• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
কৃষক কৃষি ও প্রান্তজনের কথা

ফাইল ছবি

মতামত

কৃষক কৃষি ও প্রান্তজনের কথা

  • রহিম আবদুর রহিম
  • প্রকাশিত ২৯ মে ২০১৯

২১ মে রাত দশটার ঘটনা। জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে দিয়ে হাঁটছি ফার্মগেটের দিকে। এক যুবক ধীরগতিতে বাইক চালিয়ে সামনে এগিয়ে এলো। জিজ্ঞেস করলাম ‘উবার’? উত্তরে হ্যাঁ। গন্তব্য জানালাম, রাজি হলো। হ্যালমেড পরিয়ে দিল। যাত্রা শুরু, জ্যামের শহর ঢাকার রাস্তা ফাঁকা। আলাপচারিতায় একপর্যায়ে জানতে পারলাম ‘উবার’ চালক যুবকটি ঢাকা শ্যামলী আইডিয়াল পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের টেক্সটাইল ট্রেডের সিক্স সেমিস্টারের ছাত্র। ওর নাম শফিকুল ইসলাম সবুজ। গ্রামের বাড়ি শেরপুর জেলার নলিতাবাড়ী উপজেলার রামচন্দ্রকোরা ইউনিয়নে। বাবা জুলহাস উদ্দিন একজন প্রান্তিক কৃষক, মা রাশিদা বেগম গৃহিণী। বাবা-মার চার সন্তানের মধ্যে সবুজ সবার ছোট। এক ভাই, দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। প্রান্তিক কৃষক সবুজের বাবার সম্পত্তি যা রয়েছে, তা দিয়েই তাদের সংসার চলার পর সবুজের লেখাপড়া হওয়ার কথা। জাত কৃষক সবুজের বাবার দশ বিঘা সম্পত্তি থাকার পরও তাদের সংসার চলে না। কারণ কৃষিপণ্যের চড়া দাম, উৎপাদিত পণ্যের মূল্য নেই, সবুজের আর পড়াশোনা হচ্ছে না। কৃষক বাবা জমিজমা বর্গা দিয়েছেন। বর্গাচাষি নিয়ম অনুযায়ী ফসলের ভাগ দিতেও পারছে না। আবাদ শেষে যা দিচ্ছে, তা দিয়ে বাবা-মা কোনোমতে খেয়েপরে কোনো রকম বেঁচে আছেন। সবুজ, তার বাবা-মার কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা নিয়েছে এবং সে নিজেই আরো ৯০ হাজার টাকা ধারদেনা করে একটি বাইক কিনেছে, যা দিয়ে ‘উবার’ সার্ভিস চালাচ্ছে। ওর স্বপ্ন, বর্গাচাষি মৌসুম শেষে যা দেবে তা দিয়ে সংসার চলবে। আর সে নিজে প্রতিদিন ‘উবার’ চালিয়ে ওর যা ইনকাম হবে তা দিয়ে ঢাকায় থাকা-খাওয়াসহ প্রতিষ্ঠানের ব্যয়ভার বহন করবে। পাশাপাশি কিস্তিতে ৯০ হাজার টাকা ঋণ পরিশোধ করবে। তার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেছে। বর্গাচাষি মৌসুম শেষে ফসলের ভাগ দেবে তো দূরের কথা, নানা যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে তাকে বর্গাজমি ফেরত নেওয়ার অনুরোধ করায় সবুজ নিরুপায়। ফলে সবুজের ‘উবার’ ইনকামের টাকা বাবা-মার ব্যয়ভারের জন্য পাঠাতে হচ্ছে। যে কারণে যুবক সবুজ ঋণের দায়ে জর্জরিত, তার তারুণ্যে হরদম হতাশা বিরাজ করছে। জীবনযোদ্ধা সবুজের এই কাহিনী কৃষিপ্রধান দেশের জন্য দুঃখজনক হলেও সবুজের প্রচেষ্টা, সাহস, উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয় এবং তরুণ সমাজের জন্য অনুকরণীয়।  

প্রান্তিক কৃষক জুলহাস তার আবাদি জমি বর্গা দিয়ে বাঁচতে চাইলেও জীবনযোদ্ধা সবুজের হতাশা কে দূর করবে? কৃষিপ্রধান এই ভূখণ্ডে প্রাচীনকালে ৮৫ শতাংশ মানুষ কৃষক ছিলেন। সুখী সমৃদ্ধ কৃষক জীবনের গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু, পুকুরভরা মাছ এগুলো কাব্যসাহিত্যের কোনো কাল্পনিক কাহিনী নয়, যা দৃঢ় সত্য ও বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। সুখী সমৃদ্ধ তৎকালীন কৃষকদের ওপর পর্যায়ক্রমে এসেছিল বর্গীদের অত্যাচার, ফিরিঙ্গি-পর্তুগিজ, জলদস্যুদের নির্যাতন, ইংরেজদের খাজনা আদায়ের সূর্যাস্ত আইন, শোষণ ও নিপীড়ন। এসেছিল মন্বন্তর-মহামারী। উজাড় হয়েছিল গ্রামবাংলা, নিঃস্ব হয়ে পড়ে কৃষককুল। এক সময়কার কৃষকরা পরিণত হয়েছে ভূমিহীন চাষিতে। দারিদ্র্যই যাদের কোণঠাসা করে।  

বাংলাদেশের কৃষক ও কৃষি সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন সম্প্রতি অষ্টম শ্রেণির দুজন শিক্ষার্থীকে লিখতে বলা হয়। ওরা দুজনই অত্যন্ত সুন্দর ভাষায় প্রতিবেদন দুটি লেখে। একজন ছাত্র তার প্রতিবেদনে বর্ণনা করেছে, ‘ব্যক্তিগতভাবে চেষ্টা করে কৃষকরা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারবে না। কৃষকদের উন্নতি করতে হলে দেশের সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের কৃষি উৎপাদন বাড়াতে হলে এবং কৃষকদের উন্নতি করতে হলে যেসব ব্যবস্থা অবলম্বন করা প্রয়োজন, এর মধ্যে নিরক্ষর কৃষকদের মাঝে কৃষিশিক্ষার বিস্তার, কৃষক সমবায় সমিতি গড়ে তোলা, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা ও সেগুলোর ব্যবহার সম্পর্কে কৃষকদের জ্ঞানদান করা, উন্নত মানের কীটনাশক ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ সরবরাহ করা, কৃষিকাজের জন্য কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণদান করা এবং কৃষিপণ্যের ন্যায্য দামের নিশ্চয়তা প্রদান করা।’ অন্য ছাত্রটি তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, ‘বাংলার কৃষকরা বাঙালি জাতির মেরুদণ্ড। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি। এরপরও কৃষকরা বহুকাল ধরে অবহেলিত। বিশেষ করে, তাদের সামাজিক মর্যাদা এখনো নিম্নমানের। যেদিন আমাদের দেশের সরকার কৃষক ও কৃষিকে সবার আগে গুরুত্ব দেবে, সেদিনই অর্থনীতির সচল চাকা সবল হবে। ঘরে ঘরে ফুটে উঠবে স্বাচ্ছন্দ্যের ছবি। বলা যায়, কৃষিমাঠে কৃষকের আত্মার ভেতর লুকিয়ে আছে আমাদেরই সমৃদ্ধির প্রাচুর্যের বীজ।’ মাধুর্যমিশ্রিত ভাষায় বর্ণিত এই প্রতিবেদনগুলো একজন শিশু শিক্ষার্থীর পরীক্ষায় ভালো নাম্বার পাওয়ার রসদ হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা কঠিন। লেখাটি প্রস্তুত করার আগে ৩০ জন প্রান্তিক কৃষকের সঙ্গে এক ঘণ্টা আলোচনা হয়েছে। রাগ-অভিমান প্রকাশ পেয়েছে। রাষ্ট্রসংশ্লিষ্টদের সমালোচনা কম হয়নি, প্রধানমন্ত্রীর প্রতি নিবেদন আবেদন ও ক্ষোভের কথা তারা বলার চেষ্টা করেছেন। প্রান্তিক চাষিদের আলোচনায় উঠে এসেছে কৃষকদের দুরবস্থার ভয়ঙ্কর চিত্র। ৫২ শতাংশ জমি নিয়ে গঠিত এক বিঘা জমির প্রারম্ভিক চাষ থেকে শুরু করে ফসল ঘরে তোলা পর্যন্ত তিন পর্যায়ে একজন কৃষক খরচ শেষে যা গোলায় তোলেন তা হতাশাজনক। প্রথম ধাপে জমি প্রস্তুত। বীজতলা ১২শ টাকা, হালচাষ তিনটি- প্রতি চাষ ৪০০ টাকা হারে ১২শ টাকা, জমিতে মই মারা একটি ৫০০ টাকা। দ্বিতীয় ধাপে রোপণ বাবদ ৩ হাজার টাকা, সেচ প্রতি বিঘা ৩ হাজার টাকা, কীটনাশক ও পরিচর্যা বাবদ ১৫শ টাকা। শেষ পর্যায়ে মাড়াই করার জন্য শ্রমিক ৬ জন ৮০০ টাকা হারে ৪৮শ টাকা, কৃষিমাঠ থেকে ফসল ঘরে আনা বাবদ ৮০০ টাকা, সর্বমোট এক বিঘায় প্রতি একজন প্রান্তিক কৃষকের মোট খরচ ২১ হাজার ৫০০ টাকা। আর ওই এক বিঘায় উৎপাদিত ফসল এলো ৩০ মণ, প্রতি মণ ফসলের দাম ৫৫০ টাকা হারে তার আয়ের ঘরে আসে ১৬ হাজার ৫০০ টাকা। অর্থাৎ উৎপাদন খরচ ২১ হাজার ৫০০ টাকা হওয়ায় কৃষকের প্রতি বিঘায় লোকসান গুনতে হচ্ছে ৫ হাজার টাকা। পাঁচ বিঘা সম্পত্তির একজন প্রন্তিক চাষির লোকসান হচ্ছে মোট ২৫ হাজার টাকা। কবি রাজিয়া খাতুন চৌধুরাণী তার ‘চাষী’ কবিতায় তুলে এনেছেন, ‘সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা/দেশমাতার ঐ মুক্তিকামী দেশের সে যে আশা/ মুক্তিকামী মহাসাধক মুক্ত করে দেশ/সবারই সে অন্ন জোগায় নেইকো গর্ব লেশ।’ অথচ স্বাধীন দেশে সেই সাধকদের কী করুণ দশা!  

তবে আলোচনায় অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক কৃষকই যৌক্তিকভাবে বলেছেন, সারা দেশের আবহাওয়া, মাটি ও প্রকৃতির ধরন বিবেচনায় অঞ্চলভেদে কৃষকদের ফসল উৎপাদনে উৎসাহিত করা, কৃষি উপকরণের দাম কমিয়ে আনা, সুদবিহীন কৃষিঋণ প্রদানে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা দেওয়া সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। কৃষকদের দাবি মাত্র দুটি— এক. সরকার সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে কৃষি ফসল ক্রয় করবেন এবং দুই. বাংলাদেশে উৎপাদিত চাল, চিনি, পেঁয়াজ, রসুন কোনোভাবেই বিদেশ থেকে আমদানি করা যাবে না। তাদের যৌক্তিক দাবি, কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি কৃষি ফসল ক্রয় কীভাবে সম্ভব? জানতে চাইলে, তারা ফসল কেনার একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেন। তাদের প্রস্তাবিত কমিটি হবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী ও বিজিবি জওয়ানদের নিয়ে। যে কমিটিতে থাকবে প্রতি ইউনিয়নের প্রয়োজনীয় সংখ্যক সেনাসদস্য এবং ওই ইউনিয়নের প্রতিটি স্কুলের একজন করে শিক্ষক। একটি ইউনিয়নের জন্য ৯ জন প্রতিনিধি থাকবেন, যারা শুধু ক্রয় কমিটিকে কৃষকের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দেবেন। প্রান্তিক চাষির ১০ টাকার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের কার্ড দেখে বর্তমানে যে কৃষি ফসল কেনা হচ্ছে, তা বাতিল করে কৃষকদের কৃষিকার্ড প্রদানের প্রস্তাব করেছেন। তাদের যুক্তি, এই কার্ড একজন কৃষক কৃষিঋণ, কৃষিপণ্য ক্রয়-বিক্রয়সহ বিভিন্ন কৃষি সম্পৃক্ত কাজে ব্যবহার করবেন। এতে করে তাদের ভাষায়, ‘আতি-পাতি’ নেতা এবং দালালরা ফায়দা লুটতে পারবে না।  

প্রস্তাবের অন্যত্র তারা বলেছেন, বাংলাদেশে উৎপন্ন হয় এ ধরনের ফসল কোনোক্রমেই আমদানি করা যাবে না। তাদের এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলা হয়েছিল, এতে করে বিদেশিদের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্কের অবনতি ঘটতে পারে। এ ধরনের মন্তব্য করায় তারা বলেছেন, ‘আমাদের রক্তঘামে উৎপাদিত ফসলের আমরা মূল্য পাই না, ১২ টাকা কেজিতে ধান বিক্রি করে ৬০ টাকা কেজিতে চাল খেতে হয়, এরপরও বিদেশিদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হবে! সরকার তো আমাদের, বিদেশিদের নয়।’ কৃষকরা চিনি, পেঁয়াজ, রসুন আমদানি বন্ধের প্রস্তাব করে বলেন, এ ধরনের পণ্যে দ্বিগুণ করারোপ করা হলে বিদেশি পণ্যের দাম বেড়ে যাবে, ফলে গ্রাহকরা বিদেশি পণ্য না কিনে দেশি পণ্যের দিকে ঝুঁকবে। এতে করে কৃষক সমাজ রক্ষা পাবে। সর্বশেষ আলোচনায় কৃষকরা পাট ফসলের হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাওয়ার আকুতি জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে তাদের মতামত ও অভিব্যক্তি, ‘পাট ফসল উৎপাদনের আগে দেশের জুট মিলগুলোকে চাঙ্গা করা, পলিথিনমুক্ত দেশগঠনে গণজোয়ার সৃষ্টি করা এবং আইনি প্রক্রিয়া জোরদার করা সরকারের ফরজে আইন হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিরক্ষর অর্ধশিক্ষিত-অশিক্ষিত এই কৃষক আড্ডায় উপস্থিত কৃষকরা দুঃখ করে বলেছেন, ‘আমরা এতই খারাপ যে, আমাদের পাটকলগুলো বন্ধ, কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পায় না, চিনিকলে লাখ লাখ চিনি নষ্ট হয়ে যায়। অথচ বালিশ ইঞ্জিনিয়াররা অবাধে কোটিপতি হচ্ছেন। এক বালিশের দাম ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা, যা উঠাতে লেগেছে ৭৬০ টাকা।’  

বর্তমান সরকার সব ক্ষেত্রেই উন্নয়নের মহাসড়কে হাঁটছেন— এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে কেন, কোন দুর্বলতার গ্যাঁড়াকলে পড়ে দেশের প্রাণ ও অর্থনীতির মেরুদণ্ড কৃষকদের দুরবস্থা এবং পলিথিনমুক্ত দেশগঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারবেন না, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়।  আর দেরি নয়, ‘কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে’— এই স্লোগান বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি।  

 

লেখক : সাংবাদিক, নাট্যকার  

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads