• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

ভাঙনের শব্দ শুনি

  • মহিউদ্দিন খান মোহন
  • প্রকাশিত ১৮ মে ২০১৯

রাজনৈতিক অঙ্গনে ভাঙা-গড়ার খেলা নতুন কিছু নয়। নানা কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি হতে পারে। প্রথমে কোনো বিষয়ে মতানৈক্য, তারপর বিভক্তি এবং সর্বশেষ তা রূপ নিয়ে থাকে ভাঙনে। এ ভাঙন কখনো হয় আদর্শিক দ্বন্দ্বে, আবার কখনো নেতৃত্বের  কোন্দল বা ব্যক্তিস্বার্থের কারণে। সব ভাঙনই নতুন কিছু সৃষ্টি করে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভাঙনে নতুন দলের জন্ম হয়। কখনো পুরনো নামে ব্র্যাকেট লাগিয়ে, আবার কখনো পূর্বতন দল থেকে বেরিয়ে একেবারে নতুন রাজনৈতিক দলেরও আবির্ভাব ঘটে। রাজনৈতিক দলের এই বিভাজন বহুকাল আগে থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলে আসছে। আমাদের এ উপমহাদেশে রাজনৈতিক দলের ভাঙনের ইতিহাস পুরনো হলেও বাংলাদেশে মাঝে মধ্যেই এর প্রাদুর্ভাব ঘটে। ইতিহাস বলে, সে সময় বিভক্তি এসেছে কেবলই আদর্শগত বিষয়কে কেন্দ্র করে। অবিভক্ত ভারতের প্রথম রাজনৈতিক দল কংগ্রেস। একসময় পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহসহ অনেক মুসলিম রাজনীতিক কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। কিন্তু জাতিগত ও আদর্শিক দ্বন্দ্বে তারা কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে মুসলিম লীগের গোড়াপত্তন করেন। সেই মুসলিম লীগও পরবর্তীকালে ভেঙেছে। পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খানের পৃষ্ঠপোষকতায় পৃথক মুসলিম লীগ গঠিত হয়; যেটি কনভেনশন মুসলিম লীগ নামে সমধিক পরিচিত। স্বাধীন পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র দুই বছরের মাথায় ১৯৪৯ সালে জন্ম হয় আওয়ামী মুসলিম লীগের; পরবর্তী সময়ে যেটি আওয়ামী লীগ নাম ধারণ করে। এই আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের বেশিরভাগই একসময় মুসলিম লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। সেই আওয়ামী লীগও জন্মের মাত্র আট বছরের মাথায় প্রথম ভাঙনের কবলে পড়ে। আন্তর্জাতিক যুদ্ধজোট সিয়াটো-সেন্টোতে পাকিস্তানের যোগদান বিষয়ক পররাষ্ট্রনীতি প্রশ্নে সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী দ্বন্দ্বের ফলে আওয়ামী লীগে ভাঙন অনিবার্য হয়ে ওঠে। জন্ম নেয় মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ। সেই ন্যাপও পরবর্তীকালে বহুবার ভাঙনের শিকার হয়েছে। ন্যাপ থেকে জন্ম নিয়েছে মোজাফফর ন্যাপ, ড. আলীম আল রাজীর পিপলস লীগ, কাজী জাফর আহমদের ইউনাইটেড পিপলস পার্টি-ইউপিপি, রাশেদ খান মেননের ওয়ার্কার্স পার্টি ইত্যাদি। স্বাধীন বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রথম ভাঙনের মুখে পড়ে ১৯৭২ সালে ছাত্রলীগের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে। আ স ম আবদুর রব ও শাজাহান সিরাজের নেতৃত্বাধীন গ্রুপ সম্মেলন করে পল্টন ময়দানে, আর নূরে আলম সিদ্দিকী ও আবদুল কুদ্দুস মাখনের নেতৃত্বে অপর গ্রুপটি সম্মেলন করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ছাত্রলীগের এ বিভক্তির মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের উদর থেকে নতুন আরেকটি রাজনৈতিক দলের জন্মের সূত্রপাত ঘটে। ১৯৭৩ সালে জন্ম নেয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। সেই জাসদও পরবর্তীকালে বহুধা বিভক্ত হয়েছে। জাসদ থেকে বাসদ, আবার ব্রাকেটবন্দি একাধিক বাসদ, জাসদ থেকে জেএসডি ইত্যাদি নামে এখন অনেক দল। সত্তরের দশকের শেষের দিকে আওয়ামী লীগ বিভক্ত হয়। মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে পৃথক আওয়ামী লীগ গড়ে তোলেন কিছু নেতা। এদের অনেকেই (মিজান চৌধুরীসহ) পরে যোগ দিয়েছিলেন এরশাদের দলে। আশির দশকে আওয়ামী লীগ আরেকবার ভাঙনের কবলে পড়ে। মহিউদ্দিন আহমেদ ও আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ থেকে একটি গ্রুপ বেরিয়ে গঠন করে বাকশাল। অবশ্য কয়েক বছর পর তারা বাকশাল বিলুপ্ত করে পুনরায় আওয়ামী লীগে ফিরে যান। ১৯৯২ সালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে আরেকটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী ভাঙন সম্পন্ন হয়। গঠিত হয় গণফোরাম।

১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান গঠন করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। তার জীবদ্দশায় দলটি বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ওই দলে সম্পৃক্ত হন দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর দলটি প্রথম ভাঙনের কবলে পড়ে ১৯৮৪ সালে। শামসুল হুদা চৌধুরী, ডা. এম এ মতিন ও রিয়াজউদ্দিন আহমদ ভোলা মিয়ার নেতৃত্বে আলাদা বিএনপি গঠিত হয়। তার পরের ইতিহাস আরো চমকপ্রদ। এরশাদের ‘হর্স ট্রেডিং’ নীতির আওতায় বিএনপির অনেক ডাকসাইটে নেতা দল বদল করেন। দল থেকে বেরিয়ে মহাসচিব কে এম ওবায়দুর রহমান গঠন করেন জনতা দল। অবশ্য পরে তিনি ফিরে এসেছিলেন বিএনপিতে। অন্য দল থেকে নেতা ভাগিয়ে নিয়ে বা দল বিলুপ্ত করিয়ে জাতীয় পার্টি গড়ে তুলেছিলেন এরশাদ। তার দলও রক্ষা পায়নি ভাঙন থেকে। সেই দলের টুকরোগুলো এখন জেপি, বিজেপি ইত্যাদি নামে ভেসে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতির সাগরে।

আমাদের দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে রাজনৈতিক দলে ভাঙন বিস্ময়কর কোনো ব্যাপার অবশ্য নয়। নানা কারণে ভেঙেছে দল। আদর্শিক দ্বন্দ্ব, নেতৃত্বের সংঘাত, স্বার্থের হাতছানি এমনকি পরকীয়াজনিত কারণেও দল ভেঙে যাবার নজির আছে। এই দল ভাঙাভাঙি নিয়ে মজাদার এক মন্তব্য করেছিলেন রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হয়ে দেশজোড়া খ্যাতি অর্জনকারী সিলেটের ছয়ফুর রহমান, যিনি ছক্কা ছয়ফুর নামেই সুপরিচিত। সিলেট সদর উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। তার সে বিজয়কে সবাই ‘ছক্কা’ মারা বলে অভিহিত করেন। সেই থেকে তার নামের সঙ্গে ছক্কা শব্দটি উপাধির মতো বসে যায়। সেই ছয়ফুর রহমান একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন সম্ভবত ইসলামিক রিপাবলিকান পার্টি নামে, যার একমাত্র সদস্য ও চেয়ারম্যান তিনি। কেন এমন দল গঠন- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, দুজন মিলে করলেও দল দুই ভাগ হয়ে যেতে পারে। তাই একাই দল করেছি। ভাগ হওয়ার দুশ্চিন্তা নেই। ছক্কা ছয়ফুরের সে কথার প্রতিফলন কিন্তু এন্তার ঘটছে আমাদের দেশে। এমন অনেক উদাহরণ আছে, দলগুলো ভাঙতে ভাঙতে এক পর্যায়ে সিকি আধুলিতে পরিণত হয়। এই যে আমাদের দেশে এখন বিয়াল্লিশটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, এগুলোর বেশিরভাগই ভাঙন থেকে সৃষ্ট। এ যেন ‘নদীর একূল ভাঙে ওকূল গড়ে এই তো নদীর খেলা’।

অতিসম্প্রতি দেশের বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও জোটে বেজে উঠেছে ভাঙনের সুর। বিশেষত একাদশ জাতীয় সংসদে যোগদান প্রশ্নে এ ভাঙন যেন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। এসব দল ও জোটে ভাঙন সৃষ্টির খবর গণমাধ্যমে বেশ গুরুত্বসহ প্রকাশ হয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিতে ভাঙন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল নির্বাচিত ছয় এমপির শপথকে কেন্দ্র করে। তবে শেষ পর্যন্ত ‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কর্তৃক শপথের অনুমতি’র কথা বলে সে ভাঙন আপাতত রোধ করা গেছে। কেননা দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে তারা সংসদে গেলে যদি তাদের বহিষ্কার করা হতো, তাহলে ওই পাঁচজন মিলে নতুন আরেকটি ব্রাকেটবন্দি বিএনপির জন্ম দিয়ে ফেলা বিচিত্র কিছু ছিল না।

এদিকে ভাঙনের সুর ক্রমেই তীব্র হতে শুরু করেছে ২০ দলীয় ঐক্যজোটে। গত ৬ মে জোটের অন্যতম শরিক ও সোচ্চার কণ্ঠ বিজেপি নেতা ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তার এ ঘোষণার পর গুঞ্জন উঠেছে আরো অনেক দলই তার পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারে। ব্যারিস্টার পার্থ জোট ত্যাগের কারণ হিসেবে বিএনপি কর্তৃক শরিকদের অবমূল্যায়ন, জোটকে না জানিয়ে এমপিদের শপথ, দীর্ঘ পাঁচ মাস জোটের সঙ্গে কোনো বৈঠক না করা, ঐক্যফ্রন্টকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া ইত্যাদি কথা বলেছেন। জানা গেছে, ২০ দলীয় জোটের অনেক শরিকই এসব বিষয়ে ক্ষুব্ধ প্রধান শরিক বিএনপির ওপর। লেবার পার্টি নামের সাইনবোর্ডসর্বস্ব একটি দলও হুমকি দিয়েছে জোট ত্যাগের। এ বিষয়ে গত ৮ মে সমকালের রিপোর্টে ২০ দলীয় জোটে চরম অস্থিরতা বিরাজ করার কথা তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষত শরিকদের না জানিয়ে নির্বাচিতদের শপথের অনুমতি দেওয়ায় তারা চরম ক্ষুব্ধ বিএনপির ওপর। তাছাড়া জোটকে অবজ্ঞা করে ঐক্যফ্রন্টকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিএনপি শরিকদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। এর ফলে ২০ দলীয় জোটে অচিরেই বড় ধরনের বিভক্তি দেখা দিতে পারে বলে রাজনৈতিকসচেতন ব্যক্তিরা মনে করছেন। অপরদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টও পুড়ছে গৃহদাহে। ইতোমধ্যে ঐক্যফ্রন্ট ছাড়ার আল্টিমেটাম দিয়েছেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি আবদুল কাদের সিদ্দিকী। গত ৯ মে এক সংবাদ সম্মেলনে আগামী এক মাসের মধ্যে ফ্রন্টের সাত সংসদ সদস্যের শপথের ব্যাখ্যা না পেলে তার দল জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন তিনি। শেষ পর্যন্ত কাদের সিদ্দিকী কী করবেন তা এখনই বলা মুশকিল। অস্থির মতির লোক হিসেবে খ্যাত এই নেতার সিদ্ধান্তের শেষ পরিণতি দেখার জন্য আরো অপেক্ষা করতে হবে। অস্থিরতা চলছে গণফোরামেও। নতুন কমিটি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে দলটির অভ্যন্তরে অসন্তোষের আগুন ধূমায়িত হয়ে উঠেছে। একটি অংশ সংবাদ সম্মেলন করে দল ত্যাগ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে ইতোমধ্যেই সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। অন্যদিকে জাতীয় পার্টিতেও চলছে অসন্তোষ। এরশাদের পরে কে দলের নেতা হবেন, এ ইস্যুতে দলটি দ্বিধাবিভক্ত। যদিও ভাই জিএম কাদেরকে উত্তরসূরি ঘোষণা করে পরিস্থিতি সামাল দিতে চেষ্টা করছেন এরশাদ। তবে দলটি যে কোনো সময় বড় ধরনের ভাঙনের কবলে পতিত হতে পারে বলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন।

আগেই বলেছি রাজনৈতিক দলে ভাঙন বিচিত্র কিছু নয়। তবে অতীতে ভাঙন-বিভক্তি হতো প্রধানত নীতি-আদর্শ, জাতীয় স্বার্থে অবস্থান ইত্যাদি প্রশ্নে। কিন্তু এখন ভাঙন ধরে নেতাদের স্বার্থগত দ্বন্দ্বের কারণে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় নেতারা দলের মধ্যে যে কোটারি সৃষ্টি করেন, তার অবশ্যম্ভাবী ফল দাঁড়ায় দল বা জোটে ভাঙন। এসব ভাঙনের পেছনে ক্ষমতাসীন সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ একটি ভূমিকা সবসময়ই থাকে। নিজেদের অধিকতর নিরাপদ ও প্রতিবন্ধকতাহীন করার উদ্দেশ্যে বিরোধী দল ও জোটে ভাঙন সৃষ্টি সরকারের কৌশলেরই অংশ। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দল ও জোটে ভাঙনের যে শব্দ শোনা যাচ্ছে, তার পেছনে সরকারের কোনো ভূমিকা আছে কি-না বলা মুশকিল। তবে বিরোধী শিবিরে এসব দ্বন্দ্ব-অসন্তোষ ও বিভক্তি যে ক্ষমতাসীনদের জন্য স্বস্তিদায়ক ব্যাপার, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

 

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads