• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
চীনে উইঘুর নির্যাতন

সংগৃহীত ছবি

মতামত

চীনে উইঘুর নির্যাতন

  • প্রকাশিত ১৩ অক্টোবর ২০১৯

উইঘুর মূলত মধ্য এশিয়ায় বসবাসরত তুর্কি বংশোদ্ভূত একটি মুসলিম জাতিগোষ্ঠী। এদের সংখ্যাগরিষ্ঠের বসবাস চীনের বৃহত্তম প্রদেশ জিনজিয়াংয়ে। জিনজিয়াংয়ের বাইরে হুনান প্রদেশেও কিছু উইঘুর রয়েছে। উইঘুরদের দৈহিক গঠন, ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস চীনের মূলধারার জনগোষ্ঠী হানদের থেকে অনেক আলাদা। উইঘুররা অনেক প্রাচীন একটি জাতি। এদের ইতিহাস প্রায় চার হাজার বছর আগের। চীনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আগে এরা একটি স্বাধীন জাতি ছিল। তাদের স্বাধীন দেশের নাম ছিল উইঘুরিস্তান বা পূর্ব তুর্কিস্তান। ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ১৬৬৪ সালে চীনের মাঞ্চু শাসকরা কিং সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার সময় উইঘুরদের সুবিশাল এই এলাকা দখল করে নেয়। স্বাধীনচেতা উইঘুররা এই পরাধীনতাকে মেনে নেয়নি। ২০০ বছর পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকার পর তারা কিছু সময়ের জন্য ফিরে পায় স্বাধীনতা। স্বাধীনতা অর্জনের থেকে রক্ষা করা কঠিন। উইঘুরদের ইতিহাস যেন তার জ্বলন্ত প্রমাণ। স্বাধীনতা অর্জনের কিছুকাল পরেই ১৮৭৬ সালে চীন আবার তাদের স্বাধীনতা হরণ করে। উইঘুরিস্তান দখল করে তার নাম দেয় জিনজিয়াং। যার অর্থ নতুন ভূমি। পরবর্তীকালে ১৯৪৪ সালে উইঘুররা স্বতন্ত্র তুর্কিস্তান রাষ্ট্র গঠন করতে সমর্থ হয়। কিন্তু ১৯৪৯ সালে চীনে কমিউনিস্টরা ক্ষমতা গ্রহণের পর আবার জিনজিয়াং নিজেদের দখলে নিয়ে নেয় এবং সেখানে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু উইঘুররা স্বায়ত্তশাসন নিয়ে কখনো খুশি ছিল না। তারা বরাবরই স্বাধীনতার পক্ষে। এমনকি এখনো অনেক উইঘুর জিনজিয়াংকে পূর্ব তুর্কিস্তান বলে থাকে। কারণ তাদের রয়েছে নিজস্ব জাতিগত সত্তা, নিজস্ব সংস্কৃতি যা চীনের মূল জনগোষ্ঠী হানদের থেকে পুরোপুরি ভিন্ন। উইঘুরদের ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি মধ্যএশিয়ার দেশ কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তানের সঙ্গে অনেক বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ। উইঘুররা মুসলিম, যা অনেকটা তুর্কির মতো, বর্ণমালা আরবি। অন্যদিকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হানদের ভাষা মান্দারিন। উইঘুরদের স্বাধীনতাকামী মনোভাবের কারণে চীনারা তাদের ওপর কঠোর মনোভাব পোষণ করে থাকে।

প্রাকৃতিক সম্পদে পূর্ণ জিনজিয়াংকে চীন কখনোই হাতছাড়া করতে চায়নি। জিনজিয়াং প্রদেশে প্রচুর পরিমাণে মজুত রয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাস, খনিজ, কয়লা, তেল যা চীনের জ্বালানি চাহিদার ৮০ শতাংশ পূরণ করে। এখানে সোনা ও ইউরেনিয়ামেরও বিশাল মজুত রয়েছে। এ ছাড়া জিনজিয়াং চীনের প্রধান ফসল উৎপাদন কেন্দ্র। চীনা সরকারের পরিকল্পনা হচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদে পূর্ণ জিনজিয়াং প্রদেশের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়া। সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করা। তাই পরিকল্পনা করে সেখানে হানদের বসবাসের ব্যবস্থা করে চীন। ৫০ বছর আগে যেখানে হানরা ছিল মাত্র ৫ শতাংশ, সেখানে বর্তমানে হানরা ৪০ শতাংশ। ১৯৪৯ সালে সেখানে উইঘুররা ছিল ৭৬ শতাংশ আর এখন মাত্র ৪২ শতাংশ। চীনা সরকার বর্তমানে জিনজিয়াং প্রদেশে কঠোর দমন পীড়ন চালাচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তাদের একমাত্র পরিকল্পনা উইঘুরদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করা।

উইঘুরদের ওপর চীনা সরকার চাপিয়ে দিয়েছে কঠোর কিছু নিয়মনীতি। উইঘুর মুসলিমরা স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম পালন করতে পারেন না। সেখানে মুসলিম পুরুষদের দাড়ি রাখা এবং নারীদের হিজাব পড়া সম্পূর্ণ নিষেধ। ১৮ বছরের আগে কোনো উইঘুর বালক মসজিদে যেতে পারে না। ৫০ বছরের আগে কেউ প্রকাশ্যে নামাজ পড়তে পারেন না। শূকরের মাংস খেতে বাধ্য করা হয় তাদের। উইঘুরদের রোজা রাখার ওপর আছে নিষেধাজ্ঞা। সেখানে নামাজের সময় আজান দেওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অনেক মসজিদ ভেঙে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে পর্যটন কেন্দ্র। আল জাজিরার এক প্রতিবেদন অনুসারে দুই যুগে চীনে ৬ হাজারের বেশি মসজিদ বন্ধ করা হয়েছে।

সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে উইঘুররা হানদের থেকে অনেক পিছিয়ে। সরকারি চাকরি, বড় বড় ব্যবসা-বাণিজ্য সবই এখন হানদের দখলে। উইঘুরদের দৈনন্দিন জীবনে তারা কী করে, কোথায় যায় সবটা থাকে প্রশাসনের নজরদারিতে। বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে উইঘুরদের কণ্ঠ, ডিএনএ, আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করে তাদের ওপর নজরদারি চালায় সরকার। এইচআরডব্লিউর এক প্রতিবেদন অনুসারে জিনজিয়াংয়ের মুসলিম বাড়িগুলোতে  স্মার্ট ডোর প্লেটে কিউআর কোড বসানো হয়েছে, যার মাধ্যমে তাদের সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখা হয়। ২০১৬ সালে চীনা সরকার ‘মেকিং ফ্যামেলি’ নামে একটি উদ্যাগ গ্রহণ করে। মেকিং ফ্যামেলির নিয়ম অনুযায়ী উইঘুরদের প্রতি দুই মাসে কিছুদিনের জন্য কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাতে হয়। এ ছাড়া তাদের সরকারি সংবাদ শুনতে বাধ্য করা হয়।

২০১৮ সালের আগস্ট মাসে জাতিসংঘ প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, চীনা সরকার প্রায় ১০ লাখ উইঘুরকে বন্দি শিবিরে আটকে রেখেছে এবং ২০ লাখ মানুষকে ‘রাজনৈতিক পুনর্বিবেচনার শিবিরে’ অবস্থান করতে বাধ্য করেছে। বিশ্ব মানবধিকার সংস্থাগুলোর দাবি বন্দি শিবিরগুলোতে বন্দিদের মান্দারিন ভাষা শিখতে এবং নিজ ধর্মের সমালোচনা বা ধর্ম পরিত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। অবশ্য চীন এগুলোকে বন্দি শিবির বলে স্বীকার করে না। তারা এগুলোকে ‘বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ বলে অবহিত করেছে। তাদের দাবি, সেখানে শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদ ও ধর্মীয় উগ্রপন্থা দমন করা হয়। এখানে পরিষ্কার যে, চীন উইঘুরদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সন্ত্রাসবাদ ও ধর্মীয় উগ্রপন্থা হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। সেখানে যেকোনো সংবাদমাধ্যম নিষিদ্ধ করেছে। সংবাদমাধ্যমগুলোর অনুপস্থিতির কারণে এসব নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর বাকি পৃথিবীর কাছে পৌঁছায় না। ফ্রিডম ওয়াচ চীনকে পৃথিবীর অন্যতম ধর্মীয় নিপীড়ক দেশ হিসেবে অবহিত করেছে। শুধু প্রাপ্তবয়স্ক নয়, শিশুদেরও সেখানে বন্দি করে রাখা হয়। মূলত শিশুদের তাদের ধর্ম, সংস্কৃতি থেকে দূরে রাখতেই এমনটি করছে চীনা কমিউনিস্ট সরকার। উইঘুরদের ওপর চীনের এই আগ্রাসনের প্রেক্ষিতে গত ১০ জুলাই ২০১৯ জাতিসংঘে ২২টি দেশ নিন্দা জানিয়ে চিঠি দিয়েছে। এই ২২টি দেশের তালিকায় কোনো মুসলিম দেশের নাম ছিল না। এরপর ১২ জুলাই এএফপি প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, উইঘুরে চীনা নীতিকে সমর্থন জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে ৩৭টি দেশ। যার মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, পাকিস্তান, সিরিয়া, ওমান, কুয়েত, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। এই দেশগুলোর মতে, চীন সরকারের এমন পদক্ষেপের ফলে জিনজিয়াংয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ফিরে এসেছে এবং সব নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মৌলিক মানবাধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে।

অবশ্য চীন সরকার তাদের সব থেকে বড় মুসলিম জনগোষ্ঠী হুইদের পূর্ণ ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিয়েছে। চীনের নাংশিয়া প্রদেশে বাস করে প্রায় দেড় কোটিরও বেশি হুই মুসলিম। ইকোনমিস্ট পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, বিগত কয়েক বছরে নাংশিয়ায় হুই মুসলিমদের মসজিদের সংখ্যা বেড়ে প্রায় চার হাজারে পৌঁছেছে। এমনকি হুই সংখ্যাগরিষ্ঠ কানুন প্রদেশের লিনজিয়া শহরটিকে বলা হয় ‘কুরআন বেল্ট’। হুইরা মূলত পারস্য, ইরান, সিরিয়া থেকে আগত মুসলিম জনগোষ্ঠী যারা হানদের বিয়ে করে চীনের মূল স্রোতের সঙ্গে মিশে গেছে। তাদের ভাষা মান্দারিন। তাদের দেহ, অবয়ব, খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতি সবকিছুই চীনাদের মতো। এমনকি হুইদের মসজিদগুলোকেও গড়ে তোলা হয়েছে প্যাগোডার আদলে। হুইদের সঙ্গে চীনা কমিউনিস্ট সরকারের রয়েছে উষ্ণ সম্পর্ক। বিভিন্ন সরকারি চাকরিতে তারা হানদের মতো বৈষম্যের শিকার হন না।

শুধু একটি অঞ্চলকে নিজেদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখার উদ্দেশ্যে, সেখানকার প্রাকৃতিক সম্পদগুলো নিজেদের অধিকারে রাখার জন্য চীন সেখানকার জনগণের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করছে। চীনের এই আচরণ কোনোভাবেই কাম্য নয়। অধিকাংশ মুসলিম দেশে চীনের বড় বিনিয়োগ থাকায় এবং চীনের সঙ্গে সুসম্পর্কের খাতিরে তাদের এই নীরবতা কাম্য নয়। জাতিসংঘসহ অধিকাংশ মুসলিম দেশ একটি ঐকমত্যে পৌঁছতে পারলে উইঘুররা তাদের স্বাধীন জীবন ফিরে পাবে বলে আশা করি।

আফসানা রিজোয়ানা সুলতানা

লেখক : শিক্ষার্থী

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads