• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
প্রসঙ্গ বয়স এবং বেকারত্ব

সংগৃহীত ছবি

মতামত

প্রসঙ্গ বয়স এবং বেকারত্ব

  • নাজমুল হোসেন
  • প্রকাশিত ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯

কথায় আছে, সুন্দর ভবিষ্যৎ সবার জন্য অপেক্ষা করে। আর শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা সুন্দর ভবিষ্যৎ বলতে বুঝে থাকেন একটা মানসম্মত চাকরি আর একটা সুন্দর সংসার। আর এই দুটি বিষয়ই একে অপরের পরিপূরক। কিন্তু এদেশে চাকরি পাওয়ার পথ কণ্টকাকীর্ণ। কারণ চাকরিপ্রাপ্তিতে বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ সমস্যার পাশাপাশি আবেদনেও রয়েছে বয়সের সীমাবদ্ধতা। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবি নিয়ে চাকরিপ্রার্থীদের একটা বিশাল অংশ কয়েক বছর ধরে আন্দোলন করে যাচ্ছে। আন্দোলন করেই যদি তারা তাদের দাবি করা বয়সসীমা পার করে দেয়, তাহলে তাদের ভবিষ্যৎ কোন পথে?  

সরকারের দায়িত্বশীলদের অনেকেই বার বার বয়স বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি। তাছাড়া একাদশ জাতীয় নির্বাচনী ইশতেহারে মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতার বিচারে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানো হবে প্রতিশ্রুতি থাকলেও আজো বাড়েনি চাকরিতে প্রবেশের বয়স। তাহলে বেকারত্ব বাড়বে না কেন? সম্প্রতি অবৈধ পথে উন্নত দেশে পাড়ি দিতে গিয়ে ভিটে-মাটি বিক্রি করে অনেকেই নিঃস্ব হয়েছেন; অকালে, কষ্টে প্রাণ দিয়েছেন যা কারো অজানা নয়। এখানে উদ্যোক্তা হওয়াও এত সহজ নয়, কারণ এই পথ অনেক বন্ধুর। পূর্ব বাস্তব অভিজ্ঞতাহীন ও ঝুঁকিপূর্ণ এই পথে একবার ব্যর্থ হলে কেউ টেনে তুলবে না। এই পথে সারা দেশে যে কয়জন সফল, সেই সংখ্যা সমুদ্রে মুক্তা খোঁজার মতোই। এবারের বাজেটে তরুণ বেকারদের জন্য সব ধরনের ব্যবসায় উদ্যোগ সৃষ্টির জন্য যে বরাদ্দ রয়েছে তা বেকারদের সংখ্যানুপাতে কতটা পর্যাপ্ত তাও বিবেচ্য বিষয়।  

বিশ্ব ব্যাংক ২০০৮ সালে যে ঊধংব ড়ভ ফড়রহম ইঁংরহবংং-এর প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১৫তম। এরপর থেকে এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান শুধু পেছাচ্ছে। সর্বশেষ গত ৩১ অক্টোবর প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান দাঁড়ায় ১৮৯টি দেশের মধ্যে ১৭৬তম। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) জানিয়েছে, এ বছর বেশ কিছু সংস্কার হয়েছে। তাই আসন্ন অক্টোবরের নতুন প্রতিবেদনে এই সূচকে বাংলাদেশ অনেকটাই এগিয়ে যাবে। এমন আশার বাণী বাস্তবে কতটা সফলতা অর্জন করবে সেটা হয়তো সময়ই বলে দেবে। অন্যদিকে দেশে প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এত দারুণ ঊর্ধ্বমুখী প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে যদি চাকরির সংস্থান না করা যায়, তাহলে প্রবৃদ্ধি দিয়ে কী হবে? দ্রুতই সমাধানের অন্বেষণ না করলে হয়তো ডুয়িং বিজনেস সূচকের মতো হঠাৎ করে এ ক্ষেত্রেও ধস নামতে পারে। প্রবৃদ্ধির প্রতিফলন কর্মসংস্থানে পড়ছে না। কারণ সরকারি বিনিয়োগ বাড়লেও যেভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ হচ্ছে তা মানসম্মত হচ্ছে কিনা সেটিও ভাবার বিষয়। আর ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ খুব কম হচ্ছে।  যার ফলে কর্মসংস্থানও বাড়ছে না। 

এক জরিপে জানা যায়, প্রতিবছর নতুন ২২ লাখ কর্মক্ষম মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে কিন্তু কাজ পায় মাত্র ৭ লাখ। বাকি ১৫ লাখ থাকে বেকার যাদের মধ্যে উচ্চ শিক্ষিত অর্থাৎ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরাও রয়েছেন। তাই প্রতিবছর এই নতুন ১৫ লাখ ক্রমাগত বেকারের সংখ্যা বাড়িয়েই দিচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর ২০১৬-১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী দেশে বেকারের প্রকৃত সংখ্যা ৪ কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজার। নতুন জরিপে এই সংখ্যা আরো বড় হবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি পাকিস্তানে ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। বাংলাদেশে এ হার ১০ দশমিক ৭ শতাংশ, যা এ অঞ্চলের ২৮টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। কিন্তু এই বেকারত্ব থেকে উত্তরণের উপায় কী? মূল কথা, আমাদের শিক্ষা পদ্ধতি ও কাজের মধ্যে রয়েছে বিরাট ফারাক। গতানুগতিক এই শিক্ষা পদ্ধতিতে প্রযুক্তিগত জ্ঞান, কারিগরি দক্ষতা ও ভাষাগত যোগাযোগের পর্যাপ্ত দক্ষতা অর্জন সম্ভব নয়। কাজেই বড় কোম্পানিগুলোকে দেশের বাইরে থেকেই দক্ষ ও উপযুক্ত জনশক্তি আমদানি করতে হচ্ছে। এ বিষয়টি নিয়ে সরকার জ্ঞাত থাকলেও এর থেকে উত্তরণের কোনো পথ খুঁজছে বলে আমরা এখনো দেখিনি। 

স্বীকার করছি, শিক্ষিত বেকারদের তুলনায় সরকারি চাকরির পদসংখ্যা অনেক কম। তবু তাদের আবেদনের পর্যাপ্ত সুযোগ দিতে আপত্তি কোথায়? কারণ বিষয়টি সম্পূর্ণই প্রতিযোগিতার ও মেধার। নীতিনির্ধারকদের অনেকেই বলতে পারেন, বয়স বাড়ালে প্রার্থীর সংখ্যা বাড়বে আর এত প্রার্থীর পরীক্ষা নিতে তারা হিমশিম খাবেন। এনটিআরসিএ যদি একযোগে সারা দেশের সব বিভাগের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সকাল-বিকাল এত প্রার্থীর পরীক্ষা নিতে পারে, তাহলে সরকারি চাকরির পরীক্ষাও এভাবে নিলে কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। শুধু সরকারি কেন, বেসরকারি সেক্টরেও প্রচুর চাকরি রয়েছে। অথচ হাতেগোনা দু-একটি ক্ষেত্র ছাড়া বেসরকারি ক্ষেত্রেও প্রবেশে ৩০-এর দেয়াল রয়েছে। তাছাড়া একটি নিয়োগে বিভিন্ন পদে আবেদনের মাধ্যমে প্রার্থীদের কাছ থেকে সরকার যে পরিমাণ পরীক্ষার ফি পাবে, তাতে ওই টাকা দিয়েই নিয়োগকৃতদের চাকরির অর্ধেক জীবনের বেতন-ভাতা পেয়ে যাবে। 

বিশ্বের কোনো দেশে সব চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা এ অঞ্চলের চেয়ে অনেক বেশি হওয়ায় বেকারত্ব বাড়ছে বা বেশি বয়সিরা চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেন না বা সরকারের কোনো সমস্যা হচ্ছে এমন তথ্য কেউ দিতে পারবেন না। আমাদের নীতিনির্ধারকদের বিপরীতমুখী এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে দ্রুতই বেরিয়ে আসতে হবে। একটি দেশের মেরুদণ্ড শিক্ষা তথা শিক্ষিত জনশক্তি। এদেরই দমিয়ে রেখে, কর্মহীন ও সুযোগবঞ্চিত রাখলে দেশের মেরুদণ্ড নষ্ট হয়ে বেকারত্বের বিস্ফোরণে নিঃসন্দেহে দেশ অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়বে। তাই এই অবধারিত আগাম সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে হলে সময়োপযোগী শিক্ষা পদ্ধতির প্রসার ঘটিয়ে বেকারত্ব কমাতে হবে; পাশাপাশি সব চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা দ্রুত বাড়াতে হবে।  

লেখক : প্রকৌশলী ও প্রাবন্ধিক

nazmulhussen@yahoo.com 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads