• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
তৃণমূলের রাজনীতি রাজনীতির তৃণমূল

প্রতীকী ছবি

মতামত

তৃণমূলের রাজনীতি রাজনীতির তৃণমূল

  • রায়হান উল্লাহ
  • প্রকাশিত ২৩ অক্টোবর ২০১৯

রাজনীতি একটি গূঢ় বিষয়। রাজনীতি এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কিছু ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত কোনো গোষ্ঠী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। রাজনীতি কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার ভিত্তিতে সামাজিক সম্পর্ক নিয়ে গঠিত। সাধারণ মানুষ রাজনীতিকে রাজার নীতি বললেও কর্তৃত্ব, ক্ষমতা ও সামাজিক সম্পর্কের প্রশ্নে তারা এসে যায়। এ ছাড়া গণতন্ত্রে জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। সেই হিসেবেও রাজনীতিতে সাধারণ মানুষ থাকে।

মূলত রাজনীতি কেন্দ্র থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু এর সামগ্রিক সব তৃণমূলে লুকায়িত। বাংলাদেশ মূলত গ্রামেরই সমষ্টি। সেই হিসেবে সকল তৃণমূল সংগঠিত হয়েই রাজনীতির মেরুকরণ হয়। তৃণমূলের রাজনীতি বলতে আমরা বুঝি দেশের সব প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা রাজনীতি। আর রাজনীতির তৃণমূল বলতে সাধারণত রাজনীতির গ্রামীণ পটভূমি বোঝানো হয়।

রাজনীতি নামক রাজার নীতির জন্য জনগণ প্রয়োজন। আর এ জনগণ বাংলাদেশের ৮৭ হাজার ৩১৯টি গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। তাদের দ্বারাই, তাদের স্বার্থেই নেতৃত্ব বাছাই ও গঠন হয়। তৃণমূলের ভোটে পাস করে এক একজন রাজনীতিবিদ দেশের হয়ে কাজ করেন।

এমনই প্রেক্ষাপটে আমরা সব সম্ভবের বাংলাদেশকে দেখি। এখানে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা অগুনতি। সবাই তৃণমূল বা জনগণের কল্যাণের কথা বলে। কিন্তু নিজেদের গঠনতন্ত্রের সুনির্দিষ্ট কাঠামো দিতে পারে না। সব দল কথায় চায় তৃণমূল থেকে উঠে আসা নেতৃত্ব; কিন্তু চিন্তা ও বাস্তবে বিস্তর ফারাক। হরহামেশা দেখা যায় তৃণমূলের চিন্তা মূল্যায়ন পায় না। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখলে যে কোনো দলের কিছু ধাপ পেরিয়ে মূল নেতৃত্বে আসার কথা। বাস্তবতায় দেখা যায় সংগঠনের তৃণমূলের এ ভাবনা প্রাধান্য পায় না। দৈবিক লাভের বশবর্তী হয়ে তৃণমূলের চিন্তা-ভাবনাকে উপেক্ষা করে অনেক ব্যবসায়ী-আমলাকে তৃণমূলের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়। তিনি হয়ে যান নব্য রাজনীতিক। নিয়ন্ত্রণ করেন দলের একটি বৃহৎ অংশ। কিনে নেন জনপ্রতিনিধি হওয়ার সনদ। একসময় তিনি সংসদ সদস্য হন। আর এভাবেই সঠিক, যোগ্য ও পরীক্ষিত নেতৃত্ব ক্ষোভ ও ঘৃণার বশে হারিয়ে যায়। এভাবেই রাজনীতির কেন্দ্র ও তৃণমূলে সংঘাত সৃষ্টি হয়।

এ ছাড়া রাজনীতির কেন্দ্র ও তৃণমূলে আরেকটি সংঘাত কাজ করে। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে সব রাজনীতিক কেন্দ্রকেই মনে করে। এটিও রাজনৈতিক দলের একটি ভুল শিক্ষা। ক্ষমতা বা রাজনীতির মূল কেন্দ্র তৃণমূলই। যুগের ভুল পরিচালনায় প্রায়ই এটি অসত্য ঠেকে। তৃণমূল অগোছালো হলে কেন্দ্র কখনো শক্তিশালী আকার পায় না। অথচ সবাই ছোটেন কেন্দ্রে। উপেক্ষিত থাকে তৃণমূল।

যে কোনো দল থেকে জনপ্রতিনিধি হতে গেলে তৃণমূলে জনপ্রিয় ও পরিচিত হতে হয়। কিন্তু জনপ্রতিনিধি হয়ে গেলেই তারা মিথ্যে মরীচিকার পেছনে ছোটেন। এ থেকেই বাংলাদেশে যুগ-যুগের স্যাটায়ার সৃষ্টি— ভোটের আগে জনপ্রতিনিধি ছোটেন ভোটারের দ্বারে দ্বারে, আর ভোটের পরে ভোটার ছোটেন জনপ্রতিনিধির দ্বারে দ্বারে। এ প্রহসনের বাক্য থেকেই বাংলাদেশের তৃণমূলের রাজনীতি ও রাজনীতির তৃণমূলের একটি সবিস্তার ধারণা পাওয়া যায়।

প্রতিটি রাজনৈতিক দলই গ্রামবাংলার মানুষের কাছে নিজেকে জনপ্রিয় বলে দাবি করে। কিন্তু তারা পরিসংখ্যানের বাইরে গিয়ে তৃণমূলে তাদের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করে না। অবশ্য সবাই দাবি করে তৃণমূল যাচাই করেই এক একজন প্রার্থীকে জনপ্রতিনিধি হওয়ার মনোনয়ন দেওয়া হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ যাচাই ভুল। হয়তো দলের কোনো বৃহৎ অংশের মত নেওয়া হয়। এটি কখনো তৃণমূলের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি হতে পারে না। এমন যদি হতো, তবে কখনো কোনো বৃহৎ দলের প্রার্থীর ভরাডুবি হতো না। এমনকি বিগত সরকারেরও ভরাডুবি হতো না। উভয় ক্ষেত্রেই দলটি তৃণমূল থেকে অনেক দূরে চলে যায়। তারা কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে ও এমনতর খেটে খাওয়া মানুষের মনের ভাষা পড়তে পারে না।

সচরাচর একটি কথা প্রচলিত আছে, এ দেশের জনপ্রতিনিধিরা ভোটে জেতার পর যাবতীয় ভুলে যান। এ কথা দলগুলোর ক্ষেত্রেও বলা যায়। তারা ভোটে জেতার পর তৃণমূলের সুর বুঝতে চায় না বা বুঝতে পারে না। তৃণমূল যা থাকার তাই থাকে। তৃণমূলের প্রতিটি কর্মী মনের গোপন ভালোবাসা থেকে দল করে যান। অনেক ক্ষেত্রে তারা আঘাতপ্রাপ্ত হন। বিপক্ষ দলের হামলা-মামলার শিকার হন। কোনো কোনো সময় নিজ দলের অনেককে পাশে পান না। তারপরও তারা ভালোবাসার জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে দলকে ভালোবেসে যান।

প্রায়ই দেখা যায় তৃণমূলের ওইসব ত্যাগী মানুষের একটিই অনুযোগ, সারা জীবন রাজনীতি করেও মূল্যায়ন না পাওয়ার। ঠিক বিপরীতে আমরা দেখি মৌসুমি রাজনীতিবিদদের দাপট। তারা উড়ে এসে জুড়ে বসে সব বাগিয়ে নেন। একসময় দল তাদের ক্ষতি বইয়ে বেড়ায়। বলা যায় তৃণমূল বা সত্যিকারে কর্মীরা বয়ে বেড়ান। মৌসুমি রাজনীতিবিদরা কিছু না বাগাতে পারলে অন্য দলে ভিড় করেন। সব সময় দলের হাল ধরেন তৃণমূল বা সত্যিকারের কর্মীরাই। অথচ তাদের বোঝার মতো কেউ নেই। এর ফলেই ইতিহাসের যত ভরাডুবি। এর থেকেও শিক্ষা নেওয়া হয় না দলগুলোর। যদিও ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নিলেও ইতিহাস তার শিক্ষা ঠিকই দিয়ে দেয়।

আর এ শিক্ষার ফলই কি বয়ে বেড়াচ্ছে না বর্তমান রাজনীতি? এখন অধিকাংশ মানুষই রাজনীতিবিমুখ। এর কারণও দলগুলোর বা রাজনীতিকের তৃণমূলের ভাষা না বোঝা। সচরাচর দৈবিক লাভ ছাড়া কেউ রাজনীতির ময়দানে পা বাড়ান না। এতে কি বলা যায় না রাজনীতি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে? যদিও প্রতিটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। রাজনীতি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বলা যায় যখন মানুষ রাজনীতির সুফল না ভোগ করে এর শিকার হয়। বর্তমান অবস্থাদৃষ্টে আপনিই ভালো জানেন, আপনি রাজনীতির শিকার না ফল ভোগ করছেন?

 

লেখক : কবি ও সাংবাদিক

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads