• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪২৯
প্রসঙ্গ লক্ষ হাজার কোটি টাকা

প্রতীকী ছবি

মতামত

প্রসঙ্গ লক্ষ হাজার কোটি টাকা

  • শাহ আহমদ রেজা
  • প্রকাশিত ১৬ অক্টোবর ২০১৯

আগে শুনতাম, টাকা নাকি বাতাসে ‘ওড়ে’। কিন্তু তাই বলে সে উড়ে যাওয়া কিংবা উড়তে থাকা টাকা সবাই ধরতে পারে না। অর্থাৎ টাকা সবাই ‘বানাতে’ পারে না। এজন্য বিশেষ ‘যোগ্যতা’ লাগে। বিগত মাত্র কিছুদিনে টাকা এবং টাকা ‘বানানেওয়ালাদের’ সম্পর্কে দেশের সাধারণ মানুষের অনেক ধারণা হয়েছে। টাকা আসলেও বহুদিন ধরেই উড়ছিল। তাই বলে বাতাসে নয়, ক্যাসিনো তথা জুয়ার টেবিলে টেবিলে। প্রধানত র্যাবের মাধ্যমে টাকার সে ওড়াউড়ি কিছুটা হলেও বন্ধ করেছে সরকার। টাকা ‘বানানেওয়ালাদের’ জনাকয়েক ‘সম্রাট’, ‘মাফিয়া’, ‘টেন্ডার কিং’, ‘জুয়াড়ি’ ও ‘ডন’কে আটকও করা হয়েছে।

যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে ও হচ্ছে তাদের বাসা-বাড়ি, অফিস এবং ক্লাব ও ক্যাসিনোসহ বিভিন্ন আখড়া থেকে কেবলই কোটি বা লাখের অঙ্কে টাকা পাওয়া যাচ্ছে। সাধারণ ও দরিদ্র মানুষের কাছে ‘বিপুল পরিমাণ’ হিসেবে তুলে ধরা সম্ভব হলেও জনগণের সচেতন অংশ কিন্তু তেমন আশাবাদী হতে পারেননি। কারণ, এক মাসের মতো সময় পেরিয়ে গেলেও উদ্ধারকৃত টাকার মোট পরিমাণ এখনো হাজার কোটির ঘরেও পৌঁছায়নি। কোথাও উদ্ধার হয়েছে এক কোটি ৬৫ লাখ টাকা, গ্রামাঞ্চলের একটি জুয়ার আসর থেকে পুলিশ এমনকি ৫২৩ টাকা পর্যন্ত উদ্ধার করে চমকের সৃষ্টি করেছে!

অন্যদিকে বর্তমান সরকারের দশ বছরে শেয়ারবাজার এবং ব্যাংকের মতো দু-একটি মাত্র খাতেই জনগণ লক্ষ হাজার কোটি টাকার অঙ্কে অর্থ খুইয়েছে। এই তো মাত্র কিছুদিন আগে, গত ২৩ জুলাই একদিনেই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের লোকসান গুনতে হয়েছে চার হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা। শুধু তা-ই নয়, সুপরিকিল্পিতভাবে ঘটানো অবিশ্বাস্য দরপতনের ধারায় চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ১৫ দিনেই শেয়ারবাজার থেকে উধাও হয়ে গেছে ২৭ হাজার কোটি টাকা। উল্লেখ্য, আওয়ামী  মহাজোটের নেতা রাশেদ খান মেনন সম্প্রতি বলেছেন, গত ১০ বছরে দেশ থেকে ৯ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। অন্যদিকে উদ্ধার করা হচ্ছে এক-দেড় কোটি থেকে ৫২৩ টাকা পর্যন্ত!

কথা উঠেছে আসলে চমকে দেওয়ার মতো কিছু তথ্য-পরিসংখ্যানের পরিপ্রেক্ষিতে। অন্য কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান নয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে সম্প্রতি প্রকাশিত রিপোর্টে জানানো হয়েছে, দেশে কোটিপতিদের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এই সংখ্যা বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে, যাকে বিস্ময়কর না বলে উপায় নেই। কারণ, মাত্র এক বছরের ব্যবধানে কোটিপতিদের সংখ্যা বেড়েছে ৪ হাজার ৫১২ জন। বর্তমানে তাদের সংখ্যা ৭০ হাজার ৪৬৩। ২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত তথ্য-পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ব্যাংকে এক কোটি টাকা আমানত রয়েছে ৫৪ হাজার ৯৭০ জনের। ২০১৭ সালের মার্চ পর্যন্ত এই সংখ্যা ছিল ৫২ হাজার ৮৭। যার অর্থ, মাত্র এক বছরের মধ্যে এক কোটি টাকার বেশি আমানতকারীদের সংখ্যা বেড়েছে ২ হাজার ৮৮৩ জন। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে আরো দেখা গেছে, ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের কোটিপতি আমানতকারী ছিলেন ৬২ হাজার ৩৮ জন। কিন্তু পরবর্তী দেড় বছরে তাদের সংখ্যা ৮ হাজার ৪২৫ বেড়ে হয়েছে ৭০ হাজার ৪৬৩ জন। বিভিন্ন ব্যাংকে যে পরিমাণ আমানত রয়েছে তার প্রায় অর্ধেকই ৭০ হাজার ৪৬৩ জন কোটিপতির।

এভাবে কোটিপতিদের সংখ্যা লাফিয়ে বেড়ে চলার খবর নিঃসন্দেহে আশঙ্কাজনক। কারণ অর্থনীতিবিদসহ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, স্বাভাবিক অবস্থায় এমনটি হওয়া সম্ভব নয়। অনুসন্ধানে বরং দেখা যাবে, যারা কোটিপতি হয়েছেন তাদের প্রায় সকলেই দুর্নীতি এবং অসৎ পন্থার আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ঋণখেলাপিদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। বাস্তবে কোটিপতিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ঋণখেলাপিদের সংখ্যাও। স্মরণ করা দরকার, বছর দেড়েক আগে তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় সংসদে জানিয়েছিলেন, ওই সময় দেশে ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের সংখ্যা ছিল ২ লাখ ২ হাজার ৬২৩।

বলার অপেক্ষা রাখে না, কোটিপতিদের সংখ্যা ও তাদের দখলে থাকা অর্থের পরিমাণের পাশাপাশি খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার তথ্য-পরিসংখ্যানগুলো অত্যন্ত ভীতিকর। এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে আসলে দেশের অর্থনীতির নেতিবাচকতাই সামনে এসেছে। শিল্প-কারখানা স্থাপনসহ জাতীয় পুঁজির বিকাশ যেখানে সমৃদ্ধির প্রধান পূর্বশর্ত সেখানে একদিকে বিপুল পরিমাণ অর্থ কোটিপতিদের অ্যাকাউন্টে অলস পড়ে আছে, অন্যদিকে বেড়ে চলেছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ।

একযোগে বাড়ছে পাচারের পরিমাণও। কিছুদিন আগে, গত জুন মাসে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরে জানানো হয়েছে, ২০১৮ সালে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমানো অর্থের পরিমাণ বেড়েছে এক হাজার দুইশ কোটি টাকা। ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড-২০১৮’ শিরোনামে প্রকাশিত বার্ষিক রিপোর্টে হিসাবটি প্রকাশ করেছে সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস নাশনাল ব্যাংক। তথ্যগুলোর মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় সুইস ব্যাংক আসলে জানিয়েছে, বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনসহ রাজনৈতিক সংকটের সময় বাংলাদেশিরা সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বেশি পরিমাণে অর্থ জমিয়ে থাকেন। এর কারণ, দেশটির ব্যাংকগুলো সাধারণত অর্থ জমাকারীদের তথ্য গোপন রাখে। সরকার বা কোনো তদন্ত সংস্থার কাছে প্রকাশ করে না। সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের তেমন কোনো চুক্তি না থাকায় বাংলাদেশিদের জমানো অর্থের পরিমাণ অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় থেকে যায়।  

উল্লেখ্য, এবারই প্রথম নয়, এর আগেও বিদেশি ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমানো বা পাচার করা অর্থ সম্পর্কে রিপোর্ট ও তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এ বিষয়ে প্রথমে চমকের সৃষ্টি করেছিল ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই)। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৭ সালের মে মাসে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানিয়েছিল, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ছয় লাখ ছয় হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। আলোচ্য ১০ বছরে পাচার করা অর্থ দিয়ে বাংলাদেশের দুটি অর্থবছরের বাজেট তৈরি করা সম্ভব হতো বলেও ওই রিপোর্টে জানানো হয়েছিল। 

সেবার অর্থ পাচারের খবরটি প্রকাশিত হওয়ার পরই প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা একে অন্যের ওপর দোষারোপের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছিলেন। বিএনপিসহ কয়েকটি বিরোধী দল বলেছিল, আওয়ামী লীগের নেতারাই গোপনে টাকা জমা করেছেন, যাতে ক্ষমতায় পরিবর্তন ঘটলে তারা বিদেশে পালিয়ে যেতে এবং ওই টাকা দিয়ে আয়েশে জীবন কাটাতে পারেন। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরা বলেছিলেন, টাকা পাচারের রেকর্ড নাকি একমাত্র বিএনপির রয়েছে! অর্থাৎ বিএনপির নেতারাই টাকা জমিয়েছেন সুইস ব্যাংকে!

এভাবে আক্রমণ এবং পাল্টা-আক্রমণ চালিয়ে দোষারোপের রাজনীতি করা হলেও ঘটনাপ্রবাহে পরিষ্কার হয়েছিল, বর্তমান সরকারের আমলে দেশের ভেতরে যেমন কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে তেমনি কোটিপতিরা ছড়িয়ে পড়েছেন আন্তর্জাতিক পর্যায়েও। শুধু সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকেই নয়, তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, কানাডা ও জার্মানিসহ আরো কিছু দেশেও বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা করেছেন! এই অর্থের বেশিরভাগই যে অবৈধভাবে পাচার করা হয়েছে সে কথাটাও আলোচিত হয়েছিল বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে।

এমন এক অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই সকলের নজর পড়েছিল সরকারের দিকে। সরকার পাচারকারীদের চিহ্নিত করে কি না এবং তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় কি না তা দেখার জন্য সাধারণ মানুষও উন্মুখ হয়ে পড়েছিল। তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজেও এ বিষয়ে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করেছিলেন। সিলেটের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, টাকা পাচারের সঙ্গে ‘আমরাও’ অর্থাৎ ক্ষমতাসীনরাও জড়িত! মাত্র দিন কয়েকের মধ্যেই আবুল মাল আবদুল মুহিত অবশ্য সম্পূর্ণ ইউ-টার্ন নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আসলে বাংলাদেশ এবং সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকের মধ্যে ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। একে কোনোভাবেই ‘পাচার’ বলা যায় না।

বলা দরকার, যেহেতু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিসহ জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত সেহেতু অর্থ পাচারের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়কে হালকাভাবে নেওয়া কিংবা পাশ কাটিয়ে যাওয়া উচিত নয়। কারণ, কোনো দেশ থেকে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে যাওয়ার খবর নিঃসন্দেহে ভীতিকর। এমন অবস্থায় কর্তব্য যেখানে ছিল পাচার বন্ধ করার পাশাপাশি পাচারকারীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সরকার সেখানে উল্টো বিভিন্ন রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রকাশিত গণমাধ্যমের খবরগুলোকে ‘অতিশয়োক্তি’ বা মিথ্যাচার বলে চালানোর চেষ্টা করেছিল। এর ফলে পাচারকারীরা যে উৎসাহিত হয়েছে এবং অর্থের পাচার আরো বেড়ে গেছে সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ রিপোর্টই তার প্রমাণ। কারণ বাংলাদেশ এখনো এমন ‘উন্নত’ রাষ্ট্র হয়ে যায়নি, যার নাগরিকরা হাজার হাজার কোটি টাকা সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের ব্যাংকে ‘জমা’ রাখবেন এবং তাদের পরিচয়ও জানতে দেওয়া হবে না!

বলা দরকার, খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনার এবং পাচার বন্ধ করার পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের কবল থেকে রক্ষা করতে হলে সরকারকেই প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে। এজন্য ঘুষ-দুর্নীতির পথ থেকে সরে আসতে হবে, একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনার দিকেও নজরদারি বাড়াতে হবে। এমন আয়োজন নিশ্চিত করা দরকার, যাতে শিল্প স্থাপন বা ব্যবসা-বাণিজ্যের নামে অসৎ লোকজন ব্যাংক ঋণ না পেতে পারে এবং যাতে প্রকৃত শিল্প মালিক ও ব্যবসায়ীরা ঋণের অভাবে বাধাগ্রস্ত না হন। তাহলেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমে আসতে পারে।

কোটিপতিদের ব্যাপারেও সরকারকেই প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ এত বিপুল পরিমাণ অর্থ অবশ্যই স্বাভাবিক ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে ব্যাংকে জমা পড়েনি। পড়েছেও বছরের পর বছর ধরে। দুর্নীতি ও অবৈধ কারবার ছাড়া কোনো গোষ্ঠীর পক্ষেই এত অর্থ মজুদ করা সম্ভব নয়। সম্ভব আসলে হয়ওনি। বড় কথা, সবই সরকারের জানা রয়েছে। এজন্যই এমন ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, যাতে বিশেষ করে বিগত ১০ বছরের কোটিপতিরা তাদের অর্থ দেশের অভ্যন্তরে শিল্প-কারখানা স্থাপনসহ জাতীয় অর্থনীতির সমৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ করতে বাধ্য হন। তারা যাতে অর্থ পাচার করতে না পারেন সে ব্যাপারেও সরকারকে কঠোর নজরদারি করতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে সততার সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হলে একদিকে দেশে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপিত হবে, অন্যদিকে বহু মানুষের জন্য চাকরিরও সুযোগ সৃষ্টি হবে। এভাবেই স্থবিরতা কাটিয়ে জাতীয় অর্থনীতি সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারে। 

 

লেখক : সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads