• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
ভিন্নমত গণতন্ত্রের সৌন্দর্য

প্রতীকী ছবি

মতামত

ভিন্নমত গণতন্ত্রের সৌন্দর্য

  • আফরোজা পারভীন
  • প্রকাশিত ২৮ অক্টোবর ২০১৯

থেমে যাচ্ছে কলম। লিখতে পারছি না। বুকের ভেতরটা কেমন যেন হু হু করে উঠছে। ইচ্ছে করছে এক দৌড়ে চলে যেতে কুমারখালীর সেই গ্রামে যেখানে আবরার হামাগুড়ি দিয়েছে, হেসেছে, খেলেছে, বাবার কাঁধে চড়ে মেলায় গেছে, রংবেরঙের ঘুড়ি উড়িয়েছে, সাঁতার কেটেছে।

আমি একজন মা। আমি এক মায়ের সন্তান, আমার দুটি সন্তান আছে। বড় কষ্টে, বড় যত্নে ওদের মানুষ করেছি। ওদের বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকেছি পথের দিকে চেয়ে। উৎকণ্ঠিত হয়ে বার বার ভেতর-বার করেছি। কখন ওরা আসবে, দেরি হচ্ছে কেন, কোনো অসুবিধা হলো কিনা, পথে কোনো দুর্ঘটনা! নিজের আয়ুুর বিনিময়ে সন্তানদের আয়ু কামনা করেছি। আজো করি। আমার মা-বাবাও একইভাবে উৎকণ্ঠিত থেকেছেন।

একটি সন্তান যখন ভ্রূণ আকারে মাতৃগর্ভে আসে তখন থেকেই স্বপ্ন বোনা শুরু হয় তার বাবা-মায়ের। সন্তান যেন সুস্থভাবে জন্ম নেয়, সুস্থভাবে বেড়ে ওঠে, ও যেন পড়াশোনায় ভালো হয়, যেন মানুষের মতো মানুষ হয়। কোনো বাবা-মাই চায় না তার সন্তান খারাপ মানুষ হোক। কাপুরুষ হোক বা অমানুষ হোক। পৃথিবীর সব চেয়ে খারাপ বাবা-মাও তা চায় না। বরং খারাপ বাবা-মা চায় তাদের খারাপ দিকটা যেন সন্তানের মধ্যে সংক্রমিত না হয়।

সাহসী হওয়া, সৎ হওয়া মানে সত্য কথা বলার, ভিন্নমত প্রকাশ করার সাহস অর্জন করা। যে সৎ তার সত্য কথা বলার সাহস থাকে। যে ন্যায়ের পথে চলে, তার সত্য কথা বলার সাহস থাকে। আর স্বাধীন দেশে সত্য কথা বলার, ভিন্নমত পোষণ করার সাহস থাকবেই না কেন? সত্য কথা সোচ্চারে বলব, স্বাধীনভাবে বলব, নিজের মত নির্ভয়ে প্রকাশ করব বলেই তো অনেক রক্তে কেনা এই স্বাধীনতা।

আবরার গ্রামের মেধাবী ছেলে। দেশের এমন কোনো শিক্ষায়তন নেই যেখানে সে চান্স পায়নি। চান্স পেয়েছিল বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়েও। ভর্তি হয়েছে বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগে। দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল সে। থাকত শেরে বাংলা হলের নিচতলার ১০১১ নম্বর কক্ষে। সেই হলের সিঁড়ির নিচ থেকে উদ্ধার করা হলো পিটিয়ে মারা আবরারের মৃতদেহ। উদ্ধার করা হলো বুয়েট নামের সেই শিক্ষায়তনের ছাত্রকে, যেখানে নাকি দেশের সর্বোচ্চ মেধাবী ছাত্ররা পড়ে।

আবরার মাত্র ৮ ঘণ্টা আগে বাড়ি থেকে ফিরেছিল মায়ের আদর খেয়ে, বাপের দোয়া নিয়ে। কিন্তু মায়ের আদর বাপের দোয়া তাকে রক্ষা করতে পারল না। পারবে কী করে? একদল নেকড়ের সামনে ও সামান্য একটা হরিণ শাবক মাত্র।

আবরারের অপরাধ সে ফেসবুকে একটা পোস্ট দিয়েছিল। সে পোস্টে নাকি দেশবিরোধী কিছু লিখেছিল। কী লিখেছিল? কতটা দেশদ্রোহিতা সে করেছিল? আর যদি করেই থাকে তার জন্য বিচার আছে। দেশের প্রচলিত আইন আছে, তথ্যপ্রযুক্তি আইন আছে। সরকার বা সরকারের তরফে যে কেউ মামলা করতে পারে। মামলা করতে পারে পুলিশ। কিন্তু ছাত্রলীগ এখানে কে? তারা কোন কোর্টের বিচারক, কোন শ্রেণির বিচারক?

বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলছে বছরের পর বছর। এক নেতা আরেক নেতাকে অপমান করছে, একদল আরেক দলকে বিতাড়িত করছে। প্রতিনিয়ত খুন-জখম হচ্ছে। দেখে দেখে ছাত্ররা শিখছে। ওরা ভাবছে এটাই নিয়ম। আইন নিজের হাতে তুলে নিলে কোনো অপরাধ হয় না। বরং দায়মুক্তি ঘটে। এটা তাই বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। দেশের কলুষিত রাজনীতির এক ভগ্নাংশ!

আবরার হত্যার পর সিসিটিভি ফুটেজ দেখে শনাক্ত করে যে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তারা সবাই ছাত্রলীগ কর্মী (ভাগ্যিস সিসিটিভি ফুটেজ ছিল)। এ ঘটনায় মহসিন হল থেকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে দুজনকে। তারাও ছাত্রলীগের। হলের প্রশাসনসহ সবাই জানত তারা সন্ত্রাসী। তারপরও বড় স্নেহে জামাই আদরে লালন-পালন করা হচ্ছিল তাদের। মৌমাছির চাকে ঢিল পড়ার পর তাদের হল থেকে গ্রেপ্তার করা হলো। ভাবখানা এমন যেন ঘটনাটা এইমাত্র জানা গেল। ধিক্ ধিক্ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন! কেউ বলেন চা-শিঙ্গাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য, কেউ ছাত্রলীগকে চাঁদা দেন, কেউ দিনে ২৭ হাজার টাকা চায়ের বিল মেটান, আবার কেউ তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মারা যাওয়ার পর তার জানাজায় হাজির হন না। এই এদের যোগ্যতা! এটাই এদের প্রশাসন! বেছে বেছে কী এদেরই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বানাতে হয়! এরা দলের লোক বলে! এরা যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক হয় এদের কাছ থেকে ছাত্ররা দুর্নীতি, তেলবাজি, দলকানাবাজি, তোষামোদী ছাড়া আর কী শিখবে!

একটা তরতাজা ছেলেকে দুই-তিন ঘণ্টা ধরে পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলল। কেউ দেখল না, কেউ শুনল না? ছেলেটা নিশ্চয়ই চিৎকার করেছিল, আর্তনাদ করেছিল! একজন মানুষও এগিয়ে এলো না? যদি ভয়ে এগিয়েও না আসে তারা কেউ প্রশাসনকে জানালো না, পুলিশকে খবর দিল না! পুরো হলের ছাত্ররাই কী অমানুষ হয়ে গেছে, নাকি ছাত্রলীগ তাদের কণ্ঠ এমনভাবেই রোধ করে রেখেছে যে স্বাভাবিক বিবেকবোধ প্রয়োগ করার সাহস তারা হারিয়েছে জীবনের ভয়ে! আবরারের সারাটা পিঠ, সারাটা শরীর রক্তাক্ত। একাত্তরে যে নেকড়েদের বিতাড়ন করার জন্য আমরা অস্ত্র ধরেছিলাম, তারা কি এতটা নৃশংস ছিল! তারা তো ছিল ভিনদেশি। ভিন জাতি সংস্কৃতির। তারা কি এতটা বর্বর ছিল! তারা ছিল প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী, নিষ্ঠুরতা তাদের প্রশিক্ষণের অংশ ছিল। তারপরও তারা কি এতটা নির্দয় ছিল? না, পাকিস্তানিদের পক্ষে বলছি না আমি, বলতে পারি না। আমার নিজের ভাই শহীদ। আমার ভাইকে পাকিস্তানিরা জিপের চাকায় বেঁধে পুরো পিরোজপুরের এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা দিয়ে ফুলস্পিডে জিপ চালিয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় বলেশ্বরের পাড়ে নিয়ে গুলি করেছিল। ভাইয়ের সারা শরীর দিয়ে তখন রক্ত ঝরছিল। আমার ভাই পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ছিল, মুক্তিযোদ্ধা ছিল। তাদের দৃষ্টিতে দেশদ্রোহী। আদর্শের জন্য লড়েছিল। পাকিস্তানিদের বিপক্ষ শক্তি ছিল। কিন্তু আবরার কার বিরুদ্ধে কাজ করেছিল? কোন মহা অপরাধ করেছিল? স্বজন হারানোর বেদনা আমি বুঝি।

এ দায় বুয়েট প্রশাসন এড়াতে পারে না; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, রাজনীতিবিদ কেউ এড়াতে পারেন না। কোনোভাবেই পারেন না। আর আবরারের মৃত্যু নিয়ে যারা রাজনীতি করছেন তাদের বলি, আপনারা আবরারকে নিয়ে রাজনীতি করবেন না। তাকে সরকারের ভারত সফরের পর প্রথম শহীদ বানাবেন না। এ-জাতীয় শহীদ হওয়ার কোনো ইচ্ছে তার ছিল না। থাকলে সে রাজনীতি করত, রাজনীতিকরা ছাত্রদের হাতে জীবন দিত না।

ফেসবুকে একটা পোস্ট লেখাই কি আবরারের অপরাধ। নাকি আরো কিছু আছে নেপথ্যে! আবরারের মেধা কি ছাত্রলীগের কারো কারো অসুবিধার কারণ হচ্ছিল? ওকে সরিয়ে দিলে তাদের সুবিধা হতো নাকি? আবরার নাকি শিবির! এদেশে যুদ্ধাপরাধীর যেমন বিচার হয়েছে, তেমনি সরকারের চারপাশে অনেক যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-শিবির ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা অতিকৌশলে ভোল বদলে আওয়ামী লীগে ঢুকে পড়েছে। সরকারের কাছের লোক হয়ে গেছে। তাদের এই ভোলবদল যে সরকারের অজানা তাও নয়। আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহ্যবাহী পুরনো দল। যে কেউ কি তাদের দলে ঢুকতে পারে? কোনো স্ক্যানিং পদ্ধতি নেই? যারা পার্টির জন্য সত্যিকারে জীবন দেয় তারা আওয়ামী লীগ অফিসের বারান্দায়ও যেতে পারে না। আর যারা সারাজীবন এ-দল সে-দল করে সর্বদলীয়— তারা আজ বড় বড় নেতা, বড় বড় মন্ত্রী।

গত শতাব্দীর ষাটের দশকে মেধাবী ছাত্ররা রাজনীতি করত। পরস্পরের রাজনৈতিক বিশ্বাসের প্রতি তাদের সহনশীলতা ছিল। নোংরামি ছিল না। বুয়েটের এই ছাত্রগুলো মেধাবী ধরে নিচ্ছি। ধরে নিচ্ছি তারা লীগের টিকিটে ঢোকেনি। তাহলে তারা কেন এমন বর্বর! নেতাদের দেখে, তাদের শিক্ষায়, আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে! ভিসি সাহেব উপরের সঙ্গে কথা বলায় এতই ব্যস্ত যে, তিনি আবরারের জানাজায় যেতে পারলেন না। এমনকি উত্তাল ক্যাম্পাসে ছাত্রদের সামনেও আসতে পারলেন না কয়েক ঘণ্টা। যখন এলেন আবরারের জন্য কোনো দুঃখবোধ তার চেহারায় দেখলাম না। বরং তিনি বলে গেলেন ছাত্রদের দাবির প্রতি একমত হলেও তিনি একক সিদ্ধান্তে সব দাবি মানতে পারছেন না। কেন পারছেন না? এমন কোনো দাবি ছাত্ররা করেনি তিনি যা মানতে পারেন না। পারেনই না যখন পদত্যাগ করেন না কেন?

মন্ত্রী সাহেবরা অমন চমৎকার করে হেসে হেসে কী করে বিবৃতি দিচ্ছেন তাও বুঝতে পারছি না। তাদের ছেলেমেয়েরা বিদেশে পড়াশোনা করে বলে! ব্যথানাশক ওষুধ খাইয়ে খাইয়ে তিন দফা বেধড়ক পিটিয়ে হত্যা করা হলো আবরারকে। এমন দেখা যায় হরর মুভিতে। তারপরও আমাদের মন্ত্রী সাহেবদের ঝকঝকে মুখে হাসি!

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেও একজন মা। পুরো পরিবার হারিয়েছেন। তিনি জানেন স্বজন হারানোর বেদনা। তিনি জিরো টলারেন্সের কথা বলেন। এবারো তিনি কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন, কেউ ছাড় পাবে না। ধরাও পড়েছে অনেক আসামি। তাদের রিমান্ডও হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক এটাই যে, ধরা পড়ার পর এদের কী হয় আমরা জানতে পারি না। কিন্তু দেশবাসীর অধিকার আছে এই খুনিদের প্রতিদিনের খবর জানার। এ দেশে আজ পর্যন্ত একটিও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলো না। নয়ন বন্ডদের মতো ক্রসফায়ারে দিলে অনেক সত্যই আড়ালে চলে যায়। তাই দ্রুত বিচারের মাধ্যমে খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেখতে চাই আমরা। আমরা চাই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। হোক সেটা ভিন্নমত। ভিন্ন মত ভিন্ন চিন্তাই তো গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।

লেখক : কথাশিল্পী, সাবেক যুগ্ম সচিব

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads