• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
পঞ্চগড় : পর্যটন শিল্পের নতুন সম্ভাবনা

সংগৃহীত ছবি

মতামত

পঞ্চগড় : পর্যটন শিল্পের নতুন সম্ভাবনা

  • রহিম আবদুর রহিম
  • প্রকাশিত ২৯ অক্টোবর ২০১৯

বাংলাদেশের সবচেয়ে উত্তরের জেলা পঞ্চগড়। ধারণা করা হয়, এ অঞ্চলে অবস্থিত পাঁচটি গড়— ভিতরগড়, মিরগড়, রাজনগড়, হোসেনগড় ও দেবনগড় নিয়ে পঞ্চগড় জেলা গড়ে উঠেছে। সবথেকে উত্তরের জেলা হওয়ায় এর প্রাকৃতিক পরিবেশও বিচিত্র। হিন্দু, মুসলিম, ওঁরাও, সাঁওতাল, পলিয়া, কোচ ও রাজবংশীয় ধর্ম-বর্ণের জনবসতির পঞ্চগড়। ১ হাজার ৩১৮টি গ্রাম নিয়ে গঠিত পঞ্চগড়ের মোট আয়তন ১৪৯৫.৬৯৭ বর্গ কিলোমিটার। ২০১১ সালের হিসাব অনুযায়ী জেলার মোট জনসংখ্যা ১০ লাখ ৫০ হাজার ১৪ জন। বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী যার সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। পঞ্চগড়ের প্রশাসনিক দপ্তর পাঁচটি। এর মধ্যে পঞ্চগড় সদর, বোদা, তেঁতুলিয়া, আটোয়ারী ও দেবীগঞ্জ। হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত পঞ্চগড়ের প্রাকৃতিক দৃশ্য প্রকৃতিপ্রেমীদের আকৃষ্ট করবেই। নদীমাতৃক বাংলাদেশের ৩০১টি (প্রায় বিলুপ্ত) নদীর মধ্যে ৩৩টি নদীই পঞ্চগড়ের ঐতিহ্য বহন করে আসছে। সবুজ শ্যামলে ঘেরা পঞ্চগড়ের তিন দিকেই ভারতের সীমানা। দক্ষিণ দিকে অবারিত বাংলার বিশাল রাজ্য। ‘চোঙ্গা’ আকৃতি, নদ-নদীর সমাহার, সবুজ শ্যামল ঘেরা পঞ্চগড় যে বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ অতিথিশালা এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই ভূখণ্ডের জনমানুষ শান্ত-নিরীহ এবং মার্জিত স্বভাবের। এখানকার কৃষ্টি-কালচার দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে ভিন্ন। আজ থেকে প্রায় আড়াইশ বছর আগে অঞ্চলটি বেলুয়াভূমি নামে পরিচিত ছিল। কালের আবর্তে, সময়ের ব্যবধানে এই জনপদ ‘পঁচাগড়’ থেকে পঞ্চগড়ে রূপ নেয়। কাশ্মীর যেমন পৃথিবীর ভূ-স্বর্গ তেমনি পঞ্চগড় বাংলাদেশের ভূ-স্বর্গ। এই স্বর্গে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী রয়েছে প্রায় ১০ হাজার। তবে সরকারি হিসাব অনুযায়ী যার সংখ্যা ৬ হাজার ৯৪০ জন। প্রায় ১৪ লাখ অধিবাসীর বাসস্থানের কৃষ্টি-কালচারেও রয়েছে অফুরন্ত ব্যঞ্জনা। কারণ আজ থেকে ১৫শ বছর আগে অঞ্চলটি শাসন করত মহারাজ বংশীয় শাসকরা। পরবর্তী সময়ে এই জনপদে সম্ভবত কোনো একসময় ভূমিকম্পন ঘটায় প্রকৃতির আদল, আচার-আচরণ, কৃষ্টি-চালচার, নৃ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের কয়েক ধাপ পরিবর্তন ঘটেছে। সময়ের ঘূর্ণায়নে এই অঞ্চলে তৎকালীন উপমহাদেশের বিভিন্ন এলাকার মানবসম্পদ আপদে-বিপদে জীবন-জীবিকা রক্ষায় পঞ্চগড়ের শান্ত প্রকৃতিতে আবাসন গাড়ায় আস্তে আস্তে মিশ্র সংস্কৃতির অপূর্ব পঞ্চগড়ের বিনির্মাণ ঘটে। যে কারণে হিমালয় কন্যা পঞ্চগড়ের সংস্কৃতি অন্য দশটি অঞ্চলের চেয়ে ব্যতিক্রম ও সমৃদ্ধ।  

হিন্দু-মুসলিমসহ ৭টি ধর্মের মানব সভ্যতায় সৃষ্ট সংস্কৃতির মধ্যে মাছ ধরা, জাল বুনন, মাটির হাঁড়িপাতিল তৈরি, হাঁস-মুরগি পালন, বাঁশ-বেতের কাজই ছিল এ অঞ্চলের জীবন-জীবিকা অর্জনের অন্যতম সংস্কৃতি। পরে কৃষি সংস্কৃতি শুরু হয় চিনা কাউন, ভুট্টা এবং পয়রা চাষের মধ্য দিয়ে। কৃষি সংস্কৃতি কয়েক ধাপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে হচ্ছে ধান, গম, আখ, ভুট্টা, ডাল, চিনাবাদাম, তরমুজ, কমলালেবু, স্ট্রবেরিসহ উন্নত ফল ও ফসল। কর্মে যুক্ত হয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদ, পাথর-বালি আহরণ। গড়ে উঠেছে মিল ও ফ্যাক্টরি। সবুজ ঘেরা সমতল পঞ্চগড়ের উর্বর মাটিতে চা-চাষের মহোৎসব এখানকার মানুষের কৃষি কালচারে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। পঞ্চগড়ের চিনিকল, জুটমিল, ডিস্টিলারিজ, খাম্বা, জেমকন ফ্যাক্টরিতে উৎপাদন পর্যাপ্ত হলেও শিল্প কালচারে এ অঞ্চলের জনমানুষের মাঝে তা ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলতে পারেনি। এখানকার ধর্মীয় সংস্কৃতিতে বিভিন্ন ধর্মের জনমানুষ আলাদা আলাদা সর্বজনীন অনুষ্ঠানাদি পালন করায় সম্প্রীতির স্বাক্ষর বহন করছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আধুনিক যুগের নিরানন্দ, বিউটি পার্লার নির্ভর পারিবারিক বিয়ে বাড়ির সংস্কৃতি যখন অন্ধকারে, ওই সময় পঞ্চগড়ের হিন্দু সমাজের সাতপাকের বিয়েবাড়িতে এখনো ঢাকঢোলে উত্তাল হয়ে ওঠে। মুসলিমদের বিয়ের অনুষ্ঠানে এখনো গ্রামের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ দাদা-দাদি, নানা-নানি, চাচা-চাচিদের সমন্বয়ে বর-কনের গায়ে হলুদের সংস্কৃতি টিকে রয়েছে। বিয়েবাড়িতে প্রতিবেশী মহিলাদের গলায় হাত রেখে দল বেঁধে বরের আগমনে হেরুয়ার সুরে কনের বাড়িতে ‘বর ধোলাই’, একইভাবে বরের বাড়ি কনের আগমনে প্রতিপক্ষ প্রতিবেশীদের কনের ‘জাত ধোয়া’ হেরুয়ার সুর সত্যিই এক আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি করে। ফলে বিয়েবাড়িতে দাওয়াতি-বিনাদাওয়াতি উৎসুক জনতার ভিড় পঞ্চগড়ের মান সভ্যতায় ইতিহাস পরিমার্জন করে চলছে। কন্যাকুলের বদ্ধ ধারণা, নতুন বিবাহিত কনের ভাদ্র মাসের প্রথম তিন দিন বাপের বাড়িতেই থাকতে হবে।  কারণ এ-সময় স্বামীর দেখা মিললে কনে অন্ধ হয়ে যাবে। নতুন বিবাহিত এই তিন দিন কনের বাপের বাড়ি থাকাকে পঞ্চগড়ে ‘ভাদর-কাটানি’ উৎসব হিসেবে উদযাপিত হয়। অথচ এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। এরপরও এলাকার জনমানুষ এই উৎসবকে আদি সংস্কৃতি হিসেবে গ্রহণ করেছে।  

সবচেয়ে বড় সম্প্রীতির মহোৎসব শুরু হয় প্রতিবছর দুর্গাপূজা ঘিরে। জেলার বিভিন্ন এলাকার মন্দিরে মন্দিরে ঢাকঢোলের তালে আরতি নৃত্যানুষ্ঠানে মানুষের বাঁধভাঙা ঢল নামে। লক্ষ্মীপূজা উপলক্ষে গ্রামে-গ্রামে, পাড়ায়-পাড়ায় মন্দিরের আঙিনায় ‘ধামেরগান’ নামক অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয় এ অঞ্চলের লোকজপালা। আঞ্চলিক ভাষায় পরিবেশিত মানপাঁচালি, রংপাঁচালির কাহিনীনির্ভর আসরে হাজারও নারী-পুরুষ, বয়োবৃৃদ্ধ, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীর ভিড় লক্ষণীয়। ছেলেরা মেয়ে সেজে এই পালাগানে অভিনয় করে। সমাজের খেটে খাওয়া জনমানুষের দুঃখ-কষ্ট, হাসি-কান্না নিয়ে নির্মিত পালাগানেই এই অঞ্চলের সম্প্রীতির আত্মপরিচয় উঠে আসছে অনাদিকাল থেকে। খেলা-মেলার পঞ্চগড়ের অন্যতম সংস্কৃতি বিভিন্ন মেলা-পার্বণ। এর মধ্যে জেলার আটোয়ারী উপজেলার নাগর নদী ঘেঁষে ৪০ দিনব্যাপী আলোয়া খোয়া রাশমেলা, বোদা উপজেলার কাজলদীঘি কালিয়াগঞ্জ ইউনিয়নের ঘাগড়া আরাজি গ্রামের বুকচিরে প্রবাহিত করতোয়া পাড়ের তিন দিনব্যাপী বারুনি ‘বান্নী’ মেলা, তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুর ইউনিয়নের ভদ্রেশ্বর গ্রামে দক্ষিণ করতোয়া ও সাও নদীর মিলনস্থলের শিবমন্দির ঘিরে অনুষ্ঠিত তিন দিনব্যাপী ভদ্রেশ্বর শিবযাত্রা মেলা, আটোয়ারী উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের বার আউলিয়ার মেলা, বলরামপুর ইউনিয়নে লীলার মেলা, দেবীগঞ্জের শিব চতুর্দশী স্নান মেলা শুধু এই অঞ্চলের নয়, বরং সারা বাংলার মানবমনের নিত্যদিনের দুঃখগাঁথা, কর্মশৈলী, জীবনালেখ্য, ধর্মীয় আচার-আচরণ প্রকাশ হয়ে আসছে। বাঙালির মানব মনের এই সংস্কৃতির শুধু উত্তরাঞ্চল নয়, সারা দেশের জনমানুষের অনাদিকালের বন্ধন হয়ে টিকে আছে। মেলা উপলক্ষে অত্রাঞ্চলের কৃষি শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটছে।  

বিশ্বসভ্যতায় আধুনিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ পা রাখায়, জাতির বৃহৎ অংশ যান্ত্রিক যুগের যন্ত্রণায় ভুগছে; তখন পঞ্চগড়ের জনমানুষের আদি সংস্কৃতি পালাগান, যাত্রাপালা জীবন্ত হয়ে আবির্ভূত হচ্ছে। এ ছাড়া আধুনিক যুগের সঙ্গে শুধু তাল মেলাতে নয়, বিশ্ব সংস্কৃতির সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হতে পেরেছে পঞ্চগড়ের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। পঞ্চগড় বিদ্রোহী শিশু-কিশোর থিয়েটার এ যাবৎ পঞ্চগড়ের শিশুদের নিয়ে ৮টি আন্তর্জাতিক উৎসবে এবং ১২টি জাতীয় উৎসবে অংশগ্রহণ করেছে। ফলে পঞ্চগড়ের সংস্কৃতি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসার দাবিদার। এ ছাড়া এক্ষেত্রে পঞ্চগড় বিদ্রোহী যুব উন্নয়ন থিয়েটার, ভূমিজ, কারিগর, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, পঞ্চগড় শিল্পকলা একাডেমির সাংস্কৃতিক ব্যক্তি, সংশ্লিষ্ট শিল্পী ও অভিনেতারা এ অঞ্চলের ক্রীড়া কালচার নিয়মিত লালন করে যাচ্ছেন। পঞ্চগড়ের আঞ্চলিক গান চির অমর, ‘আইশা মাসের বাইশা তারিখ, ঠিক হইছে মোর বিয়ার তারিখ’ এখনো সর্বজেলার শ্রোতাদের বিমুগ্ধ করে। সমাজ ও রাষ্ট্রের একটি বৃহৎ অংশ যখন অর্থের মোহে অন্ধ, ওই সময় পঞ্চগড়ের ক্রীড়া সংস্কৃতি অত্যন্ত প্রবল এবং প্রখর স্রোতে চলমান। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পঞ্চগড়ের মেয়েরা ফুটবল, হ্যান্ডবল, ক্রিকেটসহ বিভিন্ন অ্যাক্রোবেটিকে সাফল্যের অধিকারী। মজার ব্যাপার, এখানকার যুবক-যুবতী, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীরা মৌসুমী বিভিন্ন ক্রীড়া সংস্কৃতির চর্চা নিজ উদ্যোগে গ্রামে, পাড়ায়, মহল্লায় নিয়মিত করে আসায়, বলতে দ্বিধা নেই পঞ্চগড় অঞ্চলটি ক্রীড়া ও সংস্কৃতির আঁতুরঘর। আঞ্চলিক ক্রীড়া সংস্কৃতির মধ্যে জনপ্রিয় পাখি খেলা, বৈশাখী উৎসবে ঘোড়দৌড়, লাঠি খেলা এখনো পঞ্চগড়ে জমজমাট হয়ে দেখা দেয়। পঞ্চগড়ের সবচেয়ে উন্নত এবং মধুর সংস্কৃতির মধ্যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি অন্যতম। এখানে দলমত নির্বিশেষে একই টেবিলে একই স্টলে সময়-অসময়ে প্রীতির বন্ধনে একত্র হওয়ায়, এখানে কোনো রাজনৈতিক সংঘাত নেই। এক কথায় পঞ্চগড়ের সম্প্রীতি সংস্কৃতি পর্যটন শিল্পের জন্য যেমন মহা সম্পদ, তেমনি এখানকার মানবের মিলন প্রহর সম্প্রীতির চিরস্বাক্ষর।  

পঞ্চগড় জেলা বাংলাদেশের সর্বউত্তর প্রান্তের জেলা হলেও এ জেলায় প্রথম বৃহৎ শিল্পের প্রসার ঘটে ১৯৬৯ সালে। পঞ্চগড় সুগার মিলস লিমিটেড প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। পরে এ জেলায় কৃষিভিত্তিক অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গত বছরগুলোতে পঞ্চগড়ে ব্যবসা পরিচালনায় এই জনপদ বর্তমানে উল্লেখযোগ্য উন্নয়নের পথে হাঁটছে। ফলে এলাকার মানুষের আর্থসামাজিক ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নেও গতি এসেছে। ইদানিংকালে পঞ্চগড় জেলার অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুনভাবে যোগ হয়েছে চা চাষ। বাংলাদেশে সমতলভূমিতে বাণিজ্যিকভিত্তিতে কেবল এই জেলাতেই চা চাষ হচ্ছে। ইতোমধ্যে চা চাষ জেলার কৃষিতে একটি বড় জায়গা করে নিয়েছে। যার ফল অনুযায়ী জেলার প্রায় আনাচে-কানাচেই চোখে পড়ে বিস্তৃত সবুজে ঘেরা অসংখ্য সব চা বাগান। সমতল ভূমিতে চা চাষের এই ব্যবসাও এখন পর্যটনের নতুন কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। পঞ্চগড়ের পর্যটন শিল্প এখানকার কৃষ্টি ও সম্প্রীতির চিরায়ত আবাহনকে কেন্দ্র করেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে। পাশাপাশি কৃষ্টি ও শিল্পের নানাবিধ উদ্যোগ পর্যটন শিল্পকে ত্বরান্বিত করবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই।  

লেখক : শিশু সংগঠক ও নাট্যকার 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads