• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
প্রকৃতির আরেকটি অভিশাপ বজ্রপাত

প্রতীকী ছবি

মতামত

প্রকৃতির আরেকটি অভিশাপ বজ্রপাত

  • বিশ্বজিত রায়
  • প্রকাশিত ২৯ মে ২০১৯

চলছে গ্রীষ্মকাল। কালবৈশাখী বজ্রপাতের মোক্ষম সময়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে বজ্রপাত একটি ভয়াবহ ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাওর তথা গ্রামাঞ্চলের মানুষ এর রোষানলে পড়ে প্রতিনিয়ত জীবন হারাচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক এই বজ্রহানা কাউকে বলে-কয়ে আসে না। এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত সময়টায় বজ্রপাতের আধিক্য লক্ষ করা যায়। বছরের অন্য কোনো সময় এর তীব্রতা তেমন লক্ষণীয় না হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে মাঝে মাঝে যেকোনো সময় এই বজ্রপাত মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। কালবৈশাখীর সাথে ধেয়ে আসা বজ্র প্রকম্পিত বিজলি গর্জন ও তার সাথে মাটিতে পতিত বজ্রগোলা ধ্বংস করে দেয় জীবন। হাওর পাড়ের মানুষ এ সময় মাঠে-ঘাটে কৃষিকাজে ব্যস্ত থাকায় প্রায় সময়ই বজ্রপাতে পতিত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর কবল থেকে মুক্ত হতে পারছে না গ্রামীণ জীবন। এখানকার মানুষ প্রতিনিয়তই প্রাকৃতিক দুর্যোগের অভিশপ্ত হানা বজ্রপাতে প্রাণ হারাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে বজ্রপাত নিয়ে কোনো গবেষণা ও তা থেকে মৃত্যুরোধের কার্যকর জাতীয় কোনো কার্যক্রম নেই। সীমিত পরিসরে বজ্রপাত সম্পর্কিত পুস্তিকা ও লিফলেট প্রকাশ এবং সেমিনার আয়োজন করার মধ্য দিয়েই সরকারি দায়িত্ব পালন সীমাবদ্ধ রয়েছে। 

হাওরাঞ্চল তথা গ্রামীণ জনপদের মানুষেরাই এই বজ্রপাতের শিকার হয় বেশি। তারা গ্রীষ্মকালীন এই সময়টায় হাওরে কর্মব্যস্ত থাকাকালীন বজ্রবৃষ্টি শুরু হলে তড়িঘড়ি কোথাও আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ না মেলায় বজ্রপাতের শিকার হয়। গত ৭ মে রাত সাড়ে ১১টায় সুনামগঞ্জস্থ জামালগঞ্জের হাওর পল্লীতে অস্থায়ী ঘরে অবস্থানরত জজ মিয়া নামের এক কৃষক বজ্রপাতে তাৎক্ষণিক মৃত্যুবরণ করেন। তার স্ত্রী-পুত্র ও পুত্রবধূসহ আহত হয় আরো ৬ জন। সুনামগঞ্জের একফসলি ভাটি অঞ্চলে বৈশাখী হাওয়া শুরু হলে প্রায় কৃষক পরিবারই হাওরে এভাবে অস্থায়ী তাঁবু গেড়ে কৃষিকাজ চালিয়ে যায়। আর এতেই নেমে আসে দুর্যোগ, মৃত্যুমুখো হয় কৃষক। শুধু কৃষক সম্প্রদায়ই নয়, গ্রামীণ জনপদের অসংখ্য মানুষকেই প্রয়োজনের তাগিদে ঘর থেকে বের হতে হয়। নানা কাজে বাইরে চলতে গিয়ে এ রকম প্রকৃতিগত দুর্যোগের মুখোমুখি হয়ে কেউবা প্রাণে বেঁচে যান, কেউবা মৃত্যুমুখে পতিত হন। এ থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বের করতে হবে। যদিও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থামানো অসম্ভব, তারপরও তা মোকাবেলার জন্য জনসচেতনতার পাশাপাশি গবেষণার মাধ্যমে বজ্রনিরোধক পন্থা অবলম্বন করা আবশ্যিক হয়ে উঠেছে। এর জন্য প্রয়োজন সরকারি সদিচ্ছা। 

চলতি বছর বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা ইতিমধ্যে ৭০ ছাড়িয়ে গেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, বুয়েট, দুর্যোগ ফোরাম, গণমাধ্যমের তথ্য ও একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হিসাবমতে, ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের বর্তমান অবধি বজ্রপাতে ২ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। এ মৃত্যুর সংখ্যা বিশ্বে বাংলাদেশেই বেশি। প্রতিবছর বিশ্বে বজ্রপাতে মৃত্যুর এক-চতুর্থাংশই ঘটে এ দেশে। বজ্রপাতের হাত থেকে বাঁচতে সচেতনতার বিকল্প নেই বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশে প্রতি বছর গড়ে ২৫০ জনের বেশি মারা যান বজ্রপাতে। বেসরকারি হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা আরো বেশি। 

বজ্রসহ যেকোনো প্রকৃতিগত দুর্যোগ ধেয়ে আসার অন্যতম কারণ মানুষ। আমরা নানাভাবে প্রকৃতিকে ক্ষেপিয়ে তুলছি। প্রকৃতি বাঁচার প্রধানতম উৎস গাছগাছালি ধ্বংস করে মানুষ তাদের চাহিদা পূরণ করে চলেছে। আর এভাবেই বায়ু, প্রকৃতি ও পরিবেশ দূষণ করে চলেছি আমরা। যার কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা বজ্রপাত সংঘটিত হচ্ছে। ২০০৮ সালে সুইডেনে অনুষ্ঠিত ২৯তম ‘ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন লাইটিং প্রটেকশন’ শীর্ষক সম্মেলনে তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক কলিন প্রাইস তার ‘থান্ডারস্টর্ম, লাইটিং অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেন, বায়ুদূষণ তথা পরিবেশদূষণের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে বজ্রপাতের। বজ্রপাতে একদিকে যেমন বায়ুদূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি বেড়েছে পরিবেশে বজ্রপাতের হারও তীব্রতা। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরা আরো বলেছেন, আবহাওয়া-সম্পর্কিত দ্বিতীয় বৃহত্তম ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে বজ্রপাত। জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি হওয়ায় বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাপ্তাহিক ও দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস তালিকায় নতুন যুক্ত হয়েছে বজ্রঝড়। এছাড়া বজ্রপাত-সম্পর্কিত আবহাওয়া বিজ্ঞানে বলা হয়েছে, গ্রীষ্মকালে দিনের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে বাতাস গরম হয়ে ওপরে উঠতে থাকে। জলীয়বাষ্পও ওপরে উঠে আর মেঘের ভেতর যত বেশি পরিমাণে জলীয়বাষ্প ঢুকবে তত বেশি উষ্ণ মেঘের সৃষ্টি হবে। এ সময় ‘আপ ড্রাফ’ এবং ‘ডাউন ড্রাফ’ বাতাসে চলতে থাকে। একে বলা হয় বজ্রমেঘ। মেঘের ওপরের অংশে পজেটিভ এবং নিচের ও মধ্য অংশে নেগেটিভ বিদ্যুৎ তৈরি হয়। পজেটিভ ও নেগেটিভ মেঘের ভেতরের বিদ্যুৎ আঁধারে দূরত্ব বেড়ে গেলে প্রকৃতির নিয়মে ভারসাম্য আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়। পজেটিভ ও নেগেটিভ মেঘ থেকে বিদ্যুৎ আদান-প্রদান শুরু হয়। পজেটিভ ও নেগেটিভ বিদ্যুৎ সঞ্চালন শুরু হলে বজ্রের সৃষ্টি হয়। আর তখনই বজ্রপাত হতে থাকে।  

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীতে হানা দিচ্ছে বিভিন্ন রকম দুর্যোগ। তার মধ্যে বজ্রপাত অন্যতম। অব্যাহতভাবে বড় বড় বৃক্ষ নিধনের পাশাপাশি পর্যাপ্ত গাছ লাগানো হচ্ছে না বিধায় ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়াসহ বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বজ্রপাতের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রাথমিক সম্ভাব্য কারণ হচ্ছে গাছ কেটে ফেলা। এছাড়া অন্যান্য কারণও রয়েছে। যতটুকু জানা যায়, ব্রিটিশ শাসনামলে বজ্রপাত থেকে বাঁচার জন্য মাটির নিচে পিতল, তামা ও ধাতব চুম্বক সমন্বয়ে পিলার পুঁতে রাখা হয়। প্রযুক্তিগত এই পিলারগুলো দেশজুড়ে মাটির নিচে একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে ফ্রিকোয়েন্সি মেপে মেপে পোঁতা হতো। এই পিলারগুলো পিতল, তামা, লোহা, টাইটেনিয়ামসহ ধাতব চুম্বক সমন্বয়ে গঠিত হওয়ার কারণে বজ্রপাতের সময় এগুলো ইলেকট্রিক চার্জের মাধ্যমে আর্থিংয়ের কাজ করত এবং তা শোষণ করে নিত। ফলে বজ্রপাত হলেও মানুষ মারা যায় না। বজ্রনিরোধক এই ব্রিটিশ প্রযুক্তিনির্ভর পিলারগুলো মূল্যবান ও অনেক দামে বিক্রি করার মোহে একটা বিশেষ গোষ্ঠী রাতের আঁধারে চুরি করে নিয়ে গেছে। যার কারণে বজ্রপাতের আধিক্য দেখা দিয়েছে বলে ধারণা করা হয়। 

অতীত ও বর্তমান বজ্রপাত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দিন দিন বেড়েই চলেছে এর মাত্রা। আবহাওয়া অধিদপ্তরের মতে, আশির দশকে মে মাসে গড়ে ৯ দিন বজ্রপাত হতো। অথচ ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সারা দেশে পাঁচ হাজার ৭৭২টি বজ্রপাত হয়েছে। বজ্রপাতের এই ভয়ংকর থাবা থেকে বাঁচতে হলে বেশি বেশি গাছ লাগাতে হবে। বজ্রপাত মোকাবেলায় হাতিয়ার হিসেবে কাজ করা তালগাছ প্রায় বিলুপ্ত। এছাড়া অন্যান্য উঁচু গাছপালা কেটে মনুষ্য প্রয়োজনে ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব প্রকৃতি বিধ্বংসী অপকর্ম থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সবাইকে গ্রহণ করতে হবে প্রকৃতিবান্ধব নীতি। নইলে বসবাস উপযোগী এ পৃথিবীটা ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।  

লেখক : সাংবাদিক 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads