• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
ডিজিটাল ডিভাইস ও আজকের শিশু

সংগৃহীত ছবি

মতামত

ডিজিটাল ডিভাইস ও আজকের শিশু

  • প্রকাশিত ১৯ অক্টোবর ২০১৯

আজকের শিশুকে বলা হচ্ছে যন্ত্রশিশু। একুশ শতকের এসব শিশু জন্মের পর থেকেই নানারকম ডিজিটাল ডিভাইস তথা স্মার্ট ফোন, ল্যাপটপ, কম্পিউটার ইত্যাদির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। সেই ছোটবেলা থেকে এসবের প্রতি তাদের বাড়ছে আসক্তি ও চাহিদা। কিন্তু এটা কতটা যুক্তিযুক্ত? এ প্রশ্ন ভাবার সময় এসেছে।

ইন্টারনেটের প্রতি শিশু-কিশোরদের মাত্রাতিরিক্ত আসক্তিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বহু আগেই মানসিক রোগের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। ২০১৬ সালে ইউনিসেফ রিপোর্ট বলছে, বিশ্বে প্রতি তিনজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর একজন শিশু। কী ভয়ানক তথ্য! বিষয়টি নজরে নিয়ে ইংল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশ বিশেষ ক্লিনিক স্থাপনের পাশাপাশি পর্যাপ্ত মনিটরিং শুরু করেছে। জাপানে যদি কেউ একটি নির্দিষ্ট সময়ের বেশি গেম খেলে তাকে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় সরকারের আইন অনুযায়ী ১৬ বছরের কমবয়সী শিশুরা মধ্যরাত থেকে ভোর ছয়টা পর্যন্ত অনলাইন গেম খেলতে পারে না। চীনের ইন্টারনেট প্রতিষ্ঠান টেনটেন্ট শিশুদের গেম খেলার সময় বেঁধে দিয়েছে। বাংলাদেশে এ ক্ষেত্রে সচেতনতা এখনো তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি।

এক গবেষণার ফলাফল বলছে, যেসব শিশু-কিশোর দৈনিক ৫ ঘণ্টার বেশি ট্যাবলেট, স্মার্টফোন, টেলিভিশনের মতন ডিজিটাল ডিভাইস নিয়ে সময় অতিবাহিত করে তাদের স্থূলকায় বা মোটা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। যে শিশু-কিশোর এগুলো ব্যবহার করে না, তাদের তুলনায় ৪৩% বেশি। সুতরাং শিশু-কিশোরদের টেলিভিশন এবং অন্যান্য স্ক্রিন ডিভাইস ব্যবহারের সময়সীমা সীমিতকরণ অত্যন্ত জরুরি। কমবয়সী শিশু-কিশোরদের মধ্যে স্ক্রিন অ্যাডিকশন দ্রুতগতিতে বাড়ছে। তাদের মধ্যে বাইরে বেড়াতে যাওয়া, আউটডোর খেলাধুলা করা, গল্প করা, মুখোমুখি ইন্টার অ্যাকশন ইত্যাদি মারাত্মকভাবে কমে যাচ্ছে। বিশ্বখ্যাত ডিজিটাল প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস, অ্যাপলের বর্তমান চিফ অপারেটিং অফিসার টিম কুক, মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস, ফেসবুকের প্রথম চেয়ারম্যান সিয়ান পারকার, ফেসবুকের সাবেক এক্সিকিউটিভ অ্যাসিস্ট্যান্ট আথেনা শাভারিয়াসহ সবাই শিশু-কিশোরদের ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারের ভয়াবহতা নিয়ে যারপরনাই চিন্তিত। ডিজিটাল প্রযুক্তিবিদ, কম্পিউটার প্রোগ্রামার ও উদ্যোক্তাদের একটা বিরাট অংশ নিজেদের তৈরি করা ডিজিটাল যন্ত্র ও অ্যাপ থেকে নিজেদের সন্তানদের দূরে রাখার চেষ্টা করছেন।

সিলিকন ভ্যালির ৯০০-এর বেশি পরিবার শিশু-কিশোরদের স্ক্রিন আসক্তি কমাতে তৎপর হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশেও আমরা আমাদের শিশু-কিশোরদের নিয়ে কঠিন সময় পার করছি। আমাদের উচিত শিশুদের মস্কিষ্কের সচেতনতা বাড়ানোর ব্যাপারে অনেক বেশি সচেতন হওয়া। একদিন দুদিনেই সুফল পাওয়া সম্ভব হবে না। সুফল পেতে হলে ধীরে ধীরে লক্ষ্যে এগোতে হবে। সন্তানদের বকাঝকা না করে, বরং তাদের ডিজিটাল স্ক্রিনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের কুফল সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিতে হবে। অতিরিক্ত সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ভার্চুয়াল গেম বা ইউটিউবে না কাটানোর জন্য পুরস্কৃত করলে তাদের ভালো লাগতে পারে। সন্তানের সঙ্গে সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ধরে রাখতে হবে। তাদের নিয়ে বাইরে বেড়াতে যেতে হবে। বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের বাসায় নিয়ে তাদের শিশুদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। তাদের নিয়ে পারিবারিক, সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হবে।

শিশুদের বারবার উপদেশ দিলে তারা বিরক্ত হয়। তাদের বিরক্ত না করে নিজেকে এমনভাবে সন্তানের সামনে উপস্থাপন করতে হবে যাতে শিশু আপনার সুন্দর কাজে অনুপ্রেরণা পায়। নিজেকে ভার্চুয়াল লাইফে জড়িয়ে রেখে শিশুকে নিষেধ করলে তা শিশুর মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলবে, এটা মনে রাখতে হবে। নিজে ধর্ম পালন করে শিশুকে ধর্ম পালনে দীক্ষা দিতে হবে। সামাজিক ভালো এবং সেবামূলক কাজগুলোতে নিজের সঙ্গে সন্তানকে সংযুক্ত করলে সন্তানও ভালো কাজ করতে উৎসাহিত হবে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ বাড়াতে হবে। তাদের মদ্যে বই পড়ার আনন্দ তৈরি হয়, এমন উপযোগী বই পড়তে দিতে হবে। বই পড়া শেষ হলে গল্পচ্ছলে কী পড়ল তা আগ্রহ নিয়ে শুনতে হবে। বই পড়ার জন্য ছোটখাটো পুরস্কার পেলে নতুন বই পড়ায় আরো বেশি উৎসাহী হবে।

আমরা শিশুদের ঘরবন্দি করে ফেলেছি। ইট-পাথরের চার দেয়ালে তাদের আবদ্ধ জীবন থেকে বের করে আনতে হলে খেলার মাঠের কোনো বিকল্প নেই। শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত খেলার মাঠের ব্যবস্থা করা সময়ের অন্যতম দাবি। শিশুরা যদি খোলা আকাশের নিচে খোলা মাঠে ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, কাবাডি, ভলিবল, কানামাছি, দাঁড়িয়াবান্ধাসহ আরো অনেক খেলার সুযোগ পায় তাহলে তাদের শরীর মন চাঙা হবে এবং তারা নিজ থেকেই ধীরে ধীরে প্রযুক্তির অতিরিক্ত আসক্তি থেকে সরে আসবে।

পরিবার এবং রাষ্ট্রের সম্মিলিত প্রয়াসে ইন্টারনেটের ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে শিশু-কিশোরদের রক্ষা করা অন্যতম প্রয়োজনীয় কর্তব্য। আমাদের শিশুদের অথর্ব করে গড়ে তুললে জাতি একটি প্রতিবন্ধী ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পাবে, যা পরিবার তথা দেশের জন্য ভয়াবহ পরিণাম বয়ে আনবে। শিশুদের অবশ্যই প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচয় থাকতে হবে, এর ব্যবহার জানতে হবে; তবে তা যেন তাদের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠায় হুমকি হয়ে দেখা না দেয়।

শিশুর বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তার উপযোগী খেলাধুলার সঙ্গে তাকে পরিচয় করানো উচিত হবে। এ ক্ষেত্রে পরিবারকে একটু সময় দিয়ে সন্তানকে ভ্রমণে নিয়ে যেতে হবে। মোদ্দা কথা বয়সের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ধীরে ধীরে তাকে ডিজিটাল ডিভাইসের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে, যাতে সে এর ব্যবহারের যথার্থতা উপলব্ধি করতে পারে। 

শাহীন চৌধুরী ডলি

লেখক : প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads