• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
আমার সেলাই করা মুখ

প্রতীকী ছবি

মতামত

আমার সেলাই করা মুখ

  • মামুন মুস্তাফা
  • প্রকাশিত ১১ অক্টোবর ২০১৯

‘এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়’— ভাবছি কবির এ বাণী আজ আমি বলব কি-না! আমাকেও কি লাশ হতে হবে? একটি প্রতিষ্ঠিত অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক দেশে তা কাম্য হতে পারে না! আজ এ প্রশ্নগুলো বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। তাই তো ভারতের জয়দেবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তনুশ্রী রায়ও রীতিমতো বিস্মিত! তিনি লিখেছেন, ‘নিজের দেশের স্বার্থ নিয়ে লেখার জন্য কীভাবে নিজের দেশেরই লোক একটা ছেলেকে এভাবে পিটিয়ে হত্যা করে ফেলে এটা আমার কাছে আশ্চর্য লাগছে। সামান্য ফেসবুক স্ট্যাটাসের কারণে মানুষ খুন করে ফেলা হচ্ছে বাংলাদেশে। কীভাবে এমন একটা দেশে মানুষ বাস করে!’ রাষ্ট্র কি এর উত্তর দেবে, নাকি দিতে সক্ষম? বাঙালি হুজুগে জাতি। কথাটা সত্য। তার থেকেও বড় সত্য বাংলাদেশের মানুষ আজ সবচেয়ে অসহিষ্ণু জাতি! তাদের এ পরিণতির কারণ কী? ভেবে দেখার সময় এসেছে বটে। আবরার হত্যা এরকম অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়ে গেছে।

বাংলাদেশ কি তবে সামাজিক অস্থিরতার দিকে হাঁটছে? যখন ঘরে ঘরে বেকারত্বের অভিশাপ, খবরের শিরোনাম হচ্ছে দলে দলে শূন্য হাতে ফিরছে প্রবাসী শ্রমিক, বেড়ে যাচ্ছে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য ঘাটতি, সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়তই নাকাল হচ্ছে ভোগ্যপণ্যের ঊর্ধ্ববাজারে, ঘরের ভেতরে ১১ লাখ উদ্বাস্তু রোহিঙ্গা শরণার্থী, ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে মাদকের নীল দংশন, ধর্ষণ, রাহাজানি, ছিনতাই, খুন; অথচ বিপরীতে গুটিকয়েক লোকের হাতে জমা হচ্ছে অর্থ-সম্পদ, লোভনীয় বাড়ি-গাড়ি। হোক সে জুয়াড়ি কিংবা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী অথবা অক্ষরজ্ঞানহীন কপর্দকশূন্য পিতার সন্তান! আজ ‘সুবচনে’র সঙ্গে সঙ্গে ‘সুশাসনও’ নির্বাসনে।

অথচ আবরার বুকে দেশপ্রেম লালন করেছিল বলে কিছু শুভবোধ তার ভেতরে জাগ্রত ছিল। তাই সে জাতির কাছে তার চিন্তার মনোজগৎটি উন্মোচন করে। কিন্তু তথাকথিত ছাত্ররাজনীতি যা কি-না ‘দেশের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে ব্যক্তি বড়’তে পর্যবসিত হয়েছে; সেখানে আবরাররা কেন থাকবে? সুতরাং জন্মই তার আজন্ম পাপ! আমাদের কাছে তার মৃত্যুই একমাত্র আরাধনা! এ দেশ শুধু নয়, বিশোত্তীর্ণ আবরারের অকাল মৃত্যু চেয়ে চেয়ে দেখতে হলো বিশ্ববাসীকে। আর তাই ভারতের ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকাও আবরারকে নিয়ে প্রতিবেদন করতে পিছপা হয়নি।

কিছুদিন আগেই গুজব আতঙ্কে ছিল সারা দেশ ও দেশের মানুষ। ভয়ঙ্কর ভীতি দানা বেঁধেছিল জনমানুষের মধ্যে বিশেষত ঘরের নারীদের ভেতর। স্কুল-কলেজগামী ছেলেমেয়েদের নিয়ে তারা বেশ চিন্তিতই। আর গ্রামাঞ্চলের অভিভাবকরা তো ছেলেমেয়েদের রীতিমতো গৃহবন্দি করে রাখতেও পিছপা হননি। এই গুজব আবারো প্রমাণ করেছে যে, বাঙালির জন্য প্রয়োজ্য ‘হুজুগে’ বিশেষণটি একেবারে বৃথা যায়নি। কেননা দিব্যচোখেই পৃথিবীব্যাপী মানুষ দেখেছে কীভাবে ‘হুজুগে বাঙালি’ গুজবে কান দিয়েই মাত্র কয়েকদিনে হত্যা করেছে অন্তত দশজনকে। যার মধ্যে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন নিরীহ নারী-পুরুষ। পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে শিশু থেকে যুবক, পাওয়া গেছে তাদের দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করা মুণ্ডু। এই নৃশংসতার শুধু অবসান নয়, অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডসহ গুজব রটনাকারীদেরও আইনের আওতায় এনে শাস্তি কামনা করেছিল দেশবাসী। আমরা তা কতটুকু করতে পেরেছি? ‘ন্যায়বিচার’ একটি রাষ্ট্রকে এগিয়ে নেওয়ার বড় নিয়ামক শক্তি। আর এই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা না পেলে একটি রাষ্ট্রের ইচ্ছামৃত্যু ঘটে। আমরা কি তবে সে পথেই হাঁটছি?

কিন্তু আশার আলো দেখি, যখন সব দুর্নীতিবাজকে ধরতে দেশব্যাপী অভিযান চলে; রাজনৈতিক দলগুলোতে চলে শুদ্ধি অভিযান; কিংবা নিজ দলের বিভিন্ন অঙ্গ-সংগঠনের ভেতরেও চলে বহিষ্কার, বিচার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই দৃঢ়চেতা সাহসী মানসিকতা সাধারণ জনগণের প্রেরণার শক্তি; কবির ভাষায় বললে— ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’। এমন পরিস্থিতিতে আবরার হত্যার বিচার আলোর মুখ দেখবে বলে বিশ্বাস করে জাতি। কিন্তু এখন আমাদের ভাবার সময় এসেছে, প্রযুক্তিনির্ভর বর্তমান সমাজব্যবস্থায় কেন এই গুজব? কেনই বা ভিন্ন মত দমনের এই অপচেষ্টা? এর পেছনে কোনো স্বার্থ খেলা করছে? এর গডফাদার কারা? আগামীর ভবিষ্যৎকে নিরাপদ রাখতেই এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নিতে হবে জরুরিভিত্তিতে।

বর্তমান ঘুণেধরা সমাজের অবক্ষয় থেকে পরিত্রাণের জন্য সবার আগে প্রয়োজন সামাজিক উদ্যোগ এবং সামাজিক আন্দোলনের জাগরণ। একসময় দেশ ও সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সামাজিক উদ্যোগ কার্যকর ভূমিকা রাখত। তখন সেসব উদ্যোগের মূল্যায়ন করা হতো। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, সমাজবদ্ধ মানুষের সামাজিক উদ্যোগই সভ্যতার দিকে পৃথিবীকে এগিয়ে নেওয়ার প্রথম ধাপ। সমাজের মানুষের বিভিন্ন উদ্যোগই মানুষকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। সংগঠিত মানুষের বহুমুখী চিন্তা-চর্চা-চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি, শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং কর্মতৎপরতা সমন্বয়ের স্রোতে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটায়। এর ফলে সামাজিক রীতি-নীতি, আচার-আচরণ, সর্বোপরি সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে সমাজ ক্রমেই সামনের দিকে এগিয়ে যায়। এই সামগ্রিক সামাজিক অগ্রসরতার নাম হলো উন্নয়ন।

একটি সমাজে নানা পথ, মত, চিন্তা, বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ বসবাস করে। যারা কোনো না কোনোভাবে সমাজ উন্নয়নে অবদান রাখে। এ কারণে সামাজিক উন্নয়নে ব্যক্তির ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। তবে একক প্রচেষ্টা অনেক সময় তেমন ভূমিকা রাখতে পারে না। বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি উদ্যোগ, চিন্তা ও চেষ্টাগুলো সমন্বিত হলেই এটি পরিণত হয় সামাজিক উদ্যোগে। আবার ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং সামাজিক অবক্ষয় প্রতিরোধে সম্মিলিত সামাজিক প্রচেষ্টা ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়। যার নাম— সামাজিক আন্দোলন। আর এটি সমাজে বিদ্যমান নানা অনিয়ম-অনাচার তিরোহিত করতে জোরালো ভূমিকা রাখে। এর মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির জাগরণ সৃষ্টি হয়, মানুষ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়। বহু দল-মত ও চিন্তাশীল মানুষের ঐকমত্য সৃষ্টির মাধ্যমে একসঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার মানসিকতা জন্ম দেয়। আবরার সেই কাজটি করতে চেয়েছিল। আমরা তা হতে দিইনি।

আজ এই সমাজে মানুষ যেন একাকী, অসহায় এবং বিচ্ছিন্নতাবোধে আক্রান্ত। তাই বুঝি আমাকেই সেলাই করতে হবে আমার মুখ। কোনো ‘রা’ নয়!  আবরার হত্যার পর এক মা-ও তার সন্তানকে বাধ্য হয়েছেন বলতে যে, ‘বাবা ফেসবুকে কিছু লিখিস না।’ সমাজে যখন সুশাসন, ন্যায়বিচার গণমানুষের পক্ষে কাজ করে না, তখন নানাবিধ দুর্নীতির মাকড়সাজাল কিশোর অপরাধ, গণপিটুনি, খুনের মতো অপসংস্কৃতির উদ্ভব ঘটবেই। এখন প্রয়োজন মানুষের মাঝে সৎ চিন্তার জাগরণ। সমাজে সৎ মানুষ সম্মানের আসনে আসীন হলেই সৎ কাজে মানুষ উদ্বুদ্ধ হবে। এজন্য প্রয়োজন সততার সম্মানজনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। আবরারের এই হত্যা আমাদের মাঝে সেই শুভবোধের জাগরণ ঘটাক। আবরারের শোক আমাদের শক্তিতে পরিণত হোক। আমরা যেন সমাজের মধ্য থেকে উদ্যোগের মাধ্যমে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করাসহ এর উন্নয়নে প্রতিপক্ষের বাধাকে প্রতিহত করার সক্ষমতা অর্জন করতে পারি। তবে সুস্থ সমাজব্যবস্থা কায়েম করতে হলে রাষ্ট্রকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হতে হবে। এমতাবস্থায় সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও নাগরিকদের মধ্যে শুভবোধ জাগরণে রাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হবে।

আমার সেলাই করা মুখে অনেক কথাই বলে ফেলেছি। শেষ করব, বাংলাদেশের কবি আবুবকর সিদ্দিক স্বৈরাচারী এরশাদযুগে লিখেছিলেন কবিতা- ‘মানবজাত ভেসে যাচ্ছে’। সেই মানবজাতকে বাঁচাতে এখন ওপার বাংলার কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায় বলব, ‘মানুষ বড় কাঁদছে/তুমি মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াও।’

 

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads