• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

মতামত

চিকিৎসকদের দোষ-গুণ এবং...

  • প্রকাশিত ০৩ জুলাই ২০১৯

গত বছর বন্দর নগরী চট্টগ্রামে এক সাংবাদিকের শিশুসন্তান মারা যাওয়ার জেরে সাংবাদিক সংগঠন ও চিকিৎসকদের সংগঠনগুলো মুখোমুখি অবস্থানে ছিল। তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হওয়া সাপেক্ষে অভিযুক্ত চিকিৎসকের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে উত্তাল ছিল পত্রপত্রিকা, রাজপথ-এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও। আমিও প্রতিবাদে শামিল ছিলাম।

কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মর্তুজা তার নির্বাচনী এলাকার একটি সরকারি হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়ে পাঁচজন চিকিৎসকের মধ্যে মাত্র একজন চিকিৎসককে কর্তব্যরত দেখে ক্ষিপ্ত হন। নিঃসন্দেহে নড়াইল এক্সপ্রেসের অভিযানটি ছিল জনগণের প্রতি তার দায়বদ্ধতা থেকে। কিন্তু ঘটনাটি তার ফেসবুক পেজে পোস্ট হলে দ্রুতবেগে তা ছড়িয়ে পড়ে এবং চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষী উগ্র পোস্টের তাণ্ডব শুরু হয়। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, চিকিৎসকদের একটি বড় অংশ দুর্নীতিবাজ। একটি শ্রেণি-পেশার সব লোক দেশপ্রেমী-মানবতাবাদী হবে-এটি ধারণা করাও অবান্তর। ঢালাওভাবে চিকিৎসাব্যবস্থার সমালোচনা করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমাদের দেশের পোশাকশিল্প পল্লীতে মাঝে মধ্যে কোনো কারণ ছাড়াই ভয়াবহ অস্থিরতা দেখা যায়। অনেকে মনে করেন, এর পেছনে ভিনদেশি ষড়যন্ত্র আছে। কারণ এখানে অস্থিরতা হলে ওখানে লাভ হবে। বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর জনগণের অনাস্থা তৈরি করতে পারলে ভিনদেশি চিকিৎসাব্যবস্থা মোটাতাজা হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

চিকিৎসকদের আমরা যে দোষ খুঁজে পাই, তা হচ্ছে-তাদের সীমাহীন বাণিজ্যিক চিন্তা লালন করা; সরকারি হাসপাতালগুলোতে অনেক চিকিৎসক যথাযথ চিকিৎসাসেবা প্রদানে অনাগ্রহী; বেসরকারি ক্লিনিকগুলো চিকিৎসকদের একটি অংশকে ব্যবহারের মাধ্যমে মুনাফার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত; ওষুধ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চিকিৎসকদের অনৈতিক লেনদেন; কতিপয় চিকিৎসকদের অবহেলার কারণে অনেক রোগীর অকাল মৃত্যু ঘটছে; গুটিকতক চিকিৎসক স্যাম্পলের ওষুধ দোকানে বিক্রি করেন এবং কিছু অসুস্থ রাজনীতির লেজুড়বৃত্তিতে লিপ্ত আছেন।

এ দোষগুলোর জন্য অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা এককভাবে দায়ী নন। কেননা সরকারি হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সরঞ্জাম নেই। ইচ্ছা থাকলেও অনেক সময় যন্ত্রপাতির অভাবে সঠিক চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় না। আবার প্রাইভেট হাসপাতালে সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। সরকার মনিটরিং করলে সমস্যার সমাধান কিছুটা হলেও হতে পারে। তা ছাড়া ডাক্তারের ভিজিটের ব্যাপারে সরকারের সুস্পষ্ট নীতিমালা নেই। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি বলে মনে করি। এর ফলে সাধারণ রোগীরা কিছুটা আর্থিক সুবিধা লাভ করবে। তদুপরি সরকারি হাসপাতালে ওষুধ না দেওয়া, অক্সিজেন না দেওয়া, ওয়ার্ডে সিট না দেওয়া—এ জাতীয় সহস্র অভিযোগ চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে শোনা যায়। তবে গভীরে গেলে দেখা যাবে যে, এসবের সঙ্গে চিকিৎসকরা সম্পৃক্ত নন। কিছু অসাধু নার্স, ওয়ার্ডবয়দের অপকর্মও চিকিৎসকদের কাঁধে এসে পড়ে।

আমাদের দেশের সীমাবদ্ধতার কথাও মাথায় নেওয়া উচিত। মাথাপিছু কয় লাখ জনগণের জন্য একজন সরকারি চিকিৎসক আছে, সেটিও বিবেচনা করতে হবে। পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩৬টি পদই শূন্য। বাউফলের চার লাখ লোকের জন্য বর্তমানে সরকারি চিকিৎসক আছে মাত্র চারজন! কুড়িগ্রামের উলিপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৪২ চিকিৎসকের জায়গায় আছেন ৫ জন। সমগ্র দেশের চিত্রই এমন। চিন্তাশীল মানুষ মাত্রই বুঝতে পারবেন সমস্যাটা কোথায়! ওষুধ কোম্পানিগুলো চিকিৎসকদের জনপ্রিয়তা বিবেচনায় মাসিক একটি সম্মানী দেয়। তথাপি কোনো চিকিৎসক কখনো ওষুধের মান বিবেচনা না করে রোগের বাইরে ওষুধ লেখেন না। অতিসম্প্রতি আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু পার্শ্ববর্তী দেশে অপারেশন করে এসেছেন। আমার বড়ভাই অধ্যাপক মোহাম্মদ ইলিয়াছ এখনো অপারেশনের জন্য সেখানে অবস্থান করছেন। ওখানে চিকিৎসার আগে অসংখ্য টেস্ট করাতে হয়। সব টেস্ট না করালে অপারেশন টেবিলে কোনোক্রমেই রোগী নেবে না। আর বাংলাদেশের চিকিৎসক প্রেসক্রিপশনে টেস্ট দিলেই অপরাধ! এমন ধারণা থেকে আমাদের বের হয়ে আসা উচিত।

তবে চিকিৎসকদের যে কিছু গুণও রয়েছে, তা ভুলে গেলে চলবে না। ঈদ, পূজা, বুদ্ধপূর্ণিমা, বড়দিন, পহেলা বৈশাখ বা কোনো বিশেষ দিনে কোনো হাসপাতাল বন্ধ থাকে না। যেকোনো মুহূর্তের জন্য চিকিৎসক সদা প্রস্তুত থাকেন। কোনো চিকিৎসক কখনো কোনো রোগীকে বলেন না, আপনি আর বেশিদিন বাঁচবেন না, অমুক তারিখের মধ্যে আপনি মারা যেতে পারেন। কোনো চিকিৎসক কোনো রোগীর সঙ্গে উগ্র আচরণ করেন না। দেশের আনাচে-কানাচে নিজের পকেটের পয়সা খরচ করেও অনেক চিকিৎসক চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছেন। সংগত কারণেই এমন কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া প্রয়োজন—মানিকগঞ্জে ডা. রওশন আরা বেগম তার পরিবারের ভিটায় গড়ে তোলা ‘সায়েরা হাসান মেমোরিয়াল হাসপাতাল’-এ দীর্ঘদিন ধরে মানবিক চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছেন। ডা. রওশনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশ-বিদেশের ছয় শতাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এই চিকিৎসাসেবায় যুক্ত হয়েছেন। এই ছয় শ চিকিৎসকও তো চিকিৎসক! মাত্র এক হাজার টাকা, সাধ্যে না কুলালে সাধ্যমতো খরচে জটিল অপারেশন করা হয় এই হাসপাতালে। আড়াই লাখের বেশি রোগী এই হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিয়েছেন। স্বাস্থ্যসেবায় মাদার তেরেসা পুরস্কারপ্রাপ্ত পাবনার ডা. আবদুস সাত্তার ‘নিউ বিউটি ক্লিনিক অ্যান্ড চলনবিল ডায়াগনস্টিক সেন্টার’-এ একের পর এক বিনা মূল্যে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উপ-সহকারী মেডিকেল অফিসার ডা. রফিকুল ইসলাম সরকারি হাসপাতালে সেবা দানের পাশাপাশি অতিরিক্ত সময়ে নিজস্ব ‘সেবা চেম্বার’-এ নিয়মিত রোগী দেখেন। রোগীরা খুশিতে যা দেন, তাই হাসিমুখে গ্রহণ করেন তিনি। গরিব রোগীদের ক্ষেত্রে তিনি বলেন, ‘টাকা লাগবে না। আমার জন্য দোয়া করবেন।’ এমন দৃষ্টান্ত আরো অনেক দেওয়া যাবে।

মাঝে মাঝে ভাবি, হাসপাতাল এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এত ঘন ঘন অভিযান পরিচালিত হয়, কিন্তু অন্য সেক্টরে দুর্নীতির আখড়াগুলো অভিযানমুক্ত কেন! এই যেমন ধরুন—এক কোটি ৪০ লাখ ছয় হাজার টাকা মূল্যের বালিশ; এসব জায়গায় অপারেশন চলে না! আসলে চিকিৎসক-মাস্টার এরা তো সমাজের নিরীহ শ্রেণি। পে-কমিশনে এদের কোনো প্রতিনিধি থাকে না, সিনিয়র সচিবের সম গ্রেডে এদের স্থানও নেই। ক্ষমতার দুনিয়ায় এরা মূল্যহীন। সুতরাং এই দুই জায়গা ব্যতীত অন্য জায়গায় হাত দিলে হয়তো হাত পুড়েও যেতে পারে।

লেখক : মুহাম্মদ ইয়াকুব

কবি ও কথাশিল্পী, উপদেষ্টা সম্পাদক, ত্রৈমাসিক শব্দবাজ

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads