• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
চিন্তার পৃথিবীকে সমৃদ্ধ করতে পারে বই

ফাইল ছবি

মতামত

চিন্তার পৃথিবীকে সমৃদ্ধ করতে পারে বই

  • ফয়জুন্নেসা মণি
  • প্রকাশিত ০১ মে ২০১৯

মানবসভ্যতার সূচনা থেকেই মানুষের পাঠাভ্যাসের তথ্য পাওয়া যায়। মানুষ বই পড়ে মনের খোরাকের জন্য, অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য এবং নিজেকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করার জন্য। তাই ছোটবেলা থেকেই শিশুকে বেশি করে বই পড়তে উৎসাহিত করা দরকার। শিশু ছোট থেকে বই পড়লে তার জ্ঞান অর্জনের স্পৃহা বাড়বে, নতুন কিছু জানতে ও শিখতে চাইবে। আর বই পড়েই সে তার জ্ঞানের ক্ষুধা খুব সহজেই মেটাতে পারে। তাই আগ্রহ মেটাতে বই আর পড়াশোনার কোনো বিকল্প নেই। বই পড়ে একজন মানুষ তার চিন্তার পৃথিবীকে অনেক সমৃদ্ধ করতে পারে। শিশুর হাতে বই তুলে দেওয়ার প্রকৃত বয়স কত বলতে পারেন। অনেকেই বুঝতে পারা বয়সের কথাই বলবেন। কিন্তু শিশুর হাতে তখনই বই তুলে দিতে হয় যখন শিশু বই ছিঁড়তে শেখে। আপনারা সন্তানের হাতে বই তুলে দিন, যেভাবে সন্তানের হাতে খেলনা তুলে দিয়ে থাকেন। কারণ শিশুর মন কাদামাটির মতো। ছোট থেকে বই পড়লে তার মনের ঘরে অন্ধকার সহজে প্রবেশ করতে পারবে না। শিশুর হাতে এক বছরের পর থেকেই বই তুলে দিন। একটি শিশুর সঠিক বিকাশে পরিবারের পর বই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সময়টা শিশু অল্প অল্প করে সবকিছু জানতে ও বুঝতে শিখে। ফুল, পাখি, প্রাণীর বই এই বয়সের জন্য প্রযোজ্য। এই বয়স থেকে বই নাড়াচাড়া করতে করতে সে চারপাশের জগৎ সম্পর্কে ধারণা পাবে। যেসব শিশু ছোট থেকেই বই পড়ে বা বইয়ের থেকে গল্প পড়ে শোনানো হয় তাদের কল্পনাশক্তি তার বয়সী অন্য শিশু থেকে বেশি হয়, যারা বই পড়ে না।

আমরা জানি জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রদূত বলা হয় গ্রিকদের। গ্রিসের থিবসের লাইব্রেরির দরজায় খোদাই করে লেখা আছে, ‘আত্মার ওষুধ’। অর্থাৎ তাদের বিশ্বাস বই হলো আত্মার চিকিৎসার প্রধান উপকরণ। বইয়ের প্রতি ভালোবাসা থাকলে পড়াশোনায় আগ্রহ জন্মায় খুব সহজে। পড়াশোনা মানেই অনেকের শুধু প্রতিষ্ঠান স্কুল, কলেজের পড়া, তা সঠিক নয়। শিশু বড় হওয়ার আগেই তাকে তার সত্যিকারের বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিন। চায়নাদের বিশ্বাস- বই হলো এমন একটা বাগান, যা পকেটে নিয়ে ঘোরা যায়। কারণ মানুষের সবচেয়ে আপন বন্ধু হচ্ছে বই। বই পড়ার সঙ্গে জ্ঞানের সম্পর্ক অপরিসীম। বই পড়লে মানুষের জ্ঞানের দ্যুতি বাড়ে। আমাদের জীবসত্তা জাগ্রত থাকলেও মানবসত্তা জাগ্রত করার সিঁড়ি হচ্ছে বই। শিশু বড় হওয়ার সময় মা-বাবারা সব সময় চিন্তিত থাকে। শিশু কার সঙ্গে মিশছে, বন্ধু থেকে খারাপ কিছু শিখছে না তো, বন্ধুটা কি আসলেই ওর জন্য ভালো এমন চিন্তা মা-বাবার আসবেই। বর্তমান সময়ে যেসব রোগে নতুন প্রজন্ম বেশি মাত্রায় ভুগছে, তার বেশিরভাগের সঙ্গেই মানসিক চাপের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। অপরপক্ষে বই পড়ার অভ্যাস এমন সমস্যা কমাতে সাহায্য করে। কারণ বই পড়ার সময় মন খুব শান্ত থাকে। সেই সঙ্গে হার্টের রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক প্রভৃতি রোগে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ও কমতে থাকে।

সন্তানরা একদম বই পড়তে চায় না- অধিকাংশ মায়েদের অতি পরিচিত আক্ষেপ। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় সেসব মা-বাবা নিজেরাই বই পড়ে না। বই কিনে না। অভিভাবকরা শুরুতে সন্তানের মধ্যে বইয়ের প্রতি ভালবাসা তৈরির জন্য প্রচুর কিনে দিতে হবে। বিভিন্ন দিবস ও সফলতার পুরস্কার হিসেবে বই উপহার দিতে হবে। সন্তানের জন্য বই পড়ার অভ্যাস আগে আপনাকেই আয়ত্ত করতে হবে। গল্প পড়ে শোনানোর সময় চরিত্রের প্রয়োজনে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করুন। কখনো কণ্ঠস্বর মোটা করে, কখনো চিকন করে বাচ্চার সামনে গল্পের চরিত্রগুলো চিত্রায়িত করুন। পরবর্তীকালে নিজেই লক্ষ করবেন আপনার সন্তানের কাছে বই হয়ে গেছে আনন্দের অপর নাম। অনেকে আজকাল আর কাউকে বই উপহার দেয় না। অথচ বই হতে পারে সবচেয়ে নান্দনিক, অর্থবহ এবং জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ উপহার। প্রাতিষ্ঠানিক বইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বই পাঠের গুরুত্ব তুলে ধরে অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন, প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা করে আমরা মানুষ হব। আর প্রাতিষ্ঠানিক বইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বই পড়লে জ্ঞানের দু্যুতি বাড়বে এবং আমরা আলোকিত হব। সন্তানের যখন মাত্র বুলি ফুটছে তখন থেকেই তার হাতে বই দেওয়ার চেষ্টা করুন। আকর্ষণীয় ইলাস্ট্রেশনযুক্ত বই দেখিয়ে তার কল্পনার জগতের দরজা খুলে দিন এই বয়সেই।

বই মানুষের মনকে সুন্দর করে। মানুষের মনকে সুন্দর করার জন্য বই হলো সবচেয়ে ভালো উপহার। এমন ছোট্ট প্রচেষ্টা অনেক দিক দিয়ে সুফল বয়ে আনবে। কেননা জ্ঞানের সূচনা বই থেকেই এবং সে জ্ঞানকে সামগ্রিকভাবে কাজে লাগানোর দক্ষতা মানুষ বই পড়ে পেয়ে থাকে। মানুষের মননশীল, চিন্তাশীল, সৃষ্টিশীল চিন্তার যাবতীয় সূচনার বিস্ফোরণ একমাত্র বইয়ের মাধ্যমে হতে পারে। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বই পড়ার প্রতি এত বেশি আসক্ত ছিলেন যে, লাইব্রেরি কক্ষে কর্মচারীরা তার নিবিষ্ট পাঠক মনের উপস্থিতি পর্যন্ত টের পেত না। তাই বহুবার তিনি লাইব্রেরি কক্ষে তালাবন্দি হয়েছেন। কিন্তু আমরা বাবা-মায়েরা সন্তানদের সহজে বই কিনে দিতে চাই না। মনে করি এই টাকাটাই বুঝি গচ্চা গেল। অথচ এই বাবা-ময়েরাই পরিশীলিত ও মানবীয় সুসন্তান প্রত্যাশা করি। কিন্তু আমরা আগে ভাবি না যে- সন্তানের মানবীয় বিকাশে বইয়ের গুরুত্ব ও অবদান সবচেয়ে বেশি। আমরা এই বাবা-মায়েরাই নির্দ্বিধায় চায়নিজ রেস্টুরেন্টে বা অভিজাত হোটেলে বসে এক-দুই হাজার টাকা অবলীলায় খরচ করতে কাপর্ণ্য করি না। অথচ বইমেলায় বই কেনার জন্য দুই হাজার টাকার বাজেট থাকে না। এভাবে মানুষ দিন দিন বই পড়া থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে শিশুদের। অথচ বই হচ্ছে মানুষের বিনোদনের অন্যতম বড় উৎস। নেপোলিয়ন বলেছেন, ‘অন্তত ষাট হাজার বই সঙ্গে না থাকলে জীবন অচল।’ বই পড়লে আমাদের মস্তিষ্ক চিন্তা করার খোরাক পায়, সৃজনশীলতা বাড়ে এবং তথ্য ধরে রাখার ক্ষমতা সৃষ্টি হয়। বিজ্ঞান মতে, মন ও মস্তিষ্কের ক্লান্তি দূর করতে টেলিভেশনের পরিবর্তে বইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করুন। কারণ বই পড়লে শরীরের উপকার হয়, টিভি দেখলে নয়।

 

লেখক : কবি ও শিক্ষিকা

 

 

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads