• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
ভাসানচর : এক চর, দুই দাবিদার

সংগৃহীত ছবি

মতামত

ভাসানচর : এক চর, দুই দাবিদার

  • প্রকাশিত ০৫ নভেম্বর ২০১৯

পূর্বে নাম ছিল ন্যায়ামস্তি। স্থানীয়দের মতে, প্রায় দুই দশক আগে মেঘনার বুকে এ চরটি জেগে উঠেছিল। তখন এটি জাইল্লার চর (জেলের চর) নামেও পরিচিত ছিল। এরপর নাম পরিবর্তন হয়ে কাঁকড়ার চর হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। সর্বশেষ এটি ঠেঙ্গারচর, যা বর্তমানে ভাসানচর হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে এক লাখ শরণার্থী রোহিঙ্গার স্থানান্তর নিয়ে বহুল আলোচিত এই চরটি হাতিয়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার পূর্বে এবং চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ উপজেলার পশ্চিম প্রান্ত থেকে ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত। মেঘনা নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় প্রায় ২০ বছর আগে জেগে ওঠে বিচ্ছিন্ন ও জনমানবশূন্য ভাসানচর। কিন্তু এই চর নিয়ে নোয়াখালী জেলা ও সন্দ্বীপ উপজেলার মাঝে চলছে দীর্ঘদিনের বিরোধ। একদিকে নোয়াখালীর দাবি এটা তাদের হাতিয়ার অংশ, অন্যদিকে সন্দ্বীপবাসীর দাবি এটা তাদের নদীগর্ভে হারিয়ে যাওয়া পৈত্রিক ভূমি ন্যায়ামস্তি।

বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ সন্দ্বীপ। ১৯৫৪ সালে ৭৫টি মৌজা থেকে ১৫টি মৌজা নোয়াখালী জেলাকে ছেড়ে দিয়ে ৬০টি মৌজা নিয়ে সন্দ্বীপ চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। এই ৬৫ বছরে ন্যায়ামস্তি, ইজ্জতপুর, কাটগড়, বাটাজোড়াসহ অনেকগুলো মৌজা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে হারিয়ে যাওয়া সন্দ্বীপের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন ছিল ন্যায়ামস্তি। একসময় নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া সন্দ্বীপ উপজেলার ন্যায়ামস্তি ইউনিয়ন ছিল আজকের ভাসানচর বা ঠেঙ্গারচর। কিন্তু এই দাবি নোয়াখালীরা মানতে নারাজ।

যেখানে সন্দ্বীপ থেকে ভাসানচরে যেতে সময় লাগে ১৫ থেকে ২০ মিনিট, সেখানে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলা থেকে ভাসানচরে যেতে সময় লাগে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা। অতীতে এই চরের মালিকানা ফিরে পাওয়ার জন্য সন্দ্বীপবাসী দফায় দফায় অনেক মানববন্ধন, সভা-সমিতি করেছে। ন্যায়ামস্তি তথা ভাসানচরকে সন্দ্বীপের থানা হিসেবে ঘোষণা করার জন্য হাইকোর্টে মামলাও আছে। রিট আবেদনকারী মামলা নং-৭০৯৮/২০১৮ থাকা সত্ত্বেও কয়েক দিন আগে নতুন সাতটি পুলিশি থানার অনুমোদন দিয়েছে সরকার। তার মধ্যে একটি নোয়াখালীর ভাসানচর। রিট চলা অবস্থায় এই চর কীভাবে নোয়াখালীর থানা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় তা কারো বোধগম্য নয়।

এদিকে নতুন করে জেগে ওঠা ভাসানচরকে সন্দ্বীপের সাবেক ন্যায়ামস্তি ইউনিয়ন হিসেবে সন্দ্বীপ রেঞ্জের আওতায় বনায়ন করা হয়। ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত লাগানো এক হাজার ৫০ একর জমিতে ম্যানগ্রোভ বনায়ন এখন দৃশ্যমান। এই চর প্রথম আলোচনায় আসে ২০১৭ সালে। যখন এক লাখ রোহিঙ্গাকে ন্যায়ামস্তি তথা ভাসানচরে স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তখন সেতু ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এটাকে নোয়াখালীর হাতিয়ার অংশ হিসেবে ঘোষণা করেন। দীর্ঘদিন আলোচনায় থাকার পর যখন এটাকে নোয়াখালীর নতুন থানা ঘোষণা করে সরকার, তখন আবারো সন্দ্বীপবাসী আন্দোলন শুরু করে। এক সপ্তাহ ধরে সন্দ্বীপসহ ঢাকা-চট্টগ্রাম ও প্রবাসে সন্দ্বীপবাসীরা তাদের ভেঙে যাওয়া পুনরায় জেগে ওঠা ভাসানচর তথা ন্যায়ামস্তিকে পূর্বপুরুষদের ভিটা আখ্যায়িত করে এটি সন্দ্বীপের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে পুনরায় ঘোষণা দেওয়ার দাবিতে সভা-সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছে। দলমত-নির্বিশেষে স্লোগান তুলেছে দ্বীপবাসী-‘বাপ দাদার ভিটা চর, সন্দ্বীপবাসী রক্ষা কর’। ভাসানচর সন্দ্বীপের অতি নিকটবর্তী হওয়ার পাশাপাশি ভূমি জরিপ, নদী জরিপ, নকশা ও খতিয়ান অনুযায়ী সব প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও নোয়াখালীরা নিজেদের বলে দাবি করে চলেছে।

পূর্বে নাম ছিল ঠেঙ্গারচর। এরপর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নাম পরিবর্তন করে দিয়েছেন ভাসানচর। চরে গুল্মলতা জাতীয় বিভিন্ন গাছপালা জন্মে তা শুকিয়ে ঢেউয়ের চোটে সন্দ্বীপ উপকূলে ভেসে আসত। নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে যাওয়ার সময় জেলেরা এসব শুকনো লতা জ্বালানির জন্য সংগ্রহ করত। এ চর থেকে ভেসে আসা এসব লতার (সন্দ্বীপী ভাষায় ঠেঙ্গা) নামেই জেলেরা এটিকে ‘ঠেঙ্গারচর’ বলতে বলতে এ নামেই এটি পরিচিতি হয়ে ওঠে। ঠেঙ্গারচরের দৈর্ঘ্য ৮ কিলোমিটার ও প্রস্থ সাড়ে ৪ কিলোমিটার। আয়তন প্রায় ১০ হাজার একর। সন্দ্বীপ বন বিভাগের রোপণ করা কেওড়া গাছগুলো দিয়ে আচ্ছাদিত চরের প্রায় অংশ। চলাচলের জন্য এখানে কোনো নির্দিষ্ট রাস্তা বা পথ নেই। বেশির ভাগ সময় পুরো চরটি কর্দমাক্ত থাকে। চরের ভেতরে রয়েছে কয়েকটি শাখা খাল। ভাসানচরকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল এলাকা ঘোষণা করা হয় ২০১৩ সালে। বর্তমানে সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য বিশাল এলাকাজুড়ে বসতভিটা ও আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করেন।

বর্তমানে সন্দ্বীপের মানুষ বেশি বিক্ষুব্ধ এই কারণে যে, সরকারি ঘোষণায় ঠেঙ্গারচরকে হাতিয়ার অন্তর্ভুক্ত বলে ঘোষণা দেওয়ায়। এ মুহূর্তে সরকারি পরিকল্পনা কী হচ্ছে তা নিয়ে তাদের মাথা ঘামানোর চেয়ে নিজেদের ভূমির স্বীকৃতি আদায়ের দাবিতে তারা অনড়। সাধারণ জনগণের দাবি এখানকার ভেঙে যাওয়া সাবেক ইউনিয়ন ‘ন্যায়ামস্তি’ সীমানায় সাগর থেকে জেগে উঠেছে ঠেঙ্গারচর। বাংলাদেশের হাজার বছরের ঐতিহ্যে ঘেরা দ্বীপ সন্দ্বীপ। একসময় জাহাজ ও লবণশিল্পের জন্য ছিল এই দ্বীপের আলাদা খ্যাতি। প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে শিক্ষা, শিল্প, বাণিজ্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখে আসছে সন্দ্বীপের সন্তানরা। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় ১১ শতাংশ জোগান দিচ্ছে এই দ্বীপের মানুষ। বর্তমানে আকর্ষণীয় পর্যটনের অন্যতম একটি স্থান সন্দ্বীপ। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান থাকার পরও সন্দ্বীপ কেন এত অবহেলিত? নিজেদের ভূমি অন্যরা কেড়ে নিচ্ছে অথচ তার কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না।

সন্দ্বীপের ভেঙে যাওয়া বিভিন্ন ইউনিয়নের শত শত মানুষ এখানে-ওখানে অস্থায়ীভাবে বসবাস করছে। আবার অনেকে ঘরবাড়ি হারিয়ে বেড়িবাঁধে মানবেতর জীবনযাপন করছে। সাগরে চর জেগে ওঠা দেখে তারা আশায় বুক বেধেছে পুরনো ভিটায় আবার নতুন করে বসবাস করার। নদীভাঙা মানুষগুলো যেখানে আশ্রয় পেতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে নিজেদের ফিরে পাওয়া বাপ-দাদার ভিটেমাটি অন্য কেউ দখল করবে তা সন্দ্বীপবাসী মেনে নেবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ‘ন্যায়ামস্তি’ সমুদ্রের মুখে অবস্থানের কারণে এর ভাঙন যেমনি দ্রুত ও স্বল্প সময়ের মধ্যে ঘটে, তেমনি মেঘনার অববাহিকার প্রবল স্রোতের সাথে আসা প্রচুর পলিমাটি জমে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে ‘ন্যায়ামস্তি’ গ্রামটি আবার জেগে ওঠে এবং এই চরটির আশপাশেও আরো অসংখ্য চর জেগে ওঠে। যার ফলশ্রুতিতে সন্দ্বীপ-চট্টগ্রাম রুটে বিআইডব্লিওটিএর নিয়মিত সার্ভিস জাহাজ পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে হয়েছে। আগামী ২-৪ বছরের মধ্যে এই ঠেঙ্গার চর সন্দ্বীপের সাথেই হয়তো লেগে যাবে। অপর দিকে নোয়াখালী জেলার হাতিয়া দ্বীপটি ভাসানচর থেকে বিশাল দূরত্বে অবস্থিত যা গুগল ম্যাপটি দেখলে সহজেই অনুধাবন করতে পারবেন। এই নির্মম বাস্তবতার আলোকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এর যথাযথ তদন্ত সাপেক্ষে সঠিক সিদ্ধান্ত দেবেন, এই প্রত্যাশা রাখি।

জিসান মাহমুদ

লেখক : প্রাবন্ধিক

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads