসিনা ও তার সরকার। যে সরকার একযোগে ২৬ হাজার প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করে। সাবেক শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খান এক শিক্ষক সমাবেশে বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করতে আগ্রহী। তিনি জানতে চেয়েছেন, সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হলে কী পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন? প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহ আর আলোর মুখ দেখেনি। অর্থাৎ সংশ্লিষ্টরা তা আর প্রধানমন্ত্রীর ধারে-কাছেও পৌঁছাতে পারেননি। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বর্তমান সরকার শতভাগ সম্মানী ভাতা প্রদান করছে। শুধু মেডিকেল, আবাসিক এবং উৎসব ভাতায় বৈষম্য বিরাজ করছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়-সম্পত্তি, আয়-রোজগার রাষ্ট্রীয় খাতে নিয়ে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হলে যেমন শিক্ষাক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে, তেমনি শিক্ষাক্ষেত্রে জাতির পিতার চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন ঘটবে।

 

লেখক : সাংবাদিক ও শিশু সংগঠক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads